ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক গানের ধারণা নিয়ে আসেন পরিচালক নীতিন বসু
তিন থেকে ছয়ের দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্রে একটি সম্ভ্রম-জাগানো নাম ছিল নীতিন বসু। তিনি ছিলেন পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার, প্রযোজক। বাংলা, হিন্দি দুই ভাষায় বহু হিট ছবি উপহার দিয়ে গেছেন। ভারতীয় সংগীতে প্লে-ব্যাক গানের ধারণা এসেছিল তাঁর হাত ধরেই। তাঁর নির্দেশিত ছবি দিয়েই অভিনয় দুনিয়ায় পা রাখেন উত্তম কুমার। অথচ ক-জন আজ মনে রাখেন 'দাদাসাহেব ফালকে'-জয়ী নীতিন বসুকে?
নীতিন বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৬ এপ্রিল, কলকাতায়। পিতা কুন্তলীন-খ্যাত বিখ্যাত উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রমোহন বসু। মা মৃণালিনী বসু ছিলেন বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারের কন্যা, শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটবোন ও সুকুমার রায়ের পিসি। হেমেন্দ্রমোহনের নানারকম ব্যবসার মধ্যে একটি ছিল ক্যামেরা প্রজেক্টরের ব্যবসা। পিতার কাছ থেকেই তিনি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বহু বিষয়ে, বিশেষত ফটোগ্রাফিতে শিক্ষালাভ করেন।
নীতিন ১৯২১ সালে বেলজিয়ান সম্রাটের ভারতদর্শন বিষয়ক একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। এরপর বেশ কয়েক বছর ক্যামেরা ও সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেন। ১৯২৫ সালে জয়গোপাল পিল্লাই-এর নির্বাক ছবি 'Incarnation'-এ কাজ করেন। ১৯২৬ সালে করেন 'পুনর্জন্ম' নামের ছবির সিনেমাটোগ্রাফি। ১৯৩১ সালে সিনেমাটোগ্রাফার তথা প্রধান টেকনিকাল উপদেষ্টা হিসেবে তিনি যোগ দেন নিউ থিয়েটারস স্টুডিওয়। তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি (হিন্দি) 'ডাকু মনসুর' মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালে। নীতিন বসুর 'ভাগ্যচক্র' (১৯৩৫)-ই প্রথম ভারতীয় ছবি যেখানে প্লে ব্যাক গান ব্যবহার করা হয়। সেই ছবিতে গান গেয়েছিলেন বিখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, পারুল ঘোষ ও সুপ্রভা সরকার। সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল ও রেকর্ডিস্ট মুকুল বোসের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি প্লে-ব্যাক গানের ভাবনা প্রয়োগ করেন। আজও মূলধারার ভারতীয় চলচ্চিত্র এই ফর্মুলা কঠোরভাবে অনুসরণ করছে।
নিউ থিয়েটার্সের হয়ে তাঁর সেরা কাজ দেশের মাটি (১৯৩৮) ও জীবন-মরণ (১৯৩৯)। দুটি ছবিই সামাজিক সমস্যা নিয়ে সচেতনতার বার্তা বহন করে। কাশীনাথ (১৯৪৩) ছবির কাজ চলাকালীন নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার বি.এন. সরকারের সঙ্গে মনান্তর হয় এবং তিনি নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে বম্বে গিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
বম্বে-তে গিয়ে প্রথমে তিনি বম্বে টকিজের সঙ্গে কাজ করেন। বম্বে টকিজের ব্যানারে নীতিন বসুর প্রথম কাজ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে নৌকাডুবি (১৯৪৭)। এরপর ১৯৪৮ সালে তিনি তৈরি করেন 'দৃষ্টিদান'। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা উত্তমকুমারের প্রথম ছবি এটিই। অভিনয়ে শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন সুনন্দা ব্যানার্জী ও অসিত বরণ। এছাড়া এই পর্বে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি দিদার (১৯৫১) ও দর্দে দিল (১৯৫৩)। এর মধ্যে দ্বিতীয় ছবিটি তিনি নিজেই প্রযোজনা করেন।
ছয়ের দশকে ফিল্মিস্তান কোম্পানির ব্যানারে তিনি কয়েকটি ছবি তৈরি করেন। তাঁর নির্দেশনায় ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'গঙ্গা যমুনা' ছবিটি ভারতের সর্বকালের সেরা ব্লকবাস্টার হিন্দি ছবিগুলির মধ্যে একটি বলে পরিগণিত হয়। এই ছবিটি প্রযোজনা করেন দিলীপকুমার। অভিনয়ে ছিলেন দিলীপকুমার ও বৈজয়ন্তীমালা। যদিও নীতিন বসুর বকলমে আসলে দিলীপকুমারই এই ছবিটি পরিচালনা করেন, এমন কথা শোনা যায়।
১৯৮৬ সালে নীতিন বসুর মৃত্যু হয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন।
........................
#নীতিন বসু #Nitin Bose #Filmmaker #silly পয়েন্ট