ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

নোটবন্দি ও একটি নিছক ধাপ্পা: অনুরাগ কশ্যপের চোকড

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Sep 18, 2020 at 7:51 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছবি: চোকড
পরিচালনা: অনুরাগ কশ্যপ
প্রযোজনা: জার পিকচার্স
শ্রেষ্ঠাংশে: সাইয়ামি খের, রোশন ম্যাথিউ, অম্রুতা সুভাষ, রাজশ্রী দেশপাণ্ডে, উদয় নেনে প্রমুখ
পরিবেশক: নেটফ্লিক্স

২০১৪ সালে বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারে সবচেয়ে নজর কেড়েছিল যে কয়েকটি আশ্বাসবাক্য, তার অন্যতম ছিল আপামর ভারতবাসীর প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা আসবার প্রতিশ্রুতি। যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তৎকালীন ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষ সরল বিশ্বাসে স্বাগত জানিয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর এই অঙ্গীকারকে, বিপুল জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি সরকার। কেমন হতে পারে যদি এই রূপকথার মতো আশ্বাসবাণী আচমকা সত্যি হয়ে ওঠে? এই ছোট্ট প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় চোকড, অনুরাগ কশ্যপ নির্মিত ২০১৬ সালের নোটবন্দির উপরে তৈরি সম্ভবত প্রথম ভারতীয় ছবি।

কাহিনি আবর্তিত হয় মুম্বইয়ের ঘিঞ্জি গলিতে পায়রার খোপের মত গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা অগণিত নিম্ন মধ্যবিত্ত অণুপরিবারগুলির একটিকে ঘিরে- সরকারি ব্যাঙ্কের কেরানি সরিতা পিল্লাই, স্বামী সুশান্ত এবং তাদের একমাত্র পুত্রসন্তানের জীবন পর্যবসিত হয়েছে অনটন আর দাম্পত্যকলহের ক্লান্তিকর রোজনামচায়। রাজ কপূরের 'অব দিল্লি দূর নহি' ছবির জওহরলাল নেহরুর মতোই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর্দায় সশরীরে না থাকলেও তিনি ছড়িয়ে রয়েছেন এ ছবির সর্বত্র। অভাবের সংসারে আলুর তরকারি খেতে খেতে বিরক্ত সুশান্ত যখনই স্ত্রীর কাছে পনির খেতে চায়, টিভিতে শোনা যায় প্রধানমন্ত্রীর ডায়েটে মাশরুমের গুণগান। ভারতের বর্তমান শাসক দলের দর্শনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের প্রাধান্য বিস্তারের পাশাপাশি অন্যতম একটি দিক হল পুরুষতন্ত্রের প্রচার, সুশান্তের অপদার্থতা ও সাংসারিক প্রত্যেকটি বিষয়ে সরিতার প্রতি অতি-নির্ভরতা চোখে আঙুল দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে এই দর্শনের অসারতা প্রমাণ করে দেয়। সুশান্ত যেন বর্তমান ভারতবর্ষের অসংখ্য ব্যর্থ যুবকের প্রতিনিধি, ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা ভুলতে যারা আশ্রয় নিয়েছে হিন্দুত্ববাদের ছত্রছায়ায়। এ ছবিতে মোদী সম্বন্ধে সবচেয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্যগুলি তার মুখেই শোনা যায়। অসাধু রাজনীতিবিদের টাকার বান্ডিলে সরিতাদের অন্ধকার রান্নাঘরে বেসিনের পাইপে জল চলাচল আটকে যাওয়া যেন মনে করিয়ে দেয়, কালো টাকার ভারে এভাবেই দম আটকে আসছে ভারতবর্ষের অর্থনীতির। জলের মধ্যে সরিতার হাতে উঠে আসতে থাকা একের পর এক নোটের অবিশ্বাস্য ছবি আবারও প্রমাণ করে দেয়, কতটা অবাস্তব ছিল সেই পনেরো লাখের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। কালো টাকা উদ্ধারের জন্য শুরু হয় নোটবন্দি, কিন্তু হেনস্থার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। সুদীর্ঘ লাইন এবং ধাক্কাধাক্কিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় সরিতার মত ব্যাঙ্ককর্মীদের, নরকে পরিণত হয় অগণিত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, বেপরোয়া ডাকাতের আক্রমণে ব্যাঙ্কে সৃষ্টি হয় ভয়ানক বিশৃঙ্খলা। সরিতা যেন এই দেশের সাধারণ মানুষেরই প্রতিচ্ছবি, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে যার সঙ্গে স্বামীর মতোই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দেশের শাসকবর্গ। অতীতে রিয়ালিটি শো-তে যে গানটি সরিতা গাইতে উঠেছিল তার বিষয়বস্তু এমন এক প্রেমিক, কথার মায়াজাল বিস্তার করে যে অর্জন করে নিয়েছে সঙ্গিনীর অকুন্ঠ বিশ্বাস। কিন্তু গান শেষ করবার আগেই গলা শুকিয়ে আসে সরিতার, বিবাহের পূর্বে দেওয়া সুশান্তের প্রতিশ্রুতিগুলির মতই মিথ্যে প্রমাণিত হয় প্রধানমন্ত্রীর মোহিনী বাণী, নোটবন্দির বেড়াজালে আটকে সরিতার মতই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে সাধারণ মানুষের। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সুশান্তকে যখন বিরক্ত সরিতা বলে, ‘উনি দেশের জন্য  ঝাড়ু হাতে নিচ্ছেন, তুমিও ঘর ঝাঁট দাও তাহলে, অন্তত সংসারের একটা কাজ হোক তোমাকে দিয়ে’, গোটা প্রহসনটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে। শেষ অবধি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সাহায্যে নয়, পারিবারিক কর্তব্য পালন ও স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আবার জীবনের দিশা খুঁজে পায় সুশান্ত, শান্তি ফেরে তাদের ছোট্ট সংসারে। দেশসেবার জন্য যে প্রধানমন্ত্রীর সংসার ত্যাগের কাহিনী আজ বহুল চর্চিত, তার বিপরীতে নিহিত কাহিনীর এরূপ পরিণতির ব্যঞ্জনা অবশ্যই নজর এড়াবে না দর্শকের।

অভিনয়ে প্রথমেই বলতে হবে সাইয়ামি খেরের কথা, নিয়ন্ত্রিত অভিব্যক্তি ও সংলাপের টাইমিংয়ে তিনি চিত্রনাট্যের দেওয়া সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নজর কেড়েছেন। যোগ্য সঙ্গত করেছেন রোশন ম্যাথিউ, অম্রুতা সুভাষ, রাজশ্রী দেশপাণ্ডে প্রমুখ শিল্পীরা। কর্ষ কলের সঙ্গীত বলার মতো কিছু নয়, তবে ‘পয়সা বোলতা হ্যায়’ গানটির দৃশ্যায়ন দর্শকের ভালো লাগতে পারে। আলাদা করে বলতে হবে চিত্রগ্রাহক সিলভেস্টার ফন্সেস্কার কথা, রাত্রের কিচেনের দৃশ্যগুলিতে আলোআঁধারির খেলার মাধ্যমে রহস্যের সৃষ্টি মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছে। তবে পূর্বের একাধিক ছবির মতোই অনুরাগের এ ছবিও অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের দোষে দুষ্ট, প্রায় দু’ঘন্টা ধরে ছবিটি টেনে নিয়ে যাবার আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না, এ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। অনুরাগ অত্যন্ত দক্ষ পরিচালক, তাঁর থেকে বারংবার এই ত্রুটি কিন্তু একেবারেই প্রত্যাশিত নয়।

#Choked: Paisa Bolta Hai # black comedy film # Anurag Kashyap #Nihit Bhave #Netflix #Good Bad Films #Saiyami Kher # Roshan Mathew #Amruta Subhash # 2016 Indian banknote demonetisation #JAR Pictures #ব্ল্যাক কমেডি #অনুরাগ কাশ্যপ #ফিল্ম রিভিউ #Review #Film Review #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

51

Unique Visitors

215834