ডায়মন্ড বনাম চক্রবর্তী : বিজ্ঞানে বাঙালির দাদাগিরি
ঘটনা ১ – সময়টা এই ১৮৮৯ সালের আশেপাশে। আমেরিকার পেটেন্ট অফিসে জনৈক ব্যক্তি আবেদন জানালেন, পাইন গাছের পাতা থেকে এক বিশেষ তন্তু বের করেছেন তিনি, এর পেটেন্ট তাকে দেওয়া হোক। পেটেন্ট কমিশনার নাকচ করে দিলেন। বলা হল, প্রকৃতিতে উৎপন্ন কোন কিছুর উপর কারও ব্যক্তিগত মালিকানা নেই; ওভাবে চলতে থাকলে তো বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রজাতির গাছের পেটেন্ট দাবি করবে, এমনকি মাটি খুঁড়ে পাওয়া দামি খনিজেও এমন অদ্ভুত দাবি ফলাবে! কাজেই সজীব বস্তু ও প্রাকৃতিক উপাদানে পেটেন্ট, নৈব নৈব চ।
ঘটনা ২ – একশো বছর পার। ১৯৮৯ সালের এক সন্ধ্যায়, আলাস্কা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল এক্সন ভ্যালডেজ জাহাজ, ৫৩ মিলিয়ন গ্যালন পেট্রোলিয়াম সঙ্গে নিয়ে। যাত্রাশুরুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দুর্বিপাক। প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ড উপকূলে সমুদ্রতলের প্রাচীরে আছড়ে পড়ল জাহাজ। ১১ মিলিয়ন গ্যালন তেল ছড়িয়ে গেল উপকূলবর্তী সমুদ্র আর খাঁড়ি বেয়ে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির নিরিখে আজও বিশ্বের পয়লা নম্বর দুর্ঘটনা এইটিই। ১৩০০ মাইল এলাকা জুড়ে লক্ষাধিক সামুদ্রিক প্রাণী নিশ্চিহ্ন হল, আগামী কয়েক দশক জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল আরও অনেক।
আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে ১৯৭১ সাল নাগাদ। পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা শেষ করে নিউ ইয়র্কে জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানির চাকরিতে ঢুকেছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী। সংস্থাটি প্রযুক্তিক্ষেত্রে স্বনামধন্য – জুস-মেকার থেকে জেটপ্লেন সবকিছুতেই তার কারিগরি। কিন্তু সত্তর দশকের শুরুতেই আমেরিকার বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রে সরকারি লগ্নি কমতে থাকে, জেনারেল ইলেক্ট্রিকের অংশীদারিতে থাকা কিছু প্রোজেক্ট শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়। তাই তারা ব্যবসার অভিমুখ ঘুরিয়ে নেয় পরিবেশের উন্নতিকরণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের দিকে, বিজ্ঞানীরা নিয়োজিত হন জৈববর্জ্য থেকে প্রোটিন-সমৃদ্ধ পশুখাদ্য তৈরির কাজে। এইখানেই আমাদের বঙ্গসন্তানের ছাপোষা এন্ট্রি। পিএইচডির পর ওদেশে গিয়ে সিউডোমোনাস ব্যাক্টেরিয়ার জৈবযৌগ ভাঙ্গার ক্ষমতা নিয়েই গবেষণা করেছেন, এমন কাজের প্রস্তাব পেয়ে লুফে নিলেন। এদিকে মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা, কয়েকবছরের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন সিউডোমোনাসের এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তেল বা পেট্রোলিয়ামের মত জটিল হাইড্রোকার্বন যৌগকে ভেঙ্গে প্রোটিন তৈরি করা সম্ভব। বিশ্ববাজারে তখন তেল সস্তা, প্রোটিন দামি এবং খাদ্য ইন্ডাস্ট্রির বাজার গরম। সদ্যই টোরি ক্যানিয়ন ট্যাঙ্কারের দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার টন তেল সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়েছে, কাজেই পরিবেশের হাল ফেরাতে জৈবপদ্ধতি প্রয়োগের মঞ্চও তৈরি। অতএব সারাদিন অফিসের কাজ করে, রাতে আবার ল্যাবে ফেরত এবং ব্যক্তিগত ব্রেনস্টর্মিং-এ মনোনিবেশ। একবছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে পরীক্ষাগারে জন্ম নিল এমন সিউডোমোনাস যা অশোধিত তেলের অধিকাংশ জটিল হাইড্রোকার্বনকে ভেঙ্গে নিজের প্রোটিন ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। সেই সঙ্গে, পেট্রোলিয়াম পরিশোধনের পর নিচে পড়ে থাকা ঘন, চিটচিটে অবশেষকেও এই ব্যাক্টেরিয়া একইভাবে হজম করতে সক্ষম।
বিজ্ঞানী মাত্রেই যেমন ভাবেন, আবিষ্কারকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরাই দস্তুর। কর্তৃপক্ষকে জানালেন, তেল আভিভের এক সম্মেলনে এই বিষয়ে বক্তৃতা দিতে চান। এরপর একদিন কাজের ফাঁকে বাথরুমে গেছেন, পাশের কিউবিকলে কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট আর্থার ব্যুশ! তিনি এই ছোকরার কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, কথায় কথায় বললেন –
“তেলখেকো ব্যাক্টেরিয়ার রিসার্চ নিয়ে তো ভাষণ দিচ্ছ, তা এসব সত্যি-সত্যি হয় নাকি?”“হয় মানে? করে দেখেছি! সেইজন্যই তো সেমিনারে যাচ্ছি।”“আহ্হা! কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রথম কাজ হল, ভাষণের অ্যাপ্লিকেশন না দিয়ে পেটেন্টের অ্যাপ্লিকেশন দেওয়া।”
ডাক পড়ল অভিজ্ঞ উকিলের, সংস্থার পেটেন্ট দফতর পাঠাল লিও ম্যালোসিকে। বেচারা ম্যালোসি, এদ্দিন ধরে পেটেন্ট করে এসেছেন ফ্রিজ, প্লেন এমনকি নিউক্লিয়ার প্লান্টের; ব্যাক্টেরিয়ার পেটেন্টও চাইলেন একইভাবে। পত্রপাঠ খারিজ হল সে আবেদন। কারণ? ঠিক যা বলা হয়েছিল প্রথম ঘটনায়! রাতদিন আইনের কেতাব ঘেঁটে ম্যালোসি বুঝলেন, এই জায়গায় ফাঁকফোঁকর প্রচুর। ফার্মা কোম্পানিগুলো মূলত উৎপন্ন বস্তুর বদলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার পেটেন্ট নেয়, তাই তারা গা বাঁচিয়ে চলতে পারে। বিভিন্ন অ্যাটর্নিকে জিজ্ঞেস করে দেখলেন, সবাই বলছে এটাই দস্তুর, কিন্তু প্রত্যেকের কারণ আলাদা। অর্থাৎ আইনের মিথ হয়ে ওঠার ভিতকে কেউ প্রশ্ন করেনি। ম্যালোসি আবার অ্যাপিল করলেন পেটেন্ট বোর্ডে। বললেন, এই ব্যাক্টেরিয়া কোন প্রাকৃতিক সৃষ্টিই নয়, তার জন্ম তো বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগারে! বক্তব্যে এতটুকুও মিথ্যে নেই। সিউডোমোনাসের অমন অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য দায়ী কিছু উৎসেচক, আর তাদের সৃষ্টির জন্য দায়ী কিছু জিন, যা থাকে ব্যাক্টেরিয়ার মূল ক্রোমোজোমের বাইরে, প্লাজমিডে। বিজ্ঞানী করেছেন কী, এক ব্যাক্টেরিয়ার প্লাজমিড আরেক ব্যাক্টেরিয়াতে চালান করেছেন। তারপর ইউ.ভি. রে দ্বারা দুই প্লাজমিডকে যুক্ত করেছেন, যাতে তারা আলাদা হতে না পারে। আবার তাদের অন্য ব্যাক্টেরিয়াতে চালান করেছেন। এইভাবে চারটে আলাদা প্লাজমিডকে একত্র করে একটা সিউডোমোনাসের খোলসে এনেছেন, যা প্রকৃতিতে স্বাভাবিক নিয়মে পাওয়াই অসম্ভব।
পেটেন্ট অফিসারও ছাড়ার পাত্র নন। বললেন, এইসবের ফলে সিউডোমোনাসের চরিত্রে বদল এলেও, তার পরিচয় এখনও সিউডোমোনাস, কাজেই সে প্রকৃতির দান। ম্যালোসি পাল্টা খেললেন; বিজ্ঞানের কারিকুরিতে ব্যাক্টেরিয়ার প্রাকৃতিক উপাদান বদলে গেছে, কাজেই আইনত সে এখন প্রযুক্তির দান। অনেক টানাপোড়েনের পর বোর্ড মেনে নিল, বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কার প্রাকৃতিক নয়, কিন্তু একইসঙ্গে সজীবতার যুক্তিতে খারিজ করল পেটেন্টের দাবি। তাদের মতে, সজীব বস্তুর পেটেন্ট মেনে নিলে খুলে যাবে প্যান্ডোরার বাক্স। ব্যাক্টেরিয়ার প্লাজমিড বদলের মতো মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পরেও যদি একই দাবি ওঠে? লিভার বা কিডনি প্রতিস্থাপিত হলে সেই মানুষকেও বলতে হবে অপ্রাকৃতিক!
অন্য কেউ হলে কী করত বলা যায় না, কিন্তু বাঙালির গোঁ সর্বজনবিদিত। কেস গড়াল পেটেন্ট বোর্ড থেকে পেটেন্ট কোর্টে। ম্যালোসি আইন ঘেঁটে দেখিয়ে দিলেন, কোথাও বলা নেই যে জীবন্ত হলেই তাকে পেটেন্টের আওতায় আনা যাবে না, প্রাকৃতিক না হলেই হল। বছর কয়েকের সওয়াল-জবাবের পর ১৯৭৫ সালের মার্চে বিচারক রায় দিলেন বিজ্ঞানীর পক্ষে। স্পষ্ট জানালেন, বিজ্ঞানের উন্নতিতে আইন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। পেটেন্ট অফিসের কাছে বাকি রইল একটাই পথ – সুপ্রিম কোর্ট।
এদিকে জীববিজ্ঞানের জগতে তখন তোলপাড়, ডিএনএ-তে সরাসরি কাটাছেঁড়া করার প্রযুক্তি, Recombinant DNA Technology, চলে এসেছে বিজ্ঞানীদের হাতের মুঠোয়। তাই দিয়ে শুরু হয়েছে সোমাটোস্ট্যাটিন ও থাইরয়েডের মতো হরমোনের ব্যবসায়িক উৎপাদন। পেটেন্ট কমিশনার যখন সুপ্রিম কোর্টে অ্যাপিল করলেন, তখন এই কেসের সঙ্গে আমেরিকার সমস্ত বায়োটেকনোলজি ফার্মের তৎকালীন ও ভবিষ্যৎ লগ্নির আগ্রহ জড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে মার্কিন কংগ্রেসের সংশয়, জেনেটিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অপব্যবহারের হাতিয়ার হয়ে না দাঁড়ায়!
১৬ই জুন, ১৯৮০; আদালতে অপেক্ষারত বিজ্ঞানী ও তাঁর উকিল। সুপ্রিম কোর্ট জানাল, জেনেটিক কারিকুরির অপব্যবহার আটকানো যেমন আইনের দায়, তেমনই প্রযুক্তিকে বাধা দিয়ে উন্নতির পথ না আটকানোও আইনের কর্তব্য - শুধুমাত্র অণুজীবের খোলনলচে বদলানোর পেটেন্টে সজীবতার তত্ত্ব বাধা হতে পারেনা! আটবছরের এই ঐতিহাসিক মামলায় সর্বশেষ বাদীপক্ষ ছিলেন পেটেন্ট কমিশনার সিডনি ডায়মন্ড, তাই আজও এই মামলার একটাই পরিচয় – ডায়মন্ড বনাম চক্রবর্তী।
ফিরে যাই সেই দ্বিতীয় ঘটনায়? জীববৈচিত্র্য বাঁচিয়ে বর্জ্য পরিষ্কার করতে যখন সবাই হিমশিম, আসরে নামানো হয় তেলখেকো সিউডোমোনাসকে। পছন্দের খাবার পেয়ে সে যত বংশ বাড়াতে থাকে, বছরের পর বছর জুড়ে কমতে থাকে দূষণের মাত্রা। এই মহাযজ্ঞের ঋত্বিক একজনই, সেই মামলার বিবাদী পক্ষ, ডঃ আনন্দমোহন চক্রবর্তী। ডিএনএ-র কারিকুরি যখন অধরা, বায়োটেকনোলজি শব্দটাই যখন ভবিষ্যতের গর্ভে, তখন শুধুমাত্র নিজের মেধাকে আয়ুধ করে এক বাঙালি পাল্টে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের ভাষা, এক অসম লড়াইয়ে নেমেছিলেন খোদ মার্কিন আইনের বিরুদ্ধে। নিজের জীবদ্দশায় অর্জন করেছেন রাশি রাশি আন্তর্জাতিক সম্মান, ঝুলিতে ছিল উনিশটি সফল পেটেন্ট এবং বিশ্বের প্রথম ‘অণুজৈবিক পেটেন্ট’-এর তকমা। অভিশপ্ত ২০২০ অনেকের মতো তাঁকেও আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু তাঁর দাপট মুছে দিতে পারেনি। বাঙালি শুধু ক্রিকেটের মাঠেই জামা খুলে ওড়ায়নি, বিজ্ঞানের মঞ্চেও কলার তুলে ঘুরেছে। সেই দাদাগিরি ভুলে গেলে চলবে?
তথ্যসূত্রঃ (১) “Ananda Chakrabarty wins a patent: biotechnology, law, and society” by D. J. Kevles(২) “Expanding patent coverage: Policy implications of Diamond v. Chakrabarty” by Frank P. Darr(৩) Exxon Valdez oil spill, History.com
#বিজ্ঞান #পপুলার সায়েন্স #আনন্দমোহন চক্রবর্তী #সায়নদীপ গুপ্ত