মুক্তগদ্য

ধুলামাটি দিয়া (প্রথম পর্ব)

প্রজ্ঞাদীপা হালদার Nov 23, 2021 at 7:45 am মুক্তগদ্য

প্রথম পর্ব

(১)

সন্ধে হবার আগে মায়ের রোজকার কাজ হ্যারিকেন আর টেবিল ল্যাম্পের চিমনি মোছা। ছোটবেলায় তখন লোডশেডিংয়ের উপচে পড়া অন্ধকারের সঙ্গী ছিল বিবিধ আকার ও রকমের টেবিল ল্যাম্প। আমাদের ভাড়াবাড়ির লম্বা বারান্দার উপরে কাঁঠালকাঠের হাপ-পিঁড়ি পেতে বসে বাবার পুরনো পাঞ্জাবির টুকরো ভাঁজ করে চৌকো বানিয়ে ঘষে ঘষে চিমনি পরিষ্কার করতেন মা। হ্যারিকেনের চিমনি খানিকটা গোল, টেবিল ল্যাম্পের চুড়োটা অনেকটা রুশ রূপকথার বাড়ির ছাদের চিমনির মতো। রুশদেশের বাড়ি আমি দেখেছি ‘মিশা নামের ভালুকটি’ বইয়ে। বইয়ের পাতা খুললেই বাড়িটা দাঁড়িয়ে যায়, দাঁড়িয়ে পড়ে বোঁচকা কাঁধে ফ্রক পরা মেয়ে। অবশ্য বইটা আমাদের নয়, বাবার কাছে বায়না করে প্রায়ই তৃপ্তিপিসির বাড়িতে এই বইটা দেখতেই যাই। 

খুব বেশি পুরুষ্টু হাতে চিমনি মোছা চলে না, সূক্ষ্ম আর নরম হাতে চেপে চেপে মুছতে হয়। নয়তো চিমনির গায়ে ফাট ধরে। শিগগির শিগগির ওই জায়গাটা থেকে  ভেঙে যাবে চিমনি, আসছে হাটবারের আগে তো চিমনি পাওয়া যাবে না। রোজ সন্ধেয় লোডশেডিং, মেয়েদের পড়াশুনোর দফারফা। চিমনি মুছতে গিয়ে এক-একদিন ধারালো মুখটায় মায়ের হাত কেটে যায়। চুড়ির মতোই রক্তের রেখা গোল হয়ে ফোটে, মায়ের তো হাতে কোনও চুড়ি নেই, এই লাল চুড়িতে বেশ মানায় কিছুক্ষণ । সেইসব সাত পাঁচ না ভেবে মা নীল রঙের রেশনে পাওয়া কেরোসিন ভরতেন মোটা কাচের ডিব্বায়। ফিতের মাথা নিপুণ করে কেটে নিতেন (এবড়োখেবড়ো ফিতে হলে আলো জ্বলবে লাফিয়ে লাফিয়ে)। এভাবেই সম্পন্ন হত আমাদের সন্ধ্যার বাধ্যতামূলক আলোকপ্রস্তুতি। 


সন্ধে হলেই দিভাই পড়তে বসবে, ওকে তো বসতেই হবে, ও উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে যায়। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। আমি তো এখনও স্কুলেই যাই না, ওই গোটাকতক ছড়ার বই আমার দিব্যি পড়া আছে। রোজ আলো চলে গেলে মা কুপি জ্বেলে রান্না করেন। আমাদের দু-কামরার ঘরে ঘরে পড়ুয়াদের ভিড়। মাসি পিসি কাকা মামা গৌতমদাদা, বাবার দু-একজন অন্তেবাসী ছাত্র। ওরই মধ্যে দিভাই ভালো ছাত্র বলে একটু বেশি সুযোগ পায়। শোবার ঘরের খাটে একা বসে পড়ে। পাশে আধশোয়া হয়ে থাকেন বাবা, চুপ করে। মা রান্নার মাঝে মাঝে এসে দেখে যান পড়াশুনো কেমন চলছে। 

(আমি এই লেখাটা খুব মন দিয়ে লিখতে পারছি না। অথচ চেষ্টা করছি, বিষয় তো পছন্দমতোই বেছেছিলাম। সাধারণত লিখতে বসলে আমার ভেতর থেকে এইসব নীল লোডশেডিং-এর সন্ধে গলগল করে বেরিয়ে আসে, আমি তাদের ইচ্ছেমতো আঁকি আর মুছি। হারমোনিয়ামের সুরের মতো জেগে থাকে আমাদের গানের বাড়ি।  আমাদের বাড়িটা চিরকাল একটা হোস্টেল, বাবা সেখানকার উদাসীন হেডমাস্টারমশাই, মা রাগি সুপারিন্টেনডেন্ট। এমনটা ভাবলে কেমন হয় ভাবি, মা নিশ্চয়ই খুব দুঃখ পাবেন লেখাটা পড়তে গিয়ে। আজকাল অবশ্য সেই হোস্টেলসুলভতা নেই, এখন বাড়িটা শান্ত সমাধিভূমির মতো, যার ব্যত্যয় নেই, আমরা সকলেই সেই সত্যের অপেক্ষায় আছি। যদিও ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তবু রোজ-কেয়ামতে আমরা সকলে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াব, আমাদের তিক্ত প্রশ্নে তিতিবিরক্ত করব তাঁকে, এই বিশ্বাস আছে।)

আমাদের বাড়িটা অবশ্য বহুদিন পান্থশালার মতো আরামদায়কও ছিল। মা-বাবার যত্ন, নিরাপদ আন্তরিকতায় উষ্ণ হয়ে থাকত। উদ্বাস্তু জীবন থেকে নাগরিক জীবনে যাত্রার পথে, অন্তরিন জীবন থেকে প্রকাশ্য জীবনের যাত্রায় আমাদের বাড়ি  ছিল লালমাটির দিগন্তে একটি ছোট্ট ইটের স্টেশন। লালমাটির কথাটা এখানে মনে পড়ল ‘ফুলগাছটি লাগইছিলম’ গানটার পিছু পিছু। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। মাথার মধ্যে একটা গান ঢুকে গিয়ে বাজতে থাকে দিনরাত। তার পর আক্ষরিক অর্থে মাথা ঘুরতে শুরু করে, গানের সঙ্গে সঙ্গে, তখন ওষুধ খেয়ে কাজকর্ম বন্ধ করে চুপটি করে শুয়ে পড়তে হয়। এমন অবশ্য আমার বরাবরই ছিল।

নব্বইয়ের শুরুর দিকেও যখন রঞ্জনাপিসিরা পত্রিকার বার্ষিক সম্মেলন করতেন সেটা আমার কাছে ছিল পিকনিক। বাবা মায়ের কাছে বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলন। সকাল সকাল শীতের নতুন ওঠা আলু কড়াইশুঁটির দম দিয়ে ভাত খেয়ে মা-বাবার সঙ্গে আমরা পুরো পরিবার গিয়ে দাঁড়াতাম ডাকবাংলো মোড়ের বড় অশত্থ গাছের ছায়ায়। গাছের নীচে পড়ে থাকত শকুনের পালক, মাটির ভাঙা ভাঁড়। খানিক পরে ম্যাটাডোর এলে আমরা উঠে পড়তাম তাতে, অনেক চেনা হাসিমুখ, লম্বা লম্বা হাতে আমাকে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিত গাড়ির ছাদে। যাওয়া হত কোনও নদীর ধারে, গাছের ছায়ায়। অনেকটা রাস্তা, তাই মা আমাকে কোলে শুইয়ে আঁচল চাপা দিয়ে ঘুম পাড়াতেন। ঘুমের মধ্যে শুনতে পেতাম হাসিমুখ লোকগুলো আমার চেনা একটা গান গাইছে, গভীর নদত কুম্ভীর আসে, আসে বন্ধু আসে, কুম্ভীররো মরণ আসে, আসে বন্ধু আসে, বাহুত তোমার বল আসে, হেজার হাতির হাহ আসে, ভয় হঙ্কোচ এরা বান্ধো হে। গাড়ির দুলুনিতে, মায়ের মিঠে চাপড়ানির দুলুনিতে ঘুমুতে ঘুমুতে আমিও সাড়া দিতাম, জীবন ডিঙা বাই থাকা বান্ধোই হে। এরকম একটা দুটো গান আছে যা মাঝে মাঝেই আমার মাথায় বাজতে শুরু করে আচমকা, তার সঙ্গে মিশে যায় গাড়ির ধাবমানতার ছন্দ, সেই লুপ থেকে বেরোনো অসম্ভব হয়ে ওঠে। শব্দই শিশুর আদিম স্মৃতি।   

[চলবে...]

অলংকরণ: ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

#সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল #গদ্য #ধুলামাটি দিয়া #প্রজ্ঞাদীপা হালদার #ওয়েবজিন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

15

Unique Visitors

214723