চলন্ত ট্রামে নাটক : এক ব্যতিক্রমী নাট্যনির্মাণ 'উড়োচিঠি'
ধরুন একটা স্পেস। হতে পারে ফাঁকা। হতে পারে সামান্য কয়েকটা চেয়ার। হয়ত একটা ভাঙা টেবিল। অথবা একটা ভরা ট্রাম। ঝিমোতে ঝিমোতে চলেছে কলকাতার রাস্তা দিয়ে। এরা প্রত্যেকে একটা গল্প বলে। প্রত্যেকে একটি পারফরমেন্সের অঙ্গ। সেই পারফর্মেন্সকে যদি জুড়ে দেওয়া যায় অন্য কোনও আখ্যানের সঙ্গে? অথবা সেই পারফরমেন্সকে সঙ্গী করে যদি একটা নাটক বুনে তোলা যায়?
থিয়েটারে অল্টারনেটিভ স্পেস নিয়ে অভিনব সব কাজ বহুকাল ধরেই চলছে। প্রচলিত ছক ভেঙে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, হচ্ছেও।
কিন্তু ঠিক কতটা ভাঙা সম্ভব? একটা নাট্য, দর্শককে কতটা ঢুকিয়ে নিতে পারে নিজের মধ্যে?
ধরা যাক একটা চলন্ত ট্রাম। সেটাই নাট্য। টিকিটে ট্রাম টিকিটের ছোঁয়া রাখার চেষ্টা। দর্শক সওয়ার হলো । সিট স্বভাবতই খুব বেশি নয়। মাত্র তিরিশ মতন। ট্রামের পেছনের কামরা যাকে আমরা সেকেন্ড ক্লাস বলতে অভ্যস্ত, সেইখানেই গড়ে উঠছে এই নাট্য। অভিনেতারাও ট্রামে সহযাত্রী। ট্রাম যাবে টালিগঞ্জ থেকে বালিগঞ্জ। আবার ফিরেও আসবে। মাঝখানে ঘণ্টাদেড়েক। তার মধ্যেই দর্শক আর নাট্যের মধ্যে গড়ে উঠবে এক অলক্ষ্য ডিসকোর্স। দর্শক গল্পের অঙ্গ হয়ে যাবেন।
গল্পটা তেমন নতুন নয়। বরং বেশ পুরোনো। বেশ চেনা। পাড়ার প্রেম। এমন সেই প্রেমের ট্রাজেডি। ক্লাসিকাল ট্র্যাজেডির ধরণ হয়ত মানছে না। অথবা কোথাও বা মানছেও। রাইজিং একশন , ক্যাথারসিস ফলিং একশনের পিরামিডটা নেই। তবে ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে তুলতে এক চরিত্রের মধ্যেকার 'গুণে'র বাড়াবাড়ি।আপাত ভাবেই। ধরা যাক 'বিরহ' হল সেই তথাকথিত গুণ। যা স্বাভাবিক। যা থাকে আমাদের সবার মধ্যে। তার সঙ্গে এসে হাত ধরল কথা রাখা। সেই কথা রাখতে চাওয়ার প্রাবল্যেই হয়ত একসময় বন্ধুর থেকে বড়ো হয়ে ওঠে এক চিঠি। প্রেমিকার থেকে বড়ো হয়ে ওঠে অভিজ্ঞান। নায়ক হয়ত, হয়ত অবচেতনেই নায়িকার মৃত্যু কামনা করে। এবং মৃত্যু আসে। নায়ককে ফিরতে হয় সেই ফেলে আসা ট্রামের শহরে। এইবার কী পড়া হবে সেই চিঠি? নাকি এই নাট্য নির্মাণ করবে এক আশ্চর্য যাত্রা। এক চিঠির উড়োচিঠি হয়ে যাওয়ায় গল্প!
সম্পর্কের নতুন নাট্য "উড়োচিঠি"। ট্রামের স্পেসকে ব্যবহার করে আলো ছায়ার খেলায়, ট্রামের মধ্যেই বুনে তোলা হয়েছে এই গল্প। নির্দেশনায় জিতাদিত্য চক্রবর্তী। এই নাট্যের জন্য চমৎকার আবহ এবং গান তৈরি করেছেন দেবদীপ মুখার্জি।
অল্টারনেটিভ স্পেসকে ব্যবহার করা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে বহু পুরোনো। যেরকম জায়গায় ঘটনা ঘটছে সেই জায়গাতেই নাট্যনির্মাণ সেই কবে নবীন বসুর থিয়েটারেই করা হয়েছে। তবে চলন্ত ট্রাম, সহযাত্রীর মত দর্শক আর অভিনেতা, তারা একই সঙ্গে গান গায়, একই সঙ্গে হাসে আর একই সঙ্গে কষ্ট পায়। এই সুতোটা অপূর্ব মুন্সিয়ানায় বুনে তোলার জন্য নির্দেশকের অভিনন্দন প্রাপ্য। অভিনেতারাও অসাধারণ। খুব স্বাভাবিক এবং শক্তিশালী অভিনয়ে তাঁরা দর্শককে মাতিয়ে রাখেন। আলাদা করে বলতেই হয় জিতাদিত্য চক্রবর্তীর কথা। আর চলন্ত ট্রাম, রাসবিহারীর মোড়, সাউদার্ন এভিনিউ, রাস্তার কোলাহল, হর্নের আওয়াজ, সবাই সবাই এই নাট্যের অভিনেতা হয়ে পড়ে। সবাই কিছু না কিছু পারফরম্যান্স করছে। দর্শকও যেন নাট্যকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বুনে তুলছেন একটি গল্প। দর্শক এবং নাট্যের জীবন্ত আর স্বাভাবিক সম্পর্ক এই নাট্যের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। বিষয় হিসেবে ততটা না হলেও,পরীক্ষামূলক আঙ্গিকের সফল প্রয়োগে এই নাট্য দর্শকদের মাতিয়ে রাখে।
চলন্ত ট্রামে নাটকের অভিজ্ঞতা। শুরুতে এককাপ গরম চা। নতুন এই অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে দেখে নেওয়াই যায়, উড়োচিঠি। হয়ত মনে পড়ে যাবে ফেলে আসা প্রেম। কথা দেওয়া। আর কয়েকটা না পড়া চিঠি। এক মনকেমনের চিঠি তো আমরা সবাই আমাদের বুক পকেটে লুকিয়ে রেখেছি। জমিয়ে রেখেছি। অনুভব করছি। কিন্তু পড়ছি কি?
...............................
#নাটক #ট্রাম #Bengali Theatre