পরিবেশ ও প্রাণচক্র

কম খরচে ব্যাটারি বানাবে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া

সায়নদীপ গুপ্ত June 22, 2022 at 4:36 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির বাজারে কান পাতলে একটা কথা খুব শুনতে পাওয়া যায়, ইন্টারনেট অফ থিংস, অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত একাধিক ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবিরত তথ্য আদান-প্রদান করে চলেছে। আপনার হাতের স্মার্ট-ওয়াচ, তার সঙ্গে যুক্ত মোবাইল ফোন, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ব্লুটুথ হেডসেট – সব মিলিয়ে ওই ইন্টারনেট অফ থিংস। বুঝতেই পারছেন, জীবনযাত্রার অগ্রগতির সঙ্গে প্রযুক্তির এই ধারা পাল্লা দিয়ে ঢেউ তুলবে, আর সেই সঙ্গে বাড়বে উপযুক্ত শক্তির চাহিদা। এতরকম যন্ত্র সমন্বিত একটা নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখার জন্য চাই নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির উত্তরোত্তর জোগান। প্রচলিত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হতে পারে না; হিসেবমতে ২০৩৫ সাল নাগাদ ইন্টারনেট অফ থিংসের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে প্রায় একলক্ষ কোটি ক্ষুদ্র যন্ত্র। অথচ পৃথিবীর মোট লিথিয়াম উৎপাদনের পরিমাণ এর তিনভাগের একভাগ।

ই জায়গাতেই sustainable technology বা চিরস্থায়ী প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সেই কাজে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রকারের অণুজীব, বিশেষত ব্যাকটেরিয়া মারফত বৈদ্যুতিক বা রাসায়নিক শক্তি উৎপাদনের একটা অপ্রচলিত ধারা নিয়ে কাজ চলছিল বহুদিনই, সাম্প্রতিক গবেষণা সেই কাজে এক অদ্ভুত সাফল্যের নজির তৈরি করেছে। প্রোফেসর ক্রিস্টোফার হো আর তাঁর সহযোগীরা মিলে প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে সাধারণ ব্যাটারির মাপেই একটা আধার বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেই খাঁচার মধ্যে তাঁরা পুরে দিলেন সাইনিকোসিস্টিস (Synechocystis sp.) জাতের এক সায়ানোব্যাকটেরিয়া, স্কুলের জীবনবিজ্ঞানের বইতে যাদের আমরা “নীলচে সবুজ শৈবাল” বলে চিনতাম। এরা বাকি ব্যাকটেরিয়াদের থেকে একটু দলছুট। বাকিরা যেখানে বাইরের খাবারের উপর নির্ভরশীল, এরা সেখানে গাছদের মতোই সালোকসংশ্লেষ করে খাবার তৈরি করে নেয়। জলের মধ্যে আড়েবহরে বেড়ে উঠতেও খুব একটা সময় নেয় না। তাই প্লাস্টিকের খাঁচায় সে দিব্যি রইল। সেই খাঁচায় লাগানো অ্যালুমিনিয়ামের ইলেকট্রোড সোজা গিয়ে জুড়েছিল এক প্রাইভেট কোম্পানির মাইক্রোপ্রসেসরের সঙ্গে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অগস্ট – লকডাউনের এই মাসছয়েক গোটা ব্যবস্থাটা অন্যতম গবেষক পাওলো বমবেলির বাড়ির জানলায় রাখা ছিল, পরিবেশের আলো-হাওয়া-তাপমাত্রার ওঠানামা সয়ে। আর তখনই দেখা গেল এক অদ্ভুত ঘটনা – ব্যাকটেরিয়ার সালোকসংশ্লেষের ফলে উৎপন্ন ইলেকট্রন, ইলেকট্রোড দ্বারা বাহিত হয়ে মাইক্রোপ্রসেসরকে একটানা বিদ্যুতের জোগান দিয়ে চলেছে। একদিন-দুদিন না, টানা ছয়মাস!
লাগোয়া কম্পিউটারে প্রতিদিন ৪৫ মিনিটের গণনার কাজ চলত, মূলত পূর্ণসংখ্যা (integer) নিয়ে নানা রকম যোগ-বিয়োগ আর প্রসেসরের নিজস্ব কাজকর্মের একটা সিমুলেশন করা হত সেখানে। তারপর ১৫ মিনিটের বিরতির পর আবার সেই একই রুটিন। এইভাবে একঘন্টা চলতে প্রসেসরের মোট চাহিদা ছিল ০.৫-০.৬ মাইক্রোওয়াট্‌স। গোটা দিনের কারেন্ট আউটপুটের পুরো হিসেব এই কম্পিউটার নিজেই কষত এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাউড স্টোরেজে সঞ্চিত রাখত। ছয়মাসের মধ্যে একবারও ব্যাকটেরিয়াদের নতুন করে খাবার দেওয়া বা নতুন প্রজন্মের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পুনঃস্থাপন করার দরকার পড়েনি। সালোকসংশ্লেষের ফলে যে জীবকোশে ইলেকট্রন তৈরি হয়, এটা জৈবরসায়নের প্রতিষ্ঠিত তথ্য। ব্যাকটেরিয়া জাতীয় জীবের কোশে এই বিক্রিয়ার হার যে বহুকোশী উদ্ভিদের তুলনায় অনেক বেশি, সেও জানা কথা। কিন্তু তার থেকে যে সরাসরি একটা মাইক্রোপ্রসেসর চালাতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন ভাণ্ডার গড়ে তোলা যাবে, এমনটা আগে করার কথা ভাবা যায়নি। শুধু যে দিনের আলোয় সালোকসংশ্লেষ চলাকালীনই বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে তা নয়, রাতের অন্ধকারেও কোনও ঘাটতি হচ্ছে না। সেই সময়ে সায়ানোব্যাকটেরিয়া তার নিজের তৈরি উদ্বৃত্ত খাদ্য ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রন জুগিয়ে গেছে। বলে রাখা ভালো, গবেষণায় ব্যবহৃত প্রসেসরটি Arm Cortex M0+ গোত্রের, ছোটখাটো বৈদ্যুতিন যন্ত্রগুলি বানাতে এই প্রসেসরই ব্যবহার করা হয়।
এখনই যে এই আবিষ্কারকে বাড়ির ছাদে বসিয়ে ওয়াশিং মেশিন চালানো যাবে না, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। সেদিন আসতে এখনও অনেক পথচলা বাকি। কিন্তু অনুন্নত দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম, যেখানে বিদ্যুতের সামান্য ঝলকটুকুও পৌঁছনো যায়নি আজও, সেখানে এই প্রযুক্তির ব্যবহার রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। গ্রামীণ জীবনধারাকে ইন্টারনেট অফ থিংসের আওতায় আনতে পারলে প্রশাসনিক কাজকর্ম থেকে স্বাস্থ্য-শিক্ষার উন্নততর পরিষেবা সবকিছুই আরও সহজ এবং জনমুখী করে তোলা যাবে। উপরন্তু, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির বিকল্প হিসবেও এই আবিষ্কার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটারির মতো শক্তির সঞ্চয়ী আধার হিসেবে নয়, সায়ানোব্যাকটেরিয়া চালিত এই ফোটোইলেকট্রিক কোশ কাজ করবে শক্তির নিরবিচ্ছিন্ন উৎস হিসেবে। ক্রমবর্ধমান ইলেকট্রনিক বর্জ্যের জোয়ারে রাশ টানতে এই ধরনের পুনর্নবীকরণযোগ্য জৈব বিদ্যুতের ব্যবহার আমাদের নীল গ্রহটাকেই আরও একটু ভালো রাখবে।

তথ্যসূত্র: Powering a microprocessor by photosynthesis. Energy & Environmental Science, 2022

#সায়ানোব্যাক্টেরিয়া #ব্যাটারি #পরিবেশ ও প্রাণচক্র #সিলি পয়েন্ট #সায়নদীপ গুপ্ত #Cyanobacteria #sustainable technology #Christopher Hood #Synechocystis

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

64

Unique Visitors

215850