ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

অন্ধকারের বন্ধু, অন্ধকারের শত্রু : দ্য এলিয়েনিস্ট (সিজন ২)

সৃজিতা সান্যাল Nov 13, 2020 at 10:45 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ওয়েবসিরিজ : এঞ্জেল অফ ডার্কনেস (দি এলিয়েনিস্ট: সিজন ২)
পরিচালনা: ডেভিড ক্যাফ্রে, ক্লেয়ার কিলনার প্রমুখ
কাহিনি: ক্যালেব কার
অভিনয়: ড্যানিয়েল ব্রুল, লিউক ইভান্স, ডেকোটা ফ্যানিং, ডগলাস স্মিথ, ম্যাথ্যু শিয়ার, রোজি ম্যাকইউয়েন প্রমুখ

রাত্রি গভীর হলে চেনা শহরের রাস্তাও কেমন মায়াবী হয়ে ওঠে। কোনও অদৃশ্য ম্যাজিশিয়ান যেন বুলিয়ে দেয় জাদুকাঠির ছোঁয়া। ধুলো ধোঁয়া লোকের ভিড়ে ঝাপসা হয়ে থাকা নিউ ইয়র্ক সিটির পথও তাই। রাতপোশাকে অন্যরকম। শুনশান সে রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে মধ্যতিরিশের দুই যুবক-যুবতী। মধ্যতিরিশ, কিংবা হতে পারে তার চেয়ে কিছু কম। অথবা সদ্য কোনও সাফল্যের খুশি আর তৃপ্তির আলো আবছা করে দিয়েছে ওদের বয়েসের রেখা। খুব কাছের বন্ধু ওরা? প্রেমিক-প্রেমিকা? 

এ কৌতূহল আপাতত মুলতুবি রাখলে শুনতে পাবেন, ওদের বাক্‌বিনিময়। ওদের গল্পজুড়ে ছড়িয়ে আছে সবেমাত্র পেরিয়ে আসা অ্যাডভেঞ্চারের কথা। আসন্ন বিশ শতক কী কী বদল আনতে চলেছে সেসব উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথাও। যুবকটি সঙ্গিনীর জন্য ঘোড়ার গাড়ি ডাকতে চাইলে উত্তর পায় “I am perfectly safe, thank you”। পরমুহূর্তেই ‘নারী’ সেজে থাকার যাবতীয় দায় অস্বীকার করে, পাশে-থাকা পুরুষের চোখে একরাশ কৌতুকমাখা বিস্ময় জাগিয়ে মুখে দু-আঙুল পুরে সিটি দেয় মেয়েটি। নিমেষে হাজির হয় ঘোড়ার গাড়ি। 

এদিকে ‘শিভালরি’ দেখানোর রীতির কথা বোধহয় ইচ্ছে করেই ভুলে যায় তার সঙ্গী। অম্লানবদনে মেয়েটির ডাকা ক্যারেজে চেপে বসে সে। হ্যাঁ, একাই। চালককে জানিয়ে দেয় নিজের গন্তব্য। 

জেন্ডার রোলের এতটা দ্রুত পরিবর্তনের জন্য অবশ্য প্রস্তুত ছিল না স্বয়ং মেয়েটিও। হতভম্ব, বিস্মিত সে ঈষৎ ক্ষুব্ধস্বরে চিৎকার করে “John Moore, you just took my cab!!” তারপর পুরোদস্তুর স্পোর্টিং মেজাজে সিটি বাজায়, আরও একবার, দ্বিতীয় গাড়িটি ডেকে নেওয়ার জন্য। জন মুর নিজের ক্যারেজ থেকে তাকায় তার দিকে। সে দৃষ্টিবিনিময়ে প্রেম আর বন্ধুতা ছাড়াও ডানা মেলে আগামী পৃথিবীর অনিঃশেষ স্বপ্ন।   

দর্শকের মনে সময়-সমাজের বদলের পক্ষে এমনই আশার বারুদ জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল এলিয়েনিস্ট-প্রথম সিজনের পেনাল্টিমেট দৃশ্যটি। কিছুদিন হল মুক্তি পেয়েছে এই সিরিজের দ্বিতীয় সিজন ‘Angel of Darkness’। গত সিজনের ছেড়ে আসা সুতোর রেশ রেখে এবার সিরিজের কেন্দ্রবিন্দু সারা হাওয়ার্ড। পুলিশ বিভাগের দাসত্ব থেকে মুক্তি নিয়ে, নিজের দীর্ঘলালিত ইচ্ছেকে পূর্ণ করতে তিনি খুলেছেন তাঁর নিজস্ব ডিটেকটিভ এজেন্সি। কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেছেন চার-পাঁচটি দক্ষ মেয়ের বাহিনীকে। যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থেকেও এবারে তাঁর কাছে যেন কিছুটা ম্লান এ সিরিজের নামভূমিকায় থাকা ড. ক্রাইৎজলার। 

এবার সিরিজ জুড়ে ছায়া ফেলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদী আন্দোলন ও নারীবাদী মননের ঢেউ। ‘Women must be heard.’ – এই বার্তা ছড়িয়ে আছে গোটা সিরিজে। প্রোলগে এক নারীই মুখ্য ভূমিকায়। তেমনি মূল কাহিনির গোড়াতেও ফ্রেমে ধরা পড়ে এক নারীর মুখচ্ছবি। ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় উনিশ শতকের নয়ের দশকে আমেরিকায় তুঙ্গে উঠেছিল ফেমিনিজমের ‘ফার্স্ট ওয়েভ’। মেয়েরা সরব হচ্ছিল রাষ্ট্রচালনায় তাদের ভূমিকা বিষয়ে। উঠছিল মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবিও। উনিশ শতক হোক, কিংবা আজকে, বিবাহ-স্বামী-সন্তান-পরিবারলগ্নতার ‘নারীসুলভ’ norm ভেঙে, নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তাকে সম্বল করে জীবন কাটাতে চাইলে তা যে কোনোদিনই হজম হয়নি ‘সমাজ’ নামক প্রতিষ্ঠানের, আরও একবার তার প্রমাণ দিয়েছে এই সিরিজ। এখানে আমরা দেখব নিজের শর্তে জীবন গড়ে তোলার বিনিময়ে কীভাবে সারার জুটে যায় ‘ম্যান ইন কর্সেট’, ‘স্লিপ অফ আ লেডি’-র তকমা। তার সঙ্গে এও দেখব এসব শ্লেষ হেলায় তুচ্ছ করে কীভাবে মাথা উঁচু রাখেন সারা হাওয়ার্ড। আঘাত বোধহয় সবচেয়ে কঠিন হয় তখন, যখন ‘সমাজ’-এর চিরাচরিত চেহারার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় প্রিয়জনের মুখ। নিজের সবচেয়ে কাছের পুরুষ-বন্ধুটির থেকেও ছিটকে আসে অপমান আর বিদ্রুপ। 

তারপরেও ভেঙে পড়তে জানেন না সারা। ভ্যানডারবিল্টের মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে তদন্তের ডাক পাওয়ার পরে উচ্ছ্বাসের আতিশয্যেও ভেসে যান না তিনি। তিনিই পারেন তদন্তের বিনিময়ে এলিয়েনিস্ট-বন্ধুর বিরুদ্ধে হওয়া অবিচারের সুরাহা দাবি করতে। কাজের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারের মেল ইগো নস্যাৎ করে বলতে পারেন, ‘I am the lead detective in this case. I do not work for Mr. Byrnes. Mr. Byrnes works for me and will follow my directives at all times.’ এই সিরিজের আরও একটি নারী চরিত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসে কাজ করার জন্য জন মুরের অফার ফিরিয়ে দেয়। জানায় ব্রুকলিনের অন্য একটি পত্রিকায় নিজের কাজ করার সিদ্ধান্তের কথা। আর এভাবেই উঁকি দেয় পুরুষ নির্ভরতার ঘেরাটোপ-মুক্ত অর্ধেক আকাশ। 

নারীবাদী প্রসঙ্গ যেমন পিরিয়ড-পিস হিসেবে এই সিরিজকে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছে, তেমনি স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ প্রসঙ্গও স্পষ্ট করে দিয়েছে এর কালপর্বকে। ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে কিউবার হাভানা বন্দরে বিস্ফোরণের ফলে USS Maine নামে একটি আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ডুবে যায়। এইসময় স্পেনের বিরুদ্ধে কিউবার মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। ইয়লো জার্নালিজমের ফলস্বরূপ জাহাজডুবি ও দুশো ছেষট্টিজনের মৃত্যুর জন্য স্পেনের ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করা হয়। বদলা নিতে কিউবার মুক্তিকামীদের পক্ষ নেয় আমেরিকা। স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি থাকে ২৫ এপ্রিল থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। 

স্প্যানিশ গভর্নর জেনারেল লিনোরসের কন্যা অ্যানা নিরুদ্দিষ্ট হলে এই যুদ্ধপ্রসঙ্গ সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দৃশ্যের চমৎকার ডিটেলিঙে সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে উইলিয়াম ম্যাককিনে, জন শার্ম্যান প্রমুখের যুদ্ধসংক্রান্ত ভূমিকাও। এর আগে ড. মার্কোর হাসপাতাল থেকে চুরি গিয়েছিল মার্থা ন্যাপের শিশুকন্যা। অথচ তার জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি মার্কোকে। ক্ষমতাধর মহলের কারসাজিতে মার্থাকেই তার মেয়ের খুনি বলে সাব্যস্ত করা হয়। আদালতের বিচারে তার জন্য বরাদ্দ হয় ইলেকট্রিক চেয়ার। সিরিজ শুরুই হয় মার্থার সুবিচারের জন্য ক্রাইৎজ্‌লার-জন মুর-সারার মিলিত যুদ্ধে পরাজয়ের আখ্যান দিয়ে। ব্যর্থ হয় সমস্ত চেষ্টা। মার্থার মুক্তির দাবিতে আমেরিকান মেয়েদের মিলিত বিক্ষোভকে বিফল করে মৃত্যুদণ্ড নেমে আসে তার ওপর। রাষ্ট্রের পাশবিক বর্বরোচিত আচরণকে তার সমগ্র তীব্রতাসহ তুলে ধরতে মৃত্যুদৃশ্যে কোনও পেলবতার প্রলেপ দিতে চাননি পরিচালক। 

একটি পুতুলের দোকানে আবিষ্কৃত হয় মার্থার মেয়ের মৃতদেহ। পসথিউমাস পোর্ট্রেয়ালের ধাঁচে তার চোখ রং করা। আশ্চর্যজনকভাবে মুখে বিষ ও তার প্রতিষেধক দুইয়েরই অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে সেনোরা লিনোরসের তলব পেয়ে সারা হাওয়ার্ড জানতে পারেন বেবি অ্যানার নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার খবর। শত্রু স্পেনের গভর্নর জেনারেলের মেয়েকে ফিরে পেতে আমেরিকান পুলিশ কোনও উদ্যোগই নেবে না, এই আশঙ্কায় সেনোরা গোপনে তদন্তের দায়িত্ব দিতে চান সারাকে। এই প্রসঙ্গে ড. ক্রাইৎজ্‌লারের সাহায্য নেওয়ার কথা উঠলে মেয়ে-গোয়েন্দার প্রতি ক্লায়েন্টের অনাস্থাটুকু ধরে ফেলেন সারা। জানান, প্রয়োজন হলে এলিয়েনিস্টের সহায়তা তিনি নিশ্চয়ই নেবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন একজন ডিটেকটিভের। পরে অবশ্য অপরাধীকে চিহ্নিত করতে ক্রাইৎজ্‌লারের হিপনোটিজম পদ্ধতি বিশেষ কাজে আসে। এরপর চুরি যায় ভ্যানডারবিল্ট পরিবারের শিশু। সিরিয়াল শিশুচুরির কেসে সক্রিয় হয়ে ওঠে ক্রাইৎজ্‌লার-জন মুর-সারা হাওয়ার্ড ট্রিও। 

এই তিন সহকর্মীর মিলিত কেমিস্ট্রি এই সিজনে আগের থেকেও সাবলীল। ক্রাইৎজ্‌লারের চিকিৎসাকেন্দ্রে একটি ছোট ছেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে মার্কোর ষড়যন্ত্রে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর ইন্সটিটিউট। কেড়ে নেওয়া হয় প্র্যাকটিসের অনুমতি। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন সারা। ক্রাইৎজ্‌লার, সারা হাওয়ার্ড দুজনেরই অনুভূতি প্রকাশে যে শীতলতা গত সিজনে ছিল, খুব ধীরে আর বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবার যেন কিছুটা শিথিল হয়েছে সে প্রাচীর। খাবার টেবিলে ক্রাইৎজ্‌লার বার্গেন্ডি অর্ডার দিলে তীব্র আপত্তি প্রকাশ করে সারা যখন জানান আমেরিকান বার্বানের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বের কথা, তখন দুটি চরিত্রেই জেন্ডার ফ্লুইডিটি বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়। 

মুখ্য তিন চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিণতিও এ সিরিজে লক্ষণীয়। লুসিয়াস আর মার্কাস আইজ্যাকসনকে নিয়ে পাঁচজনের এক্সটেন্ডেড টিম অবশ্য বড়সড় ধাক্কা খাবে এ সিজনে। স্পয়লার এড়াতে কারণটুকু নাহয় উহ্য রইল। 

সিনেমাটোগ্রাফি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আগের সিজনের টেকনিকই বজায় রাখা হয়েছে এইবারেও। সমস্ত সিজন ধরে জন মুর এবং সারার সম্পর্কগত টানাপোড়েনকে মাঝে মাঝে বেশি প্রলম্বিত লাগে। জন এবং সারার শরীরী সম্পর্ককেও তাদের চরিত্রবিরোধী এবং বেশ আকস্মিক বলেই মনে হয়। সন্দেহ হয়, বুঝি টি আর পি বাড়ানোর এ দৃশ্যের আয়োজন। অবশ্য, তাদের ব্যক্তিগত দোলাচল নিউ ইয়র্কের অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া অন্ধকারময়-রুদ্ধশ্বাস-দ্রুতগতি ঘটনাক্রমের মাঝে দৃশ্যগত রিলিফ হিসেবে কাজ করেছে, তা অনস্বীকার্য।  

শেষে যে কথা না বললে, এই সিজনের আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, তা হল অপরাধী ও গোয়েন্দার অন্তর্লীন যোগের প্রসঙ্গ। গোয়েন্দাকাহিনিতে এই থিম যদিও খুব নতুন কিছু নয়। গত সিজনে একই প্রসঙ্গকে ভিন্ন চেহারায় দেখা গিয়েছিল ক্রাইৎজ্‌লারের অপরাধীমন বোঝার চেষ্টায়। এবারে সারার মনে হয়, পরিস্থিতি প্রতিকূল না হলে অপরাধিনী হয়তো বা তার বন্ধু হতে পারত। দৃঢ় অনমনীয় সারা হাওয়ার্ড, উপর্যুপরি আঘাতে নত না হওয়া সারা হাওয়ার্ড, বাবাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে তাঁর আত্মহত্যায় সাহায্য করা সারা হাওয়ার্ড, অশ্রুকে কখনও চোখের কিনার ছাপাতে না দেওয়া সারা হাওয়ার্ডের চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে অপরাধীর সামনে, বন্দুকের ট্রিগার টিপে থাকা অবস্থাতেই। 

লিবি হ্যাচের ভূমিকায় রোজি ম্যাকইউয়েনের অভিনয় এবারে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সারার ভূমিকায় ডেকোটা আর লিবির চরিত্রে রোজি দুজনেই এবারে অভিনয় করেছেন পাল্লা দিয়ে। তাঁদের প্রতিস্পর্ধী অভিনয়ের দৌলতে জমে গেছে এবারের সিজন। গতবারের তুলনায় এবারের সিজন আরও সংক্ষিপ্ত, সংহত, টানটান। মনস্তাত্ত্বিক গল্পের শিহরণ আর ক্রাইম থ্রিলারের উত্তেজনা এ দুইয়েরই যথেষ্ট রসদ এতে পাওয়া যাবে, সন্দেহ নেই।       

   

 

#TV series # period drama #Caleb Carr #Daniel Brühl # Luke Evans # Dakota Fanning #রিভিউ #ওয়েব সিরিজ #Review #সৃজিতা সান্যাল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

62

Unique Visitors

214940