মুক্তগদ্য

ধুলামাটি দিয়া (চতুর্থ পর্ব)

প্রজ্ঞাদীপা হালদার Nov 27, 2021 at 4:17 am মুক্তগদ্য

(৪)

 ............... 

এককালে আমাদের মফস্‌সলি আধা শহর আধা গ্রামগুলোয় সন্ধের অন্ধকারগুলো হাফহার্টেড ছিল না। বাইরে বাতাবি লেবুর পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকিরা জটলা করত। দূর থেকে ভেসে আসত কুকুরের ঘেউ। কাদের সিঁড়িঘরে লণ্ঠনের আলো দেখে আমার কাগজের তৈরি একরকমের সরসরে কুমিরের কথা মনে পড়ত। সেইকালে আমাকে মা অন্ধকার ঘরের মশারির মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বিশাল পরিবারের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি সেরে নিজে খেতে বসতেন রান্নাঘরের মেঝেয় পিঁড়ি পেতে। আমার বাতাবিলেবুর ফুলের গন্ধে থম্‌থমে অন্ধকার মশারির ভিতরে ঘুম ভেঙে যেত, অন্ধকারের ভয়ে সিঁটকে গিয়ে ছেঁচড়ে নামতাম খাট থেকে, রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অর্ধসমাপ্ত খাওয়া ফেলে রেখে মা কোলে করে আমায় আবার ঘুমোতে নিয়ে যেতেন, মৃদুমন্দ গানের সঙ্গে চাপড় মেরে ঘুম পাড়াতেন।


বাবার বন্ধুরা আসতেন এইসব সান্দ্র অন্ধকারে। তাঁদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলত কেরোসিনের আলো। আলোর উপরে নাচত পোকাদের প্রাগৈতিহাসিক ছায়া। কেন অন্ধকার তাঁদের যাওয়া আসার সময় ছিল, তা বুঝে ওঠার জন্যে আমি বড্ড ছোটো ছিলাম। ‘এখন বুঝে উঠতে পারি’ সেই সন্দর্ভের জন্যে আমি লিখছি না কিছু। দূরাবরোহ স্মৃতি খুঁড়ে তোলার একপ্রকার বেদনা আছে যা আমাদের কিছু মর্ষকামী আনন্দ জোগায়। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? সকলেই, সকলেই ভালোবাসে। সেইভাবে মনে পড়ে নকশাল আন্দোলন সম্বন্ধে আমার প্রথম সজ্ঞান চেতনা লাভ কিশোর ভারতীর পাতায়। দিদিভাই রেডিওর কোন একটা প্রতিযোগিতা জিতে পুরস্কার পেয়েছিল এক বছরের কিশোর ভারতী। তখনও নকশাল আন্দোলনের ঘা কাঁচা ছিল। কত সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে তখনও নিখোঁজ, হিন্দুশাস্ত্রে তো বারো বছরের আগে পারলৌকিক ক্রিয়াও করা যায় না। উপন্যাসটার নাম ছিল নিশান্ত, কার লেখা মনে নেই আর। কিন্তু গল্পটা মনে ছিল। দুই পিসতুতো-মামাতো ভাইয়ের নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার গল্প। একজন লন্ডনে পালিয়ে যায়, অন্যজনের দেহ ফুটপাথে পড়ে থাকে রক্তাক্ত। তার বাবা সান্ত্বনা খোঁজেন ছেলের ছোটোবেলার বইয়ের পাতায়। নিশান্ত শব্দের মানে ভোর, সেটা দেখলাম অভিধান থেকে। আমার তখন বছর আটেক বয়েস, ঠিক করে ফেললাম আমিও নকশাল হব, বাতাসে হাত মুঠো করে দিয়ে গাইব ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’।  


ততদিনে আমাদের পাড়ায় সন্তুকাকু শুরু করেছে জেনারেটরের ব্যবসা। লোডশেডিং হলেই ভটভট শব্দে জেনারেটর চলে ওঠে। আমরা একরকমের ঝিনুক ঝিনুক রঙের প্লাগের অদলাবদলি করে একটা সবেধন নীলমণি আলো আর পাখা চালাই। গোটা পরিবার সেই আলোর তলে শ্যামাপোকার মতো জড়ো হয় আবাসিক প্রাণে। আমাদের সন্ধের অন্ধকারে মিশতে থাকে পোড়া ডিজেলের গন্ধ, আলোর ভেজাল। আস্তে আস্তে উবে যান বাবার বন্ধুরা। আড়ংঘাটার সর্বেশ্বর কাকুকে জনগণের পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে আঠেরো ঘণ্টা উলটো করে ঝুলিয়ে রাখে। আজিজুল হকের চিকিৎসা মেলে না জেল কাস্টডিতে। আমরা রেডিওর খবরে শুনি হৃদয়পুর স্টেশন থেকে ধরা পড়ছেন নামজাদা নকশাল নেতারা, তাঁদের সম্ভাব্য গন্তব্য ভেবে আতঙ্কিত হই। আন্দোলন, বিপ্লব ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ক্রমে। স্কুলের সামনের বাড়িতে এক বিকৃতদেহ বৃদ্ধ সুবিধা পেলেই পথচলতি লোককে পাকড়ে গল্প শোনায় কেমন করে পুলিশ কাস্টডিতে মার খেতে খেতে আধমরা নকশালরা জল চাইলে সে তাঁদের মুখে পেচ্ছাপ করে দিত। কোনও দিন এই লোকটাকে কিচ্ছু বলে না কেউ।  দিভাইয়ের বন্ধু নীলা চক্রবর্তীর বাবা ফাটা বলের মধ্যে বোমার মশলা রোদে দিয়েছিলেন। সেই বল নিয়ে খেলতে গিয়ে মরে গেল নীলা আর তার ভাই। বাবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ, তিনিই আমাদের অঞ্চলের শেষ নথিভুক্ত নকশাল। ইত্যবসরে ‘আজকাল’ পত্রিকা ফিচার করে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার দুর্ভেদ্য অঞ্চলে মাওয়িস্ট কম্যুনিস্ট সেন্টারের জঙ্গিদের নিয়ে, তাঁরা তখন পরিণত হয়েছেন চিড়িয়াখানার আজব জীবে। অথচ বদ্রীদাস টেম্পল স্ট্রিটে গত বছরও গিয়ে দেখেছি এখনও দেওয়ালে আলকাতরার পোঁচ টেনে লেখা আছে ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’। অস্পষ্ট আঁচড়ে আঁকা আছে নির্বিকার মাও সে তুং-এর মুখ। এত বছর হয়ে গেল, এখনও অবিকৃত। পুষ্পশয্যাময় পৃথিবীতে এই কি তবে এখনও একমাত্র প্রতিবাদ!


[চলবে...]

..................... 

অলংকরণ: ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

আগের পর্বগুলি পড়ুন : ধুলামাটি দিয়া (প্রথম পর্ব) 

                               ধুলামাটি দিয়া (দ্বিতীয় পর্ব) 

                               ধুলামাটি দিয়া (তৃতীয় পর্ব)

#গদ্য #ধুলামাটি দিয়া #প্রজ্ঞাদীপা হালদার #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #ওয়েব পোর্টাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

40

Unique Visitors

219285