ধুলামাটি দিয়া (দ্বিতীয় পর্ব)
(২)
বারাসাত একটি আধা গ্রাম, আধা গঞ্জ। ঝোপঝাড়, ফাঁকা মাঠ, অঢেল জ্যোছনা সেখানে স্কোয়্যার ফিট হিসেবে বিক্রি হয় না। খোয়া ওঠা রাস্তার দুধারে পুরোনো সব বাড়ি। নির্জন রাস্তায় একজন দুজন সাইকেল আরোহী। সাকুল্যে দুটি মুদির দোকান, কুমুদিনী ঔষধালয়, রাধা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, জ্যাক-জিল পুস্তকালয়, বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠ, সাঁওতালপাড়া আর বারোয়ারিতলা এই নিয়ে ছিমছাম জনপদ। বড় রাস্তা দিয়ে বাস যেত তিন-চারটে রুটের। সিঙ্গল লাইন ট্রেন। ব্যস, আর কিছু নেই। অবশ্য নেই বলে থেমে যাবার কিছু নেই। বারাসাতে একসময় অনেক মানুষ ছিল, যারা আলো জ্বালতে চেয়েছিল (এই আলো জ্বালার কথাটা হয়তো পুরো গুছিয়ে বলা উচিত ছিল। কিন্তু আলো জ্বালাবার তো কোনও অভিধান নেই, আমার এমন ভাবতেই ভালো লাগে, আলো জ্বালতে মানুষেরা সব জনপদেই ছিল একদিন।) এখানে কোম্পানি আমলের ঠাটবাট জীবনযাত্রা রাস্তা পেরোলে এখনও দিব্যি আছে। বারাসাতের বোধহয় তাই পুরো কলকাতা হয়ে উঠতে অনেকদিন লেগে যাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে অনেক মাঠ, বাগান আর পুকুর, প্রোমোটার এখনও যার সন্ধান পায়নি। এইসব নির্জনতার সুযোগ নিয়ে বড় বড় কালো ভ্যানগাড়ি নাকি সাতের দশকের রাস্তায় উগরে দিয়ে যেত অল্পবয়েসি ছেলের মৃতদেহ। গুলিতে থ্যাঁতলানো মাথা, উপড়ানো দাঁত নখ, শূন্য অক্ষিকোটর। দিদু ফিসফিস করে বলতেন, “নকশাল, নকশাল”। মোড়ের মাথায় এখনও গোড়ায় ডাস্টবিন নিয়ে একটা দুটো নিরলংকার শহিদবেদি রয়েছে। এখন আর তাতে মালা পড়ে না। শহিদবেদিতে লেখা আছে “কংগ্রেসী হায়েনার আক্রমণে নিহত কমঃ সুখময় মিত্র লাল সেলাম”। তিমিরবরণ সিংহ বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে শহিদ হন যখন, কত বয়েস ছিল তাঁর? তিনি লিখেছিলেন, “ও পাগল, পাগলামি তুই ছাড়/ ঘরে তোর মুমূর্ষু বোন/পাগলামি তুই ছাড়/ বল তো/ শহীদ হওয়া কি আমাদের পোষায়?” তিমির কি কখনও এই কবিতাটি কনফার্ম করেছিলেন কবিতা বলে? এই কবিতাটা পড়লে আমার মনে হয় তিমিরের বৃদ্ধা মা বুঝি মিনতি করছেন, ও পাগল, পাগলামি তুই ছাড়। (বারাসাত হত্যাকাণ্ড কলকাতায় কাস্টডিয়াল কিলিং-এর অ্যাসিড টেস্ট। আড়িয়াদহের যে নজনের মৃতদেহ ফেলে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে চারজনের বয়েস ছিল চোদ্দো থেকে উনিশের মধ্যে।)
এদেশীয় সম্পন্ন পাড়ায় বাসা বেঁধেছেন এক চড়ুই দম্পতি। বয়স অল্প হলেও দুজনেরই বেশ ভারভাত্তিক ভাব, সমীহ না করলে চলে না। স্থানীয় স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হিসেবে পুরুষ চরিত্রটি যোগ দিয়েছেন, খর্ব ও কৃশকায়, চোখে ভারী চশমা, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। মহিলা চরিত্রটি তুলনায় হাসিখুশি, মিশুকে, চমৎকার গান করেন। উত্তরবঙ্গে অনেকদিন কাটাবার পরে এঁরা এখানে স্কুলের চাকরি নিয়ে এসেছেন। এঁরা ঠিক এ পাড়ার চরিত্র হিসেবে মিশ খেতে পারেন না। আকণ্ঠ কংগ্রেসী পাড়ায়, যে বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে এলেন এঁরা, সেটি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের। ঘরের মধ্যেকার চর্চা কিছু বুঝতে দিত না। তবু একটি উদ্বাস্তুবান্ধব, বামচেতনাসমর্থক পরিবেশ যে নয় তা দিব্যি টের পাওয়া যেত। টের পাওয়া যেত ভোটের দেওয়াল লিখনে, আলাপচারিতায়। বাড়িওয়ালার দুই ছেলেই খুব ভালোবাসত আমাদের দু-বোনকেই, কিন্তু খেপাত বাঙাল বলে।
সত্তরের দশক সবে অতীত হয়েছে। বাম সরকার গঠিত হয়েছে বিনা বিচারে আটক ও বিচারাধীন সব রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দেবার আশ্বাস দিয়ে। স্মলনি ইনস্টিটিউটের বারান্দা থেকে যেমন হাত নেড়েছিলেন লেনিন, বিপ্লব হয়ে গেছে । তেমনই ১৯৭৯-এর জুন মাসের সেই বিকেলে রাইটার্সের বারান্দায় জনসমুদ্রের সামনে জ্যোতি বসুর আশ্বাস ছিল দক্ষিণপন্থী সব অত্যাচারের অবসান হবে। জনগণের সরকার জনগণের পাশে থাকবে। সেই আশ্বাসে নির্বাসনে থাকা, অন্তরিন থাকা যেসব মানুষেরা ফিরে এসেছিলেন, ভেবেছিলেন মানুষের জন্যে কাজ করা যাবে। মাস্টারমশাই আর তাঁর বউও তাঁদের হিসেবে পড়েন। স্থায়ী চাকরি ছেড়ে তাঁরা ফিরে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে। স্কুলে পড়াবেন, যেখানে স্কুল নেই সেইসব জায়গায়। বিপ্লব হোক বা না হোক, শিক্ষার তো কোনও বিকল্প নেই। এই সবই আমার শোনা কথা। কিছু কিছু পড়া। তবুও এমন সত্যি মনে হয়, দেখতে পাই রাইটার্সের বারান্দায় হাত নাড়ছেন জ্যোতি বসু, বিপ্লব হয়ে গেছে।
[চলবে...]
অলংকরণ: ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#সিলি পয়েন্ট #গদ্য #ধুলামাটি দিয়া #প্রজ্ঞাদীপা হালদার #ওয়েব পোর্টাল #ওয়েবজিন