নিবন্ধ

সৌন্দর্যচেতনা ও মৃত্যুচেতনার আঁধারসেতু: এডগার অ্যালান পো-র ‘দ্য র‍্যাভেন’

রাজর্ষি গুপ্ত Jan 29, 2021 at 4:58 am নিবন্ধ

পো-র ‘দ্য র‍্যাভেন’ রেলগাড়ির ইঞ্জিন যদি হয় দাঁড়কাক, তবে তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া বাষ্প যে কবিতার কথক শোকাচ্ছন্ন প্রেমিক, তাতে সন্দেহ নেই। সেই বাষ্পের উদ্ভব তার মনের মধ্যের কয়লাকালো গলিঘুঁজির গোলকধাঁধা থেকে। মনোবিকলন, উন্মাদরোগ পো-র কাহিনিতে ফিরে ফিরে আসে। অনেক সময় গল্পের প্রধান চরিত্রেরা— সে চরিত্র অনেক ক্ষেত্রে গল্পের কথক নিজেই— যেসব কাজকর্ম করে বসে যাকে ঠিক মানসিক সুস্থতার পরিচায়ক বলা চলে না (‘দ্য প্রিম্যাচিওর বারিয়াল’, ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’, ‘দ্য টেল-টেল হার্ট’, ‘উইলিয়ম উইলসন’ দ্রষ্টব্য)। এমনিতে আদ্যন্ত ছাপোষা মানুষগুলোর মধ্যে এইরকম ‘পাগলামি’-র স্ফুলিঙ্গ দেখে পাঠক আকৃষ্ট হন, মুগ্ধ হন, এবং আতঙ্কগ্রস্তও হয়ে পড়েন— সেইখানেই তো ‘হরর লেখক’ পো-র জিত, সেইজন্যই তো তাঁর গল্পগুলো কাল্ট ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু পো যে নিপুণ হাতে ‘প্রকৃতিস্থ’ মনের আস্তে আস্তে ‘অপ্রকৃতিস্থতা’-য় ঢলে পড়ার ছবি আঁকেন, যাতে মানসিক সুস্থতা-অসুস্থতার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে গিয়ে পাঠকের মনে ধন্দ লাগে, সেইখানে শিল্পী পো-র জয়। তাঁর কাহিনিতে ভয়ের আসল উদ্রেক আমাদের প্রত্যেকের অন্তঃশায়ী সেই মনের অন্ধকারের— যাকে স্থিতিশীল মানবজীবন ভয় পেয়ে ‘পাগলামি’ বলে ডাকে— তার শৈল্পিক উপস্থাপনা থেকে। ভূত-প্রেত-অলৌকিক আনুষঙ্গিক মাত্র। আমাদের দাঁড়কাক-প্রেমিকও তার ব্যতিক্রম নয়।

শোকে মুহ্যমান প্রেমিকটি খুব ভালো করেই জানে যে “Nevermore” শব্দটা দাঁড়কাকটির মুখস্থবিদ্যার ফল এবং ওই একটিই শব্দ সে জানে, ফলে তাকে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন তার উত্তর চরমভাবে নঞর্থকই হবে। অর্থাৎ ওই বিশেষ প্রশ্নগুলো দাঁড়কাককে করার সময়ই তার অবচেতন মন জানে যে নেতিবাচক উত্তরই পেয়ে পেয়ে শোকের সমুদ্রে ডুবতে চলেছে সে, তাও সে ঠিক সেটাই করে। এ কি নিছক দুঃখবিলাসের চরম? নাকি তা ছাপিয়ে গিয়ে একপ্রকার মৃত্যুবিলাস— যে মৃত্যু কাছের মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে সেই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করার তীব্র ইচ্ছা? শুধু তাই হলে তো মানসিক সুস্থতার প্রসঙ্গ উঠত না, মৃত্যুর ইচ্ছা তো চরম বৈরাগ্যেও হতে পারে। শোকে অভিভূত কথক যন্ত্রণা পেয়ে— বলা ভালো নিজেকে যন্ত্রণা দিয়ে— মরতে চায়। এর মধ্যে পরিচয় পাওয়া যায় তীব্র মর্ষকামের আর এইখানেই ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর কথকের মধ্যে মানসিক বিকারের লক্ষণ ফুটে উঠে সে ক্লাসিকাল পো-নায়কে পরিণত হয়। তার নরকযন্ত্রণার জল্লাদ সে নিজেই। লেনোরের প্রতি ভালোবাসার খোলকে মৃত্যুশোক দিয়ে ভরে তুলতে তুলতে তার কাছে নিজের অজান্তেই যন্ত্রণা-হতাশা-মৃত্যু এক ‘অবসেশন’ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ‘অবসেশন’, ঘোর, আচ্ছন্নতা মূলত শৌখিন— কথকের চেতন মন কিন্তু তা চায় না। এই যন্ত্রণাময় শোকবিলাসই রহস্যময় দাঁড়কাকের রূপ ধরে তার চোখের সামনে হাজির হয়। মনস্তাত্ত্বিক আলোচকের কাছে তাই দাঁড়কাক প্রেমিকের দৃষ্টিবিভ্রম, কিংবা মনুষ্যেতর পাখির মধ্যে অতিলৌকিক মহাজ্ঞানীকে দেখা মানসিক রোগের লক্ষণ। আবার মরালিস্টের কাছে এই দাঁড়কাকই মনের সেই কুপ্রবৃত্তিগুলির মূর্ত রূপ, যেগুলি মানুষকে ঠেলে দেয় বিপথে, নিজেকে ধ্বংসের রাস্তায়— যেগুলির প্রতিনিধিত্ব করে বৌদ্ধধর্মের মার কিংবা ক্রিশ্চানিটির শয়তান। পো সেই শয়তানের ছায়াই দেখেছিলেন এই দাঁড়কাকের মধ্যে, তাই তাঁর কথক দাঁড়কাককে “bird or fiend” বলে সম্বোধন করে হঠকারী ফাউস্টের মতো মুক্তি পেতে চায় তার হাত থেকে, নিজের কৃতকর্মের হাত থেকে— “Take thy beak from out my heart, and take thy form from off my door!” আসলে আচ্ছন্নতার চাদর সরে গেলেই শোকবিলাসী মন মৃত্যুর নরকযন্ত্রণা অনুভব করে— করতেই থাকে— কিন্তু তখন আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এইখানেই শিল্পী হিসেবে পো-র আবারও জিত। লক্ষণীয়, পো-র বিরহী প্রেমিক-কথকটি নামহীন। নামহীন বলেই সে প্রতিটি পাঠক, প্রত্যেক সাধারণ মানুষ— যাকে অবসাদের দীর্ঘ কালো ছায়া গ্রাস করেছে এবং করতে পারে— তাদের প্রতীক।

এবং কতকটা পো-র নিজের মুখপাত্রও বটে। ‘দ্য র‍্যাভেন’-কে আত্মজৈবনিক বলে চিহ্নিত করলে খুব ভুল বোধহয় হয় না। পো-র প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ভার্জিনিয়া ১৮৪২ থেকে যক্ষ্মায় শয্যাশায়ী ছিলেন, ১৮৪৭-এর ৩০শে জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। ১৮৪৪-এ এই কবিতা লেখার সময় পো একপ্রকার তাঁর বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছেন। আসন্ন প্রিয়বিচ্ছেদের বেদনা তাঁর অনেক কবিতাতেই স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে (‘লেনোর’, ‘উলালুমে’), ‘দ্য র‍্যাভেন’ সেগুলিরই একটি। আর সুন্দরী নারীর মৃত্যু তো তাঁর কাহিনিজগতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘দ্য ফিলজফি অফ কম্পোজিশন’ প্রবন্ধে পো ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর পিছনে তাঁর কাব্যতত্ত্ব খাড়া করার সময় স্পষ্ট বলছেন, কাব্যের বিষয় হওয়া চাই ‘সৌন্দর্য’ আর তার সুর বিষণ্ণ, কারণ একমাত্র সৌন্দর্যই আত্মাকে মথিত করে অশ্রু ডেকে আনে। এই দুই মিলিয়ে ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর জন্য এক সুন্দরী নারীর অকালমৃত্যুর মতো ‘পারফেক্ট’ বিষয়বস্তু আর তিনি খুঁজে পাননি— “the death, then, of a beautiful woman is, unquestionably, the most poetical topic in the world— and equally is it beyond doubt that the lips best suited for such topic are those of a bereaved lover.” বিষয়বস্তু বেছে নেওয়াই শুধু নয়, তাকে শোকবিহ্বল প্রেমিকের মুখ দিয়ে উপস্থাপন করার মধ্যেও পো-র যে পরিচয় বেরিয়ে আসে তা শুধু হরর সাহিত্যিকের কিংবা কবির নয়— তা এক আদ্যন্ত সংবেদনশীল রোমান্টিকের। কিন্তু সেই রোমান্টিসিজমও প্রকৃতিপ্রেম-মানবতা-আধ্যাত্মিকতা-বিপ্লব ইত্যাদির ধ্বজাধারী মূলধারার রোমান্টিসিজম নয়, যার সঙ্গে ওয়র্ডসওয়র্থ, শেলি, কিটস এই নামগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁরা সাব্লাইমের অত্যুজ্জ্বল আলো দেখে বিস্ময়বিমূঢ় হন, উদার সর্বেশ্বরবাদের প্রচার করেন কাব্যে। তারই উলটো পিঠে যে ভয়-কৌতূহল জাগানো কালো রহস্যময় জগৎটা আছে তাই নিয়েই কারবার ‘ডার্ক রোমান্টিসিজম’-এর— এডগার অ্যালান পো-র। পো-র সবচেয়ে প্রিয় রোমান্টিক কবি যে কোলরিজ হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী? তাঁর ‘দ্য রাইম অফ দি এনশেন্ট মেরিনার’ কিংবা ‘ক্রিস্টাবেল’-এও তো কল্পনার ডানায় ভর করে সেই আঁধার রহস্যরাজ্যে পাড়ি জমান লেখক-পাঠক। মূলধারার রোমান্টিসিজমে আত্মাকে আধ্যাত্মিক উচ্চতার চরমে নিয়ে যাওয়া প্রেম তাই এখানে আত্মাকে টেনে নিয়ে যায় হতাশার অতল গহ্বরে। এখানে শেলির স্কাইলার্ক প্রাণে উৎসাহ জাগিয়ে স্বর্গ-মর্ত ছুটোছুটি করে বেড়ায় না, কিটসের নাইটিঙ্গেল অমরত্বের গান গায় না, কেবল ত্রিকালজ্ঞ দাঁড়কাক অশুভ গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দেয় মৃত্যুই শেষ কথা— তারপর “Nevermore”। 

কিন্তু তাও প্রেম কি মরে? মরলে যে রোমান্টিসিজমের শর্ত ভেঙে যায়। প্রেমকে হারিয়ে মৃত্যুর চূড়ান্ত পরিণতি মেনে নিতে পারে না বলেই তো পো-র প্রেমিক মৃত্যুবিলাসী হয়েও রোমান্টিক— তাঁর মতোই। আর এইখানেই ১৭৬ বছর পরও পো-র ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর তুমুল চর্চা আর জনপ্রিয়তার কেন্দ্রে থাকার রহস্যের চাবিকাঠি।

আরও পড়ুন : একটি দাঁড়কাক ও মৃত্যুবিলাসীর অমরত্বের কাব্য: এডগার অ্যালান পো-র ‘দ্য র‍্যাভেন’/ রাজর্ষি গুপ্ত

১৮৪৫-এ প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বহু প্যারোডি হয়েছে ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর। ডিকেন্সকে ভাঙিয়ে জনপ্রিয় হতে চাইছেন এমন ইঙ্গিত করে ব্যঙ্গকবিতা লিখেছিলেন পো-র সমসাময়িক জেমস রাসেল লোয়েল। এ কবিতা চুরির অভিযোগও উঠেছে পো-র বিরুদ্ধে। সমসাময়িক রালফ ওয়াল্ডো এমার্সনের মতো সাহিত্যিক এর মধ্যে কিস্যুই খুঁজে পাননি। এলিয়টের মতো তাবড় কবি-সমালোচক ‘দ্য ফিলজফি অফ কম্পোজিশন’ পড়ে স্বভাবসিদ্ধ উন্নাসিকতার সঙ্গেই বলেছিলেন, কবিতাটা পড়ে তো মনে হয় না অত কষ্ট করে মেপেজুকে লেখা। এত শত অভিযোগ পেরিয়েও পো-র দাঁড়কাক আর শোকাতুর প্রেমিক আজ অমর। পল গগ্যাঁ তাঁর শোকের ছবি ‘নেভারমোর’-এও স্মরণ করেন পো-র দাঁড়কাককে। আজও পো-চর্চার নতুন নতুন দিক খুলে দেয় এই কবিতা।

শেষ করি একটা অদ্ভুত সমাপতনের গল্প বলে। ১৮৪১-এ ডিকেন্সের পোষা দাঁড়কাক গ্রিপ মারা গেলে তার দেহকে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সেই স্টাফ করা দাঁড়কাকের দেহ বহু হাত ঘুরে এসে পড়ে পো-সংগ্রাহক রিচার্ড গিম্বেলের হাতে। ১৯৭১ সালে তিনি পো-সংক্রান্ত অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে সেই দাঁড়কাকটি দান করেন ফিলাডেলফিয়া ফ্রি লাইব্রেরিতে। মজার কথা হল, পো-র নিজের হাতে লেখা ‘দ্য র‍্যাভেন’-এর একমাত্র পাণ্ডুলিপিটিও রয়েছে এই ফিলাডেলফিয়া ফ্রি লাইব্রেরির পো-সংগ্রহেই।

মৃত্যুবিলাসের মতো ‘বিকার’-ও যে সংবেদনশীল শিল্পীমনের স্বর্ণস্পর্শ পেলে অমরত্ব অর্জন করে, তার প্রমাণ আজও দিয়ে চলেছে এবং দিয়েই চলবে পো-র ‘দ্য র‍্যাভেন’— আজ থেকে ঠিক ১৭৬ বছর আগে (২৯ জানুয়ারি, ১৮৪৫) নিউ ইয়র্ক ইভনিং মিরর-এর পাতায় জনসমক্ষে আসা সেই আঁধারময় জাদুকবিতা।


সহায়ক পাঠ:

Kennedy, J. Gerald. The Portable Edgar Allan Poe. Penguin Books, 2006.

Adams, John F. "Classical Raven Lore and Poe's Raven". Poe Studies. Vol. V, no. 2, December 1972.

Granger, Byrd Howell. "Marginalia – Devil Lore in 'The Raven'". Poe Studies. Vol. V, no. 2, December 1972.

Hayes, Kevin J. Ed. Edgar Allan Poe in Context. Cambridge University Press, 2013.

Hirsch, David H. “The Raven and the Nightingale”. Poe and His Times: The Artist and His Milieu. Ed. Benjamin Franklin Fisher IV. The Edgar Allan Poe Society, Inc., 1990.

ফিলাডেলফিয়া ফ্রি লাইব্রেরির ওয়েবসাইট https://libwww.freelibrary.org/blog/post/2773

#The Raven #Edgar Allan Poe #narrative poem #poem #supernatural #Nevermore #folk #এডগার অ্যালান পো #রাজর্ষি গুপ্ত #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

219135