ধুলামাটি দিয়া (পঞ্চম পর্ব)
শেষ পর্ব
(৫)
নিচে ইউটিউবে মা শুনছেন “ঢেউ উঠছে,কারা টুটছে”। রাতে খেতে যাবার আগে বাবা হাত ধুচ্ছেন। আমাদের বাড়ি সাধারণত শান্ত আর নিস্তরঙ্গ থাকে। আজ যে সামান্য গানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তার কারণ আজ সন্ধেয় মা-বাবাকে বছর পঞ্চাশেক আগেকার অপ্রীতিকর সময় নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেছে। আজ আমরা সন্ধ্যায় কথা বলছিলাম এইসব ভুলে যাওয়া মানুষ আর ঘটনাপঞ্জি নিয়ে। যা যা ভুলে গেছিলাম, তা ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম আবার। কোভিডের পরে বাবার স্মৃতি অনেক মন্থর ও শ্লথ হয়ে গেছে, ন্যুব্জ হয়ে গেছেন বাবাও। প্রতিটি মানুষের চেতনায় তার সমকালীন ইতিহাস ধরা দেয় আলাদা আলাদা ভাবে। সেই বিচ্ছিন্ন পাঠকে একসঙ্গে গাঁথলে তবেই সময়ের একটা সামগ্রিক চিত্র আন্দাজ করা যায়। তাই বাবার সময়ের বাবার স্মৃতি শুনে না নিলে পরে আপশোশ থেকে যেতে পারে এমন একটা অনিরাপত্তার বোধ আজকাল আমায় আক্রান্ত করে।
কলেজে পড়ার সময় সহপাঠী, পরিচিত, অনেকেই কায়দা করে বলতে শুনেছি, আরে বাপটা নকশাল ছিল বে। এত নকশাল থাকতে আন্দোলন বিফল কেন হল, সেই ভেবে আমি অবাক হয়ে যেতাম। আরও অবাক হতাম নকশাল আন্দোলনে “মায়েদের” উপস্থিতি না দেখে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৭, এই আট বছরে শোনা যায় পাঁচ হাজার বামপন্থী গণ আন্দোলনের কর্মী কংগ্রেসি পুলিশের হাতে খুন হয়েছিল। সেই খুনের অন্যতম কর্ণধার রুণু গুহনিয়োগী ভারতে ইতিহাসে একমাত্র নন-আইপিএস যিনি রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন বাম সরকারের বদান্যতায়, এমনটাও খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে শোনা যায় বইকি। আশির দশকেই আবার নকশাল আন্দোলনের পটভূমি আছে এমন মানুষকে ফের গ্রেফতার করা শুরু করেছিল বাম সরকারের পুলিশ, এমনও জনশ্রুতি রয়েছে। আজিজুল হকের একটি সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম তিনি বলেছেন, বাম সরকারের জেলের অবস্থা কংগ্রেস আমলের চেয়েও খারাপ। ১৯৮৬-র ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র খবর, গ্রেফতার হওয়া নকশাল নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক বন্দির বদলে সাধারণ অপরাধজীবী হিসেবে দেখবার জন্যে চাপ দেওয়া হচ্ছে বাম সরকারে বৃহত্তম দল সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কেবল এ কালের আমদানি নয়। তার গাছটি পোঁতা হয়েছিল নদীর ওপারে। দুহাজার এক সালে তৃণমূল কংগ্রসের ভোটে দাঁড়ানোর কালে ‘আজকাল’-এ ছাপা হতো নিহত নিখোঁজ ছাত্রদের দাস্তাঁ, কংগ্রেস আর তার সহযোগীদের অত্যাচারের প্রতিবেদন। প্রতিবেদন শব্দে একটি বেদনা লুকিয়ে রয়েছে। তার পরে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম, তোমার নাম আমার নাম। নকশালদের শেষ প্রজন্মের ফুলিঙ্গ, আর একটি ব্যর্থ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনা। এখন বাকিটুকু হারিয়ে গেছে ভোট নো-ভোটের সমীকরণে।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আমি ও বনবিহারী’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, বিপ্লব কখনও ব্যর্থ হয় না। পার্টি মরে যায়, স্পার্টাকাস থেকে চারু মজুমদার- চে গুয়েভারা- সবাই মরে। এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু হয়। শুধু বিপ্লব মরে না। বিপ্লবের পর বিপ্লব ব্যর্থ হতে পারে, তবু বিপ্লব করার অধিকারই মানুষের একমাত্র অধিকার। বিপ্লব এমন কোনও রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করে দেয় না যা চিরকালের জন্য। বিপ্লব এমন কোনও ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত হতে দেয় না, যা প্রকাশ্যে অথবা লুকিয়ে জনসাধারণের স্বাধীনতা হরণ করে। এত কিছু লেখবার পর কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের দেওয়া সাহিত্য অ্যাকাডেমিটি সম্ভবত গ্রহণই করেছিলেন সন্দীপন। অবশ্য তাতে বিপ্লব ব্যর্থ মনে করার কারণ নেই, সে কথা পূর্বাহ্নেই বলেছি।
এত সব কথার মধ্যে অকথিত থেকে যায় বাবার কথা। এখনও চোরাগোপ্তা আক্রমণের ভয় কাজ করে পরিবারে। বাবার গল্প শুনতে শুনতে আমরা রোমাঞ্চিত হই, গায়ে কাঁটা দেয়, হাসিও অল্পস্বল্প। মা ছদ্মরাগে বলেন, বাপ-মা মরা ছেলে পড়তে এসেছিলে কলকাতায়, তার এত ডানা কীসের? বাবার চোখ আজকাল প্রায় নড়ে না, বাবা স্থির চোখে উত্তর দেন, আমি তো পড়ব বলে কলকাতায় আসিনি, আমি কম্যুনিস্ট হতে চেয়ে, বামপন্থী গণআন্দোলনে অংশ নিতে চেয়ে কলকাতায় এসেছিলাম। গল্প শেষ হয়ে যাবার পরেও এই বাক্যটি ঘরের বদ্ধ শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের হাওয়ায় ঘোরে। মাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করি, আমার বাবা কম্যুনিস্ট হতে চেয়েছিলেন? আমরা ভাবি বাবা ভুল করেছেন, সারাজীবনের কৃচ্ছ্র অর্জনে তিনি তো কম্যুনিস্ট হতে পেরেছেনই, পারাই উচিত। পরে বুঝলাম আমরা ভুল করছি, বাবা ভুল করেননি, কম্যুনিস্ট হতে চাওয়াটা তো একটা নিরন্তর যাত্রা, বিন্দুমাত্র বিচ্যুতির জায়গা নেই সেখানে। পূর্ব পাকিস্তানের সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের মাতৃ-পিতৃহীন দরিদ্র, দলিত একটি ছেলে ষাট বছর আগে কম্যুনিস্ট হতে চেয়েছিল, বিপ্লবের অংশ হতে চেয়েছিল, আজও সারা পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্যাতিত, দরিদ্র নতুন প্রজন্ম বিপ্লবের স্বপ্ন দ্যাখে। বামপন্থা এখানেই জিতে যায় বোধহয়।
আজকাল আমাদের আর লোডশেডিং হয় না। অটোমেটিক সুইচ-ওভারে ইনভার্টার জ্বলে। সন্ধেয় গান গাওয়া ঝিঁঝি পোকারা উধাও হয়ে গেছে। আমার বাবা কম্যুনিস্ট হতে চেয়েছিলেন। আমি কিছুই হতে পারিনি, হয়তো চাইওনি।
[সমাপ্ত]
*****************
অলংকরণ: ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#গদ্য #মুক্তগদ্য #ধুলামাটি দিয়া #প্রজ্ঞাদীপা হালদার #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র #বাংলা #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল