দেব-দানবে ধুন্ধুমার : নেটফ্লিক্সের নতুন সিরিজ 'ব্লাড অব জিউস'
ওয়েব সিরিজ: ব্লাড অফ জিউসপরিবেশক: নেটফ্লিক্সপ্রযোজক : পাওয়ারহাউস অ্যানিমেশন স্টুডিওজ, ডংউ এ অ্যান্ড ইস্রষ্টা: চার্লি পার্লাপানিদিস, ভ্লাস পার্লাপানিদিসপরিচালক: শাউন্ট নিঘোঘোসিয়ানকন্ঠ: ডেরেক ফিলিপস, জেসন ও’মারা, ক্লডিয়া ক্রিশ্চিয়ান, এলিয়াস টুফেক্সিস, জেসিকা ফেনউইক
ইউরোপীয় সাহিত্যে সর্বাধিক প্রচলিত এক কাহিনিক্রম হল আর্থুরীয় কিংবদন্তির গল্প। পালক পিতা স্যর এক্টরের কাছে সাধারণভাবে বেড়ে ওঠা রাজপুত্র আর্থারের কাছে হঠাৎ একদিন উপস্থিত হয় জাদুকর মার্লিন, যথার্থ শিক্ষা দিয়ে তাকে তৈরি করে ভবিষ্যতের মহাযুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য। ডিজনির দ্য লায়ন কিং থেকে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার হয়ে হালফিলের দক্ষিণ ভারতীয় বাহুবলী ছবিতেও পাই সেই একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি। অনেকটা সেই ছাঁচে ঢেলেই তৈরি করা হয়েছে নেটফ্লিক্সের ব্রাড অফ জিউস অ্যানিমেশন সিরিজের নায়ক হেরনের কাহিনি। দ্য ক্ল্যাশ অফ দ্য টাইটানস ছবির নায়ক ধীবরপুত্র পার্সিয়ুসের গল্প যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন সেই ছবির মত হেরনের গল্পেও কীভাবে গ্রীক কিংবদন্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে আমেরিকান নায়কের উপাখ্যান, বাস্তব জীবনের আব্রাহাম লিঙ্কন বা কমিকসের ক্যাপ্টেন আমেরিকা’র মতোই যে উঠে আসে অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা থেকে। নগরবাসীদের হাতে হেরনের মায়ের লাঞ্ছিত হবার দৃশ্যটি মনে করিয়ে দেয় স্টিভ রজার্সের মায়ের কথা। হেরনের অপর প্রান্তে রয়েছে তার ভাই সেরাফিম, যাকে খলনায়কের বদলে নায়কেরই এক বিকৃত বিকল্প সত্তা বলে অভিহিত করা যায়। হেরনের মতোই সেরাফিম পিতৃমাতৃস্নেহবঞ্চিত, কিন্তু জীবনের প্রতিকূলতার সাথে লড়তে লড়তে হেরন যেখানে ক্রোধকে জয় করে যথার্থ স্থৈর্য ও শক্তির রহস্য আবিষ্কার করে, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা সেরাফিম সমস্ত নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে দানবের মাংস ভক্ষণ করে চরম পাপের পথে পা বাড়ায়। হ্যারি পটার ও ভলডেমর্টের মতোই এখানেও নায়ক যখন প্রতিকূলতার মধ্যেই খুঁজে নেয় জীবনের সার্থকতা, খলনায়ক তখন বঞ্চনার জবাব হিসেবে বেছে নেয় অপরাধের অন্ধকারময় পিচ্ছিল পথ। আর্কহ্যাম অ্যাসাইলাম গ্রাফিক নভেলের জোকার বা দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস ছবির বেনের মতোই সেরাফিম বারবার নায়ক হেরনকে তাদের সাদৃশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, এমনকি প্রলোভিত করে তার সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য। সমস্ত বাধা জয় করে দানবদের ভয়াবহ আক্রমণ থেকে দেবকুল ও মানবজাতিকে রক্ষা করে হেরন। আর্থারের এক্সক্যালিবারের মত হেরনকেও জিউস অস্ত্র হিসেবে দেন দৈব তলোয়ার ও বাহন হিসেবে একটি গ্রিফিন, যদিও তলোয়ারটি মূলত সেরাফিমকেই ব্যবহার করতে দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য, হেরনের অভিযানে সঙ্গী হয় তস্কর ইভিয়োস এবং কৃষ্ণাঙ্গ কোফি, পিতৃপরিচয়হীন নায়কের মতোই যাদের অবস্থান প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রান্তে। দেবতাদের মানবায়নের বিষয়টি লক্ষণীয়, হেরন বঞ্চনার অভিযোগ তুললে জিউস তাকে একবারও দুঃসাহসের জন্য কোনরকম শাস্তি দেন না, বরং নীরবে তার প্রশ্নগুলি শোনেন, এবং ব্যথিত চিত্তে স্বীকার করে নেন নিজের অপরাধ। দেবতাদের মধ্যে হেরনের সঙ্গে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে অ্যাপোলো এবং হার্মিস, তারাও যে জিউসের অপর দুই জারজ সন্তান! তবে জিউসের বারংবার ব্যভিচারিতায় বিরক্ত বিদ্রোহিনী হেরাকে খলনায়িকা বানিয়ে দেওয়ার মধ্যে ঈষৎ নারীবিদ্বেষের গন্ধ পাওয়া যায় বটে। এ কাহিনিতে ‘ভালো নারী’ চরিত্রেরা সকলেই প্রশ্নাতীতভাবে পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়, যেমন আজীবন লাঞ্ছনা ভোগ করতে থাকা হেরন ও সেরাফিমের মা ইলেক্ট্রা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণা যুদ্ধবিদ হওয়া সত্ত্বেও হেরনের বাধ্য অনুবর্তিনী হয়ে থাকা আমাজনীয় নারী অ্যালেক্সিয়া। এছাড়া এই গল্পে পূর্বদেশীয় নাগরিকদের যেভাবে অবলীলায় পিশাচ বলে দেখানো হয়েছে তা অবশ্যই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আস্ফালনে বিড়ম্বিত বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে যদি আমরা মধ্যপ্রাচ্যের বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত বর্তমান গ্রিক সরকারের কথা মাথায় রাখি। কারিগরি দিক থেকে চমৎকার কাজ উপহার দিয়েছেন পাওয়ারহাউস অ্যানিমেশন স্টুডিওজ এবং ডংউ এ অ্যান্ড ই প্রতিষ্ঠানের অ্যানিমেশন শিল্পীরা, ঝকঝকে রঙিন ফ্রেমগুলো দর্শকদের চোখ জুড়িয়ে দেবেই। অন্তিম এপিসোডে দেবাসুরের যুদ্ধের জমজমাট দৃশ্যায়ন মনে করিয়ে দিতে পারে ছোটবেলায় মহালয়া বা পৌরাণিক সিরিয়াল দেখবার মুগ্ধতা। সুন্দর কাজ করেছেন সঙ্গীতস্রষ্টা পল এডওয়ার্ড-ফ্রান্সিস, কাহিনির মহাকাব্যিক বিষয়বস্তুর সাথে চমৎকার সঙ্গতি রেখেছে রাজকীয় আবহসঙ্গীত। ধন্যবাদ প্রাপ্য সম্পাদক শিয়া ফর্মানেকেরও, আটটি এপিসোডের প্রত্যেকটিকেই মোটামুটি আধঘণ্টার বেশি দীর্ঘায়িত না করে তিনি কাহিনিক্রমটি আরো টানটান ও নাটকীয় করে তুলেছেন। সুন্দর দৃশ্যায়নের পাশাপাশি গ্রিক পৌরাণিক সংস্কৃতি ও ক্লাসিকাল সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণা পাবার জন্য এই সিরিজ অবশ্যই দেখা উচিত।
#Gods & Heroes #Netflix #Series #Powerhouse Animation Studios # Greek mythology #animated television series #Vlas Parlapanides #Charley Parlapanides #Derek Phillips #Jason O'Mara #নেটফ্লিক্স #ওয়েব সিরিজ #রিভিউ #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য #সিলি পয়েন্ট