উচ্চশিক্ষার সংস্কৃতি ও জাতীয় শিক্ষানীতি : ব্রাত্য কি পড়ুয়াই?
এই নিবন্ধের মুখ্য আলোচ্য বিষয় নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি, তার নিয়মগত খুঁটিনাটি, সিস্টেমের জটিল গঠনগত বৈশিষ্ট্য এবং তৎসংক্রান্ত বিশ্লেষণ অথবা বিবরণ নয়। যে সমস্ত মানুষের চিন্তাভাবনা এই কাঠামো, তার নীতি নির্ধারণ ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে, তাঁদের সমালোচনা বা যোগ্যতামান নিয়ে প্রশ্ন করাও আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সত্যিই নয়। তাঁরা স্বীয় দক্ষতা ও যোগ্যতায় জাতীয় স্তরে নীতি নির্ধারণের দায়িত্বে রয়েছেন, আমি এমনকি এটা ধরে নিতেও রাজি যে তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ, তাঁরা একটা ভালো কিছু করতে চাইছেন; কিন্তু সেই মহদুদ্দেশ্য ঠিক কতখানি বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব বা হতে পারে? জীবনের একটা দীর্ঘ সময় ধরে গ্রামীণ, প্রান্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজকর্ম করার সুবাদে আমার কাছে মুখ্য বিচার্য হল তারা, যাদের জন্য এত কিছু, যে-কোনো নীতি প্রণয়ন আসলে যাদের জন্য করা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে এই 'লুপ' যেখানে শেষ হয়, অর্থাৎ, সাধারণ ছাত্রছাত্রী। তাদের জন্যই এত কিছু, কিন্তু আসলে তারা কতখানি উপকৃত হল? যেমনটি কিনা আমরা সবাই জানি, যাদের 'নামে' কোনও নীতি নির্ধারণ হয়, আখেরে তাদের কতটুকু উপকার হল, একমাত্র ওই বিষয়টুকু বাদ দিয়ে, বাকি সব মাপকাঠি দিয়ে সেই নীতির সাফল্য বিচার হয় এই দেশে। এটাই বাস্তব।
ওপেনহাইমার মোমেন্ট বলে একটা শব্দবন্ধ আছে। যারা বিষয়টা নিয়ে জানতে উৎসুক, গুগল করে দেখবেন বিষয়টা, বোঝার দরকার আছে।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমরা আসলে একটা ওপেনহাইমার মোমেন্টের মধ্যে দিয়ে চলেছি। আমার তো মনে হয় সেই আঠেরো সাল থেকেই চলেছি, যে বছর ২+১ সিস্টেম ছেঁটে ফেলে সেমিস্টার সিস্টেম চালু করা হল সব জায়গায়, তখন থেকেই এটা চলছে। আঠেরোতে যখন হুড়মুড় করে CBCS চালু হল, তখন গোটা বিষয়টা অধিকাংশ ফ্যাকাল্টির কাছেই একটা দুরধিগম্য ব্যাপার, ছেলেমেয়েদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তারপর কোভিড ব্রেক চলে এল- তিনটে ব্যাচ যার জন্য সাফার করেছে, কিছু না বুঝেই স্রেফ ইনস্ট্রাকশনস ফলো করে গেছে। যে দুটো ব্যাচ 'পাশ' করে বেরিয়ে গেছে CBCS সিস্টেম থেকে, তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছেলেমেয়েরই বিন্দুমাত্র ধারণা রয়েছে সিস্টেম, তার ক্রেডিট স্ট্রাকচার, এমনকি নিজের স্কোরকার্ড নিয়ে। বিপুল পরিমাণ ছেলেমেয়েরা ভিড় করে থাকে অফিসের বাইরে শুধু এইটে ভালোভাবে বোঝার জন্য যে তাদের আদতে কোন কোন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। অনেকেই পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে 'আবিষ্কার' করে তার বিষয়, অনেকেই আবার সপ্তাহখানেক আগে বুঝতে পারে যে তারা ভুল বিষয় এতদিন পড়ে এসেছে। সিস্টেমের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন সবাই এসব সমস্যার কথা জানেন। এসবের মুখ্য কারণ হল এমন একটা জটিলকুটিল কোর্স এবং ক্রেডিট স্ট্রাকচার, যা কিনা পড়া যায় না, ডিসাইফার করতে হয়, এবং তার বোধগম্য হওয়া না-হওয়া নিয়ে চমৎকার একটা স্ট্যানফোর্ড মডেলের আইকিউ টেস্ট ডিজাইন করা যেতে পারে। আমারই অনেক যোগ্য ও বিজ্ঞতর সহকর্মী রয়েছেন যাদের কাছে এগুলো আদৌ কোনও চ্যালেঞ্জ নয়, কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা, যাদের বোধবুদ্ধি আমারই স্তরের, তাদের কাছে গোটা বিষয়টা ঠিক কতটা বিভ্রান্তিকর, তা নিজেকে দিয়েই দিব্য বুঝতে পারি।
তো, এমতাবস্থায়, যখন সবেমাত্র অধ্যাপক তথা শিক্ষাকর্মীরা CBCS সিস্টেমটাকে মোটামুটি আয়ত্ত করার জায়গায় সবে এসেছিলেন, পুরো নতুন একটা সিলেবাস নিয়ে পড়াশোনা, ধারণা নির্মাণ করা সবে শেষ করলেন, এমন সময় খপাং করে আর একটা সম্পূর্ণ নতুন সিস্টেম - ক্রেডিট স্ট্রাকচার – সিলেবাস হঠাৎ করে চলে এল। এ যেন একটা মজার খেলা হচ্ছে, the game of catch-up, যেখানে গিনিপিগ অবশ্যই সিস্টেমের সঙ্গে জড়িত সবাই, কিন্তু আসল সাফারার বিশেষত ছেলেমেয়েরা। এমতাবস্থায়, যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় রাজ্য সরকার NEP মেনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে দিল, তা, সত্যি কথা বলতে কি, বেশ খানিকটা অস্বস্তিকর। সামান্যতম বিষয়েও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যাওয়া রাজ্য সরকার গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এবং কাঠামোর খোলনলচে পালটে-ফেলা একটা সিস্টেমিক পরিবর্তন নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না, চুপচাপ ইমপ্লিমেন্টেশনের দিকে গেল কয়েকটা নির্দোষ অনুজ্ঞা জারি করে- এ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় শিক্ষা এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়গুলিকে রাজ্য ঠিক কতটুকু গুরুত্ব দেয়। দেওয়ার দরকারটাই বা কী; এ থেকে তো আর নির্বাচনী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না! যাই হোক।
এখন, যে-কোনো নতুন জিনিস এলেই সাধারণ প্রতিক্রিয়া হয় সেটাকে (পোটেনশিয়ালি) সমস্যাজনক বলে দাগিয়ে দেওয়া বা সেটার সম্পর্কে একটা সাবধানী, guarded মনোভাব নিয়ে নেওয়া। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রচুর মানুষ এর মধ্যে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখতে পান বা পেয়েছেন, সেটাও অস্বাভাবিক নয়, বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে। কাজেই, NEP-র মতো একটা দীর্ঘ, টেকনিক্যাল ডকুমেন্ট বিস্তারিত বা আদৌ না পড়েই, এবং এটার বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে উপলব্ধ সারাংশ পাঠ করেই অধিকাংশ মানুষ এই বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করে ফেলবেন, এবং তার পক্ষে-বিপক্ষে তর্কবিতর্ক চলবে। খুবই স্বাভাবিক। তবে কিনা, রাজ্যে উচ্চশিক্ষা এবং তার পরিকাঠামোগত বাস্তবতার সঙ্গে সামান্য পরিচিত একজন হিসেবে কয়েকটা কথা বলি।
এক, আঠেরোর যথেষ্ট-জটিল সিস্টেমটা ঠিক আরও কত জটিলকুটিল হয়ে উঠবে আটখানা সেমিস্টার এলে, তা কল্পনাই করা যায়। অধিকাংশ কলেজ (পড়ুন নব্বই শতাংশের বেশি) শেষ দুটো সেম পড়ানোর পরিস্থিতিতে নেই, কারণ রিসার্চ-ডিসার্টেশন কেন্দ্রিক পাঠ্যক্রম সন্তোষজনকভাবে পড়াতে বা ‘কভার’ করতে গেলে যে ফ্যাকাল্টি এবং মেকানিজম থাকা দরকার, তার কিছুই নেই। বিজ্ঞান বিভাগে তো, ভাবাই যায় না।
দুই, অনার্স এমনিতেই আজকাল ছেলেমেয়েরা সিরিয়াসলি নেয় না। হাজিরার হিসেবের ভয় দেখিয়ে কলেজমুখো করতে হয়, অভিভাবকদের নিয়মিত মিটিংয়ে ডেকে তাঁদের বোঝাতে হয়, অনুরোধ করতে হয়, অন্তত আমরা তো এটা খুব সিরিয়াসলি করি; কম্প্রিহেনসিভ পড়াশোনার সংস্কৃতি লাটে উঠেছে; এমতাবস্থায় যখন-তখন কোর্সে ঢোকা এবং বেরোনো যাবে- এই স্বাধীনতা দেওয়া হলে... আমি ঠিক ভাবতেও পারছি না বিষয়টা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। শুধু ইংরেজিতে প্রথম দুই সেমিস্টারে যা পাঠ্যক্রম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে, তাতে ঘোরতর হতাশ বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। একটা খাপছাড়া, ল্যাজামুড়োহীন কনস্ট্রাক্ট যা কোনোক্রমে জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। তবে অবশ্যই, এ আমার মতামত বা ইমপ্রেশন।
তিন, educational management বলে যে গালভরা শব্দবন্ধটি রয়েছে, আমরা আজকাল মুখ্যত সেই কাজ করি। আমরা পড়াই নামমাত্র: মুখ্য সময়টুকু বরাদ্দ থাকে বিভিন্ন metric-এ বিস্তর পরিমাণে ডেটা জেনারেট করার কাজে। কলেজ জয়েন করার পর আমি প্রফেশনাল প্রয়োজনীয়তা থেকে একটাও নতুন বই পড়িনি বা পড়তে হয়নি, কিন্তু এক্সেল, ডেটা ম্যানেজমেন্ট নতুন করে শিখতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে NEP যা চাইছে, এবং আমি ধরেই নিচ্ছি ভালো কিছুই চাইছে; কিন্তু সেটায় ঠিক কী পরিমাণ উপরোক্ত কাজকর্ম করতে হবে, তা কল্পনা করতেও ভয় লাগছে। মূল যে কাজটাকে ভালোবেসে এই বৃত্তিটিতে এসেছিলাম, সেই কাজ থেকে যে কতখানি সরে এসেছি তা আসলে লিখে বোঝানো যাবে না। আমরা মুখ্যত গ্লোরিফায়েড ক্ল্যারিকাল স্টাফে রূপান্তরিত হয়েছি বিগত কয়েক বছরেই; আপনি কী পড়ালেন এবং কেমনভাবে পড়ালেন তার থেকে সীমাহীন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল আপনি কতখানি ডেটা ম্যানেজমেন্ট করলেন, এবং কেমনভাবে তা করলেন। ছেলেমেয়েরা আর ভাবতে শেখে না, শেখে কীভাবে চাতুর্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ক্রেডিট নিশ্চিত করা যায়। আসলে, খারাপ লাগাটা কাজ নিয়ে নয়, কাজের প্রকৃতি নিয়ে। আমি এই চাকরি বেছে নিয়েছিলাম পড়াতে ভালো লাগে বলে, এক্সেলে ডেটা ম্যানেজমেন্ট করতে ভালো লাগে বলে নয়।
চার, পরিকাঠামো, পরিকাঠামো এবং পরিকাঠামো। এমন কলেজ রয়েছে, এবং বহুসংখ্যক রয়েছে, যেখানে ঘরের সংখ্যা, ডেটা ম্যানেজমেন্ট ডিভাইসেস তথা মেকানিজম, সর্বোপরি কর্মচারীর সংখ্যা (অধ্যাপকের সংখ্যাও খুব বড়ো ফ্যাক্টর) এতটাই সীমিত, তাঁদের পক্ষে CBCS চালিয়ে নিয়ে যাওয়াও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এর ওপর ভ্যারিয়েবলস এবং কমপ্লেক্সিটি আরও বাড়লে ঠিক কী হবে, তা... ভাবতে সত্যিই ভালো লাগে না। খাতায়-কলমে ছেলেমেয়েদের প্রচুর অপশনস, কোর্স স্ট্রাকচার ‘ওপেন’, কিন্তু বাস্তবে কি তা আদৌ করা যায়? কোনও কলেজই কি তা করতে পারে, যদি হাতে অন্তত খান পঁচিশ অতিরিক্ত ঘর না থাকে? কলকাতায় এমন কলেজ রয়েছে, আমার নিজের বন্ধু সেখানে চাকরি করে, যেখানে ক্লাসঘরের সংখ্যা এতই কম যে ফোর্থ সেম-এর পরীক্ষা পুরোপুরি শেষ না হওয়া অব্দি তারা এমনকি ফার্স্ট সেম-এর ক্লাস শুরু করতে পারে না। অর্থাৎ, শুধু পরিকাঠামোর জন্য মোস্ট বেসিক অপশনগুলোর ক্লাসও (পড়ুন শুধু অনার্স বা ‘মেজর’ কোর্সের ক্লাস) পিছিয়ে যায় প্রায় কুড়ি দিন। বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক কী, তা বুঝতে গেলে কেবল এটুকু তথ্যই যথেষ্ট বলে মনে হয়।
NEP-র কিছু খুব ভালো দিক অবশ্যই আছে। আমি যতটুকু বুঝেছি, বিশেষত প্রাক-বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয় স্তরে বেশ কিছু এমন পরিবর্তনের সুপারিশ রয়েছে, যা ইমপ্লিমেন্ট করতে পারলে পরে ভালোই হবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের উচ্চশিক্ষার প্রেক্ষিতে, আশাবাদী হওয়া মুশকিল, যদি না বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যাপক স্তরে পরিকাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আর যেতে চাইছি না। কিন্তু, আর একটা কথা না বললেই নয়। উচ্চশিক্ষায় একটা অদ্ভুত শোম্যানশিপের ট্রেন্ড এসেছে বিগত কিছু বছর হল, যা NEP কার্যত আরো জোরদার করল। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য একটা দেখনদারি, ট্রেন্ডি কারণ বেশ প্যাঁচখাওয়া , কাজেই 'দেখতে' ইমপ্রেসিভ এমন ক্রেডিট স্ট্রাকচারে ছেলেমেয়েদের ঢুকিয়ে দেওয়া এবং ঠিক তেমনই বেশ 'ফ্যাশনেবল' একটা সিলেবাস গিলিয়ে দেওয়া নয়। উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ভাবতে শেখানো, বিভিন্ন চিন্তাভাবনার কাঠামোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরি করতে শেখানো। সেটার কতটুকু কী হচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছি অবশ্য। শুধু পাতার পর পাতা কায়দার সিলেবাস, ক্রেডিট ডিস্ট্রিবিউশন, কোর্স অ্যাটেইনমেন্ট ক্যালকুলেশনস... সবকিছু যা কিনা কোয়ান্টিফাই করা যায়, ন্যাক পিয়ার টিমের সামনে দিস্তাখানেক এক্সেল-ডেটাশিট দিব্যি ফেলে দিয়ে প্রমাণ করা যায়, বড়োরকমের ফান্ড চাইতে গেলে ডেটা-ফেটা ছুড়ে সেই দাবি 'জাস্টিফাই' করা যায়, ইত্যাদি প্রভৃতি। আখেরে ছেলেমেয়েরা, যাদের নিয়ে এত কিছু, তারা কতটুকু ‘শিখল’, বা তাদের জন্য কতটুকু শেখার সুযোগ তৈরি করা গেল, সেইরকম শিক্ষা যা কিনা তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখাবে, বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেবে, - সেটা থেকে প্রশ্নচিহ্ন সহজে সরার নয়। সবাই খেয়াল করেছেন নিশ্চিত, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের কলেজগুলোতে ভরতি হতে-চাওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা আতঙ্কজনকভাবে কমে গেছে। এবার, এর নানাবিধ আর্থ-সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে; সর্বোপরি আগের সিস্টেম চলে এলেই প্রচুর ছেলেমেয়ে ক্যাম্পাস ভরে ফেলবে, বহুদিনের সযত্ননির্মিত দুর্বলতা উপেক্ষা করে বিজ্ঞানবিভাগে নতুন করে সব ভরতি-টরতি হবে,- এমনটা দাবি করছি না। বিশেষত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার সংস্কৃতিটা বেশ কিছুকাল ধরে, হয়তো বা পরিকল্পনা করেই, নষ্ট করা হয়েছে ধাপে ধাপে, অনেক প্রাথমিক স্তর থেকেই; হঠাৎ করে তা ঠিক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, উচ্চশিক্ষায় এই পরিবর্তনটা যেন বড়োই আকস্মিক। ততটাই আকস্মিক যতটা মারাত্মক। সিস্টেমটাকে খাতায় কলমে, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে ঝাঁ চকচকে করে বিজ্ঞাপন-মার্কেটিং হতে পারে; শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা নয়। তার মুখ্য উদ্দেশ্য ন্যাক পিয়ার টিম বা কোনও বহিরাগত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ইমপ্রেস করা হতে পারে না, তার মুখ্য উদ্দেশ্য সেটাই যা চিরকাল ছিল - ছেলেমেয়েদের নতুনভাবে ভাবতে শেখানো, তাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ার বহুমুখী সম্ভাবনাময়তা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। এবং , আমি এটা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করছি যে ডিসিশন মেকাররা এটা বোঝেন না।
শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার জ্ঞান-বোধ অত্যন্ত সীমিত। এটা বিনয় প্রদর্শন নয়, এটা ঘটনা। আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃপ্রতিম, অসাধারণ মেধা-বুদ্ধিসম্পন্ন একাধিক সহকর্মীদের তুলনায় বিশেষত, এ ঘোর বাস্তব। কাজেই, হতেই পারে, আমার বোঝাটা ভুল। হতেই পারে, সব ঠিক হবে। কিন্তু অস্বস্তিটা থেকেই যায়। কারণ, এখান থেকে একটা খুব বড়ো আলোচনা আসে। দেশে শিক্ষা এবং তৎসংক্রান্ত সুযোগসুবিধার এক স্পষ্ট বিভক্তিকরণ হয়েছে। এতে করে শিক্ষা নিখুঁতভাবে monetized হয়েছে, এবং 'সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষা' এক অসম প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত জমি হারাচ্ছে, সেটা স্বাভাবিক। এমতাবস্থায়, এইসব আয়োজন একপ্রকারের cosmetic improvement-এর চেষ্টা বলে মনে হয়; এমন কিছু, যা আদতে কতটা কাজে লাগবে সেটা বিচার্য নয়, বিষয় হল সেটা দেখতে কতটা ঝাঁ চকচকে, সন্তোষজনকভাবে জটিল, এবং সুবিধাজনকভাবে trendy বলে মনে হয়। আমার এটাও মনে হচ্ছে, এতে করে আখেরে ক্ষতি হবে শিক্ষা এবং তার অর্জনের- যেটার জন্য কায়দা বা দেখনদারি ব্যবস্থাপনা নয়, শুধু একটু পড়াশোনার পরিবেশ দরকার। আর কিছু নয়।
.....................
[লেখক দঃ ২৪ পরগণার সুন্দরবন মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক]