মুক্তগদ্য

ধুলামাটি দিয়া (তৃতীয় পর্ব)

প্রজ্ঞাদীপা হালদার Nov 24, 2021 at 4:01 pm মুক্তগদ্য

(৩)

শ্রুতিপিসি আমাদের বাড়িতে আসতেন কলকাতায় চিকিৎসা করাবার জন্যে। কালো একহারা চেহারার শ্রুতি চক্রবর্তী রাঘবপুর গ্রামের মেয়ে, বাবার বন্ধু। ১৯৭৯ সাল নাগাদ বাবারা ফিরে এসে চাকরি করতে শুরু করেন উত্তরবঙ্গের স্কুলে। তাঁদের পরিচয় থেকে চরমপন্থীর ছাপটুকু মোছা যায়নি। শ্রুতিপিসি, পিসির ভাই বাবলাকাকু, বাবা, এঁরা সকলেই স্কুলে পড়াতেন। পিসির চেহারায় একটা অদ্ভুত জোর ছিল। মা বলতেন প্রথম হারমোনিয়াম কিনবার পরে মায়েরা একসঙ্গে মে দিবসের গান গাইতেন। সমবেত গোষ্ঠীবদ্ধ এই সংগীতের চর্চা বহুদিন ছিল আমাদের বাড়িতে। বিনোদনহীন সেই মফস্‌সলে, বিকেল হলেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে কোনও না কোনও অতিথি গেয়ে উঠতেন, যারা ক্যাফেতে মোড়েতে বসে আছ, আমি তোমাদের ছেড়ে চললাম। বিকেলের রোদ বুলটাইদের বাড়ি পেরিয়ে গুটিগুটি সেনপুকুরের দিকে চলে যেত, আমারও ইচ্ছে করত চললাম বলে তার পেছনে পেছনে চলে যাই। তারপর নাহয় কালবৈশাখী খুঁজে এনে দেব লোকগুলোকে। 

এইসব গানের সময়গুলোতে শ্রুতিপিসি কষ্ট করে বসে থাকত, চেয়ারে, মুখে অপার্থিব আলো মেখে। অঙ্কে ভুল হলে মা আমাদের দু-চার ঘা দিতেন প্রায়ই। পিসি একদিন বলল, বউদি মারবেন না, ছোটদের মারতে নেই। পিসি অনেক গল্প বলত আমাদে‌র, তার সব মনে নেই। কিন্তু একটা গল্প বড্ড ভালো লাগত। পিসো ছিলেন নাট্য আন্দোলনের কর্মী, কলেজের অধ্যাপক। বন্দি ছিলেন অনেকদিন। পিসি তাঁর ছেলেকে নিয়ে জেলখানায় যখন পিসোর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, পিসিকে দেখে সবাই অবাক হয়ে বলত, ইশ দেখেছ স্বামী আর ছেলে কী চমৎকার দেখতে। পিসো জেল থেকে ফেরত আসেননি আর। 

পিসিও ফেরেনি হাসপাতাল থেকে। বারবার অপারেশন হবার পর নানারকম জটিলতায় মেডিকেল কলেজেই মরে গেল পিসি। মা রোজ দেখতে যেতেন। যেদিন ফিরে এসে বললেন তোদের পিসি আর আসবে না, সেদিন উঠোনে পিসির লাগানো কাঠটগরের গাছে ফুল এসেছিল। বহুদিন পরে বনগাঁ স্টেশনে মা শ্রুতিপিসির বোনেদের দেখেন। তাদের জিজ্ঞেস করেন কী অপরাধে তারা তাদের দিদিকে একটি বারও হাসপাতালে দেখতে যায়নি? বোনেরা বলেছিল, দিদি আর দাদার রাজনীতির সুবাদে অনেকরকম লোক আসত বাড়িতে। আমরা নিরাপদ ছিলাম না। দিদি জানত, কই দিদি তো কখনও প্রতিবাদ করেনি। 


বহুকাল পরে শ্রুতিপিসিকে মনে পড়ছে। অবশ্য শ্রুতি তাঁর আসল নাম নয়। প্রতিবাদ তাঁর চরিত্রানুগ ছিল না এমন তো নয়। এবিটিএর মিটিংয়ে উত্তরবঙ্গের অবিসংবাদিত এক সিপিএম নেতা বাবার নাম করে বলেছিল অমুক তো ক্যামোফ্লাজড নকশাল, আমরা দেখে নেব ওঁকে। শ্রুতিপিসি নাকি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, কে বললেন, সামনে আসুন। ক্ষমতাসীন গুন্ডারা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। পিসি জানত ছোটোদের মারতে নেই। তবে? এইসব পরস্পরবিরোধিতা নিয়ে খুব ভাবি আজকাল। এককালে আমার ধারণা ছিল বিপ্লব মানুষকে এক অতিলৌকিক চরিত্র দান করে। ভাবতাম বাবার সব বন্ধুদের কথা একদিন ইতিহাসে লেখা হবে। সেইসব সোনার অক্ষরের ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। কবে হবে জানি না তাও। শ্রুতিপিসির ছেলে শেষ অবধি আত্মহত্যা করল। ইতিহাস আর বিপ্লবের সমূহ সম্ভাবনার তালিকা থেকে মুছে গেল একটি পরিবার।  

রাতে ঘুমের মধ্যে আসতেন সঞ্জয়কাকু। অনেক রাতে কথাবার্তার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতো। মা রাঁধতে বসতেন লাল রঙের জনতা স্টোভ জ্বালিয়ে। কথাবার্তা হত মৃদুস্বরে, যেন আমাদের ঘুম না ভেঙে যায়। সাতের দশক, বিপ্লবের দিন, বন্ধুদের কথা ঘুরে ফিরে আসত। সঞ্জয়কাকু বাবার চেয়ে ছোটো অনেক, বাবারা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সঞ্জয়কাকু স্কুলের শেষ ধাপে। পত্রিকা, কাগজপত্র আনা নেওয়া করতেন, সেভাবেই শুরু। ওঁর মা আর দিদা ছিলেন পার্টির ক্লোজ সিমপ্যাথাইজার। জোতদার পরিবারদের এই দুই গৃহবধূ গলার জোরে ঘোল খাইয়ে দিতেন তাবড় পুলিশ অফিসারদের, তারপর গাল দিতেন বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো অলপ্পেয়ে ছেলেগুলোকে। সঞ্জয়কাকু হাসতেন গমগমে গলায়, তাঁর হাসির চোটে পায়রা উড়ে যেত। অত রাতে হাসির শব্দ অনেক দূরে যায়। মা চাপা গলায় বলতেন, আস্তে, আস্তে। আমি আর ঘুমিয়ে থাকতে পারতাম না। জেগে উঠে বসতাম। চাপা গলায় সঞ্জয়কাকু গাইতেন, মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি, সেদিন সুদূর নয় আর। গানের সঙ্গে সঙ্গে পুবের আকাশে আলোর রেখা দেখা দিত। মায়ের উনুনে আঁচ পড়ত। আমাকে জেগে উঠতে দেখে সঞ্জয়কাকু একটা লাল আপেল দিতেন হাতে, কখনও ঘূর্ণির কাজের মতো আদ্ধেক লাল আদ্ধেক হলুদ পেয়ারাফুলি আম। বাবাকে বলতেন, দাদা আসছি। তারপর মায়ের উনুনের ধোঁয়ার মতো আবছা হতে হতে একটু বাতাবিলেবুর ফুলের গন্ধ রেখে চলে যেতেন সঞ্জয়কাকু। তাঁর আসা যাওয়ার কোনও চিহ্ন পড়ে রইত না। বাসন সাফ হয়ে যেত, বাকিরা উঠবার আগেই, স্টোভ উঠে পড়ত রান্নাঘরের তাকে। আমার জন্যে রয়ে যেত গানের সুর আর লাল আপেল। বহুদিন অবধি আমি অন্যদের ভুলে গেলেও সঞ্জয়কাকুর কথা মনে রেখেছিলাম। বাজারে সাজানো আপেলের সম্ভার দেখলে এখনও আমার সঞ্জয়কাকুর কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে কেমন করে লংমার্চের শীতল রাতে একটি আপেল ঘিরে গড়ে উঠেছিল সাত কমরেডের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির ইতিহাস। একটি লাল আপেলের গায়ে আঁকা হয় আমাদের পৃথিবী, খিদে আর বন্ধুত্বের অভিজ্ঞানে।



সুকোমল কাকু ছিলেন ডাক্তার, কাকার বন্ধু। যখন ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সহায়ক সমিতি তৈরি হয়েছিল, সুকোমল কাকুরা সদ্য ডাক্তার হয়েছেন। প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। খর্বদেহ, ভারী চশমা এই মানুষটি বহুদিন আমাদের পরিবারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। বাবার সঙ্গে ছিল তাঁর প্রাণের যোগ। সরকারি উচ্চপদে ছিলেন, মধ্যবয়েসে হঠাৎই একদিন বিপ্লবের অমোঘ আকর্ষণে বাঁধা গতের রাস্তা ছেড়ে রওনা হলেন নিরুদ্দেশে। ইনিও আমায় আমার মধ্যবয়েসে অবাক করেন। কত সহজে সব কিছু তুচ্ছ করা যায় তাহলে? বাবা বলতেন, কার্ল মার্ক্স যখন দাস ক্যাপিটাল রচনা করছিলেন, খিদেয় মরে যাচ্ছিল তাঁর সন্তানেরা। বাবার শেখানো পাঠ নিয়ে কখনও প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন করিনি, দাস ক্যাপিটালের চেয়ে সন্তানের জীবনের দাম কি বেশি হয় না? প্রশ্ন করিনি কীসের আকর্ষণে ঘর সংসার স্ত্রী সন্তানকে ছেড়ে লোকে অনিশ্চিতের জন্যে পা বাড়ায়। লাল সূর্যের আলোয় লাল সকালের অলীক স্বপ্ন, তার এত দাম?  


মা বাবার চিন্তাভাবনা ছিল গণচিনের কম্যুনিস্টদের মতো। ক্যাচ দেম ইয়ং। আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাশিয়ান আর চিনা বই, গাইতে শেখানো হয়েছিল গণসংগীত। অনেকদিন অবধি আমি যে-কোনো রবীন্দ্রসংগীতের চেয়ে ভালো গাইতে পারতাম, “আমরা এই দুনিয়ায় জীবনের গান শোনাই, মুক্তির গান শোনাই”। বাবা গল্প বলতেন ওয়াং হাই আর জোয়া-সুরার। অনেকদিন অবধি আমরা জানতে পারিনি সোভিয়েত রাশিয়া বলে কোনও দেশ আর মানচিত্রে নেই। বাবা অনেক গল্প বলেছেন, বলেননি কেবল নিজের ভাগের গল্পটুকু। সেই বয়েসে আমরা বাবার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করতাম। বাবাও বিশ্বাস করতেন, একদিন না একদিন তাঁর মেয়েরা মানুষের গান গাইবেই।  

[চলবে...]

অলংকরণ: ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

আগের পর্বগুলি পড়ুন: ধুলামাটি দিয়া (প্রথম পর্ব)

                              ধুলামাটি দিয়া (দ্বিতীয় পর্ব)

#সিলি পয়েন্ট #গদ্য #ধুলামাটি দিয়া #প্রজ্ঞাদীপা হালদার #ওয়েব পোর্টাল #ওয়েবজিন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

40

Unique Visitors

219285