ডারউইনের মন জয় করেছিল লালবিহারী দে-র উপন্যাস
হাজার মাইল দূর থেকে শুভেচ্ছাবার্তা এসে পৌঁছল প্রাপকের কাছে। এসে পৌঁছেছে প্রকাশকের মারফত। তাদের সদ্য প্রকাশিত একটি বই সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন জনৈক পাঠক। একইসঙ্গে রয়েছে লেখকের কাছে তাঁর ভালো লাগাটুকু পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ। উনিশ শতকের বাংলায় রেভারেন্ড লালবিহারী দে পড়ে দেখছেন সেই প্রাপ্তি সংবাদ। তাঁরই লেখা একটি বইয়ের সূত্রে এই শুভেচ্ছাবার্তা এসেছে। দৃষ্টি থামছে প্রেরকের নামে, চার্লস ডারউইন।
বিত্ত নয়, মেধার জোরেই বর্ধমানের তালপুকুর নামে এক অখ্যাত গ্রাম থেকে এসে কলকাতা দরবার জিতে নিয়েছিলেন লালবিহারী দে। কিন্তু এই সাফল্যের কৃতিত্ব দেব কাকে? অপূর্ব মেধার অধিকারী লালবিহারীকে, মাত্র চার বছর বয়সেই গ্রাম্য পাঠশালার সমস্ত পাঠ যার আয়ত্ত হয়েছিল? নাকি তার পিতাকে? পুত্রের উচ্চশিক্ষার প্রশ্নে যিনি আত্মীয় পরিজনের বিরোধিতার সঙ্গে আপস করেননি। এই বিরোধের কারণটি যথেষ্ট গুরুতর। সাহেবের স্কুলে কুলধর্ম খোয়ানোর আশঙ্কা। সেকালের সমাজে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারের কাছে যা মোটেই সামান্য নয়।
অভাবের সংসার। সামান্য দালালির কাজ করে দিন গুজরান হয়। তাতে তো আর ইচ্ছে-আশায় রাশ পড়ে না। দীর্ঘদিন কলকাতায় কাজ করার সুবাদে লালবিহারীর পিতা বুঝতে পেরেছিলেন ক্রমশ ফার্সিকে সরিয়ে নিজের জায়গা কায়েম করে নিচ্ছে শাসকের ভাষা। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি ইংরেজি জানা যুবক জীবিকা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বাড়তি সুবিধে পাচ্ছে। তবু ছেলের স্কুলের মাইনে যুগিয়ে উঠতে পারেননা। হেয়ার স্কুল তো দূরে থাক, মাত্র তিনটাকার সংকুলান না হওয়ায় ছেড়ে দিতে হয়েছে গৌরমোহন আঢ্যের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি করার সুযোগ। তবুও হাল ছেড়ে দেননি। স্ত্রীকে লেখা একের পর এক চিঠিতে জানিয়েছেন পুত্রকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার পরিকল্পনা, সেই সূত্রেই এলো তৃতীয় স্কুলে ভর্তির ভাবনা। এটি অবৈতনিক। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা ডফ সাহেব গোড়া থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার। এ স্কুলে ভর্তি হলে ভবিষ্যতে পুত্রের ‘কেরেস্তান’ হওয়া নিশ্চিত। কদিন আগেই কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মান্তরণ নিয়ে চারদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। এদিকে অন্য উপায়ও তো নেই। তাই আর দ্বিতীয়বার না ভেবে, ঠিক করে নিলেন ছেলেকে ভর্তি করবেন ডফ সাহেবের স্কুলেই। নিষ্ঠাবান হিন্দু বৈষ্ণব পরিবারে এমন সিদ্ধান্তে ঝড় না উঠে পারে? দূরদর্শী পিতা সেসবে আমল দেননি। বলেছিলেন যদি নিয়তিতে লেখা থাকে তবে ভবিষ্যতে ছেলে হয়ত অন্য ধর্ম বেছে নেবে , কিন্তু সেজন্য পুত্রের উচ্চশিক্ষায় দেরি করতে পারবেন না। সেসময়ের নিরিখে এমন সিদ্ধান্ত বৈপ্লবিক বইকি।
ডফ সাহেবের স্কুলে পড়ার ঝক্কি এখানেই শেষ নয়। পিতার অকালমৃত্যুর পর লালবিহারী দেখা করেছিলেন ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে। উপলক্ষ্য, যদি হেয়ার স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় কারণ সেখানকার সেরা ছাত্ররা হিন্দু কলেজে পড়ার সুযোগ পেত। দুঃস্থ ছাত্রদের জন্যে হিন্দু কলেজে একাধিক বৃত্তি চালু ছিল। নির্বিঘ্নে তাহলে উচ্চশিক্ষাটা শেষ করা যায়। একেই বইপত্র চেয়েচিন্তে পড়াশোনা চলে, পুরোনো বই বিক্রেতার থেকে অল্প দামে বাতিল বই কেনেন। কখনও বা একটি বই ফেরত দিয়ে আরেকটি বই নিয়ে আসেন। হেয়ার স্কুলের দোরে পৌঁছলেও ভর্তির টাকা তখনও অপ্রতুল। পিতার মৃত্যুর পর তিনি আরও বেকায়দায়। শুধু মেধার পুঁজি সম্বল করেই হেয়ার সাহেবের কাছে পৌঁছলেন। লাভ হলো না। লালবিহারীর এযাবৎ অধ্যয়ন প্রয়াসে সন্তুষ্ট হলেও হেয়ার বললেন, লালবিহারীর বাইবেল পঠন-পাঠন এবং খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের ফলে তাকে ভর্তি করলে অন্য হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতে পারে। তাই তাদের স্বার্থে হেয়ার স্কুলে লালবিহারীকে জায়গা দিতে পারবেন না। পড়া হলো না হিন্দু কলেজে।
এতকিছু সত্ত্বেও তিনি কোনও রাগ বা বিদ্বেষ পুষে রাখেননি। এমনকি পরে যখন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেন, তখনও কোনো ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। ধর্মাদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেই ধর্ম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাশাপাশি চলেছে অধীত বিদ্যাচর্চার পরিপুষ্টি। একাধিক প্রবন্ধ নিবন্ধে বাংলার শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে গেছেন। এসময় তিনি ফিরে যাচ্ছেন শিকড়ের কাছে। বঙ্গজীবনের ভেতরের সুরটিকে তুলে আনতে চাইছেন। এই প্রবন্ধচর্চার সুবাদেই এলো বিশ্বদরবারে পরিচিত হওয়ার সুযোগ। লেখা হল প্রথম উপন্যাস। ‘গোবিন্দ সামন্ত’। সেটিও এক প্রবন্ধের উত্তরসূরি।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপাড়ার বিদ্যোৎসাহী জমিদার স্বনামধন্য জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় “বাঙলার শ্রমজীবিগণের সামাজিক ও গার্হস্থ্য জীবন” সম্পর্কে বাংলা বা ইংরাজী ভাষায় লেখা সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধের জন্যে ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরের বছর এই বিষয়ের উপর একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিলেন লালবিহারী দে। কিন্তু সেসময় দুইজন পরীক্ষক ইংল্যান্ড পাড়ি দেওয়ায় ফলাফল ঘোষণায় লেগে গেল আরও দুই বছর। ১৮৭৪-র মাঝামাঝি লেখককে প্রতিশ্রুত পুরস্কার প্রদান করা হল। এই প্রবন্ধের সঙ্গেই আরও তিনটি অধ্যায় সংযুক্ত করে লেখাটি ‘গোবিন্দ সামন্ত’ নামে উপন্যাসাকারে প্রকাশিত হয়। ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’র সম্পাদক ডাক্তার জর্জ স্মিথ, হাইকোর্টের তদানীন্তন অন্যতম বিচারপতি মাননীয় জে.বি. ফিয়ার এবং সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত আচার্য ই.বি. কাউএল উক্ত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সংশোধন করেন। পরে “Bengal peasant life” নামেও এই বই জনপ্রিয় হয়েছিল। একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বদরবারে সাড়া ফেলে দেওয়া এই বই পড়েই চার্লস ডারউইন লেখককে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখলেন, “I see that the Rev. Lal Behari Day is Editor of the ‘Bengal Magazine’ and I shall be glad if you would tell him, with my compliments, how much pleasure and instruction I derived from reading a few years ago, his novel, Govinda Samanta.” কিছু পরে আরেকটি বইয়ের সুবাদে লালবিহারী দে বাঙালির কাছে বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠবেন। যার নাম, “Folk Tales of Bengal”।
এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, আর দু-বছর পরেই যাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষপূরণ হবে, তাঁকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে পেরেছি কি? সত্যিই কি তাঁকে মনে পড়ে, বাঙালির?
***********************************
গ্রন্থ ঋণ: সেকালের কৃতী বাঙালি, মন্মথনাথ ঘোষ