কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ ও সত্যজিৎ রায়
.............................................
হিরে মানিক জ্বলে : পঞ্চদশ পর্ব
......................................................
“কবিতা পাঠকের কাছে ধ্বনি, দৃশ্য, অনুভব, কখনও-কখনও স্পর্শ ও গন্ধও প্রতিভাত হয়। সেই অর্থে কবিতাপাঠ এক কঠিন ক্রিয়া। পাঠপ্রতিক্রিয়াও বেশ জটিল। অঙ্কনশিল্পীরা, যারা দৃশ্যের কারবারী, তাদের যে মনোজগৎ, সেখানে এই প্রতিক্রিয়া তেমনভাবে প্রবেশ করে না। করে না, কারণ দৃশ্যের উপস্থিতি, তার প্রাধান্য, এমন এক সৌন্দর্য বা অ-সৌন্দর্য, আকারের, রঙের পারস্পরিক ছন্দ, শেষপর্যন্ত, দৃশ্যটি, দৃশ্যনন্দন হয়ে ওঠার দাবি, শিল্পীকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখে, দীর্ঘ পাঠ-অভ্যাস ছাড়া, তা অতি-সরলীকরণের ফাঁদে পড়ে যায়। হয়তো এই কথাগুলো একপেশে শোনাচ্ছে। খুবই দক্ষ শিল্পী, কেন দক্ষ, তাকে ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যাবে। মস্তিষ্ক ও আবেগ, শরীর ও মনের যথাযথ সামঞ্জস্য তাকে এমন কাজে সফলতা দেয়। এই সফলতা সম্পূর্ণই দৃশ্য-সফলতা। বিষয়-সফলতা নয়। বিষয় অর্থাৎ কবি ও কবিতার, যার মুখাবয়ব রচিত হচ্ছে প্রচ্ছদে, তাকে প্রায় অবজ্ঞা বা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াই রীতি হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদের কাহিনিতে।” - [ হিরণ মিত্র / প্রচ্ছদের মন, মনের প্রচ্ছদ / চমৎকার (৯ঋকাল মুখপত্র)/ প্রথম সংখ্যা (প্রচ্ছদ কাহিনি), ২০১৭ ]
এই সময়ের প্রধান একজন প্রচ্ছদশিল্পী, যিনি কবিতার ধারাবাহিক ও মনোযোগী পাঠকও বটে, তাঁর এই বক্তব্যটি যে কূট প্রশ্নের দিকে আমাদের ঠেলে দেয়, স্বল্প পরিসরে তার উত্তর খোঁজা সম্ভব না। কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ যিনি করবেন, তাঁর কি কবিতার নিষ্ঠ পাঠক হওয়া একান্তই জরুরি? কবিতায় রীতিমতো অধিকার না থাকলে কি কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদের যথার্থ সুবিচার করা সম্ভব না? কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ যে বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি দাবি করে, একজন সমর্থ শিল্পী তাঁর সহজাত শিল্পবোধ দিয়ে কি পারেন না তার কাছাকাছি পৌঁছতে? বিভিন্ন চারুশিল্পের মধ্যবর্তী চলাচলের আলপথগুলো কি কোনোভাবে সাহায্য করে না তাঁকে? অবশ্যই আজ এ প্রশ্ন যতটা অনিবার্যতা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, ১৯৪০-৫০ সাল নাগাদ তা সম্ভব ছিল না। কারণ প্রচ্ছদসহ বাংলা বইয়ের সার্বিক অঙ্গসৌষ্ঠব গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে তার মাত্র এক-দেড় দশক আগে। সত্যজিৎ রায় এ সময়েই তাঁর প্রচ্ছদ বা ইলাসট্রেশনের কাজগুলো পেশাদারভাবে শুরু করেছিলেন। তখনও ‘পথের পাঁচালি’-র দেরি আছে। এ সময়ে মূলত সিগনেট প্রেসের হয়ে নানারকম বইয়ের সঙ্গে বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদও তিনি ডিজাইন করেছিলেন। পাকাপাকিভাবে চলচ্চিত্র-দুনিয়ায় চলে আসার পরেও প্রচ্ছদ বা অলংকরণের কাজ তিনি একেবারে ছাড়তে পারেননি। এই নিবন্ধে আমরা কবিতার বইয়ের জন্য করা তাঁর প্রচ্ছদগুলোর সঙ্গে আলাপ করব। বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব অন্যান্য বিষয়ের গ্রন্থ-প্রচ্ছদের থেকে অন্যতর কোনও ভাবনা এক্ষেত্রে তাঁর কাজ করেছে, নাকি হিরণ মিত্র-কথিত উক্ত ইতিহাসেরই অংশীদার তিনি।
মূল প্রসঙ্গে আসার আগে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের প্রাক-সত্যজিৎ পর্বটুকু একঝলকে দেখে নেওয়া যাক। বই যে একটা নির্মাণ, এ ধারণা বাংলা বাজারে আসতে কেটে গেছে বহুদিন। ফলে প্রচ্ছদের বকলমে বহুদিন পর্যন্ত আমরা প্রচণ্ড রঙচঙে চোখ-টানা নামপত্র বা টাইটেল পেজই পেয়ে এসেছি। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ প্রথম সাবালকত্ব পেয়েছিল গড়পারের রায়চৌধুরী-পরিবারের হাত ধরে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স ছাপাখানায় নিজের লেখা শিশু-কিশোরপাঠ্য বইগুলির যে প্রচ্ছদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন, ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ এবং সুকুমার রায়ের ‘আবোল-তাবোল’ বা ‘হযবরল’-র প্রচ্ছদ মূলত সেই লিগ্যাসিই বহন করেছে। এরপর বিশ্বভারতীর কল্যাণে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ আলাদা একটা মাত্রা পেল। বিশ্বভারতীই সম্ভবত প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা বই বিষয়টার মধ্যে আলাদা একটা শিল্পমাধ্যমকে আবিষ্কার করেছিল। শুধু প্রচ্ছদ না, তাঁদের বিবেচনায় বইয়ের সাইজ, বাঁধাই, হরফের ধরন, বিন্যাস, পঙ্ক্তি-বিন্যাস, পৃষ্ঠা-বিন্যাস ইত্যাদি সমস্ত কিছুই গুরুত্ব পেয়েছিল। পুলিনবিহারী সেনের তত্ত্বাবধানে নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদভাবনা অবশ্য বিষয়ানুগত্যের চেয়ে বিশ্বভারতীকে একটি ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে তুলে ধরাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। তাঁদের সমস্ত বই, পত্রপত্রিকায় প্রায় অভিন্ন প্রচ্ছদ ব্যবহার তাই একদিকে যতটা অভিজাত, অন্যদিকে ততটাই স্থবির। এর পাশাপাশি অন্যান্য প্রকাশনা-সংস্থাতে পূর্ণ চক্রবর্তী, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, আশু বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ সরকার, রবীন্দ্রনাথ দত্ত, হেমেন্দ্র মজুমদার, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নামী প্রচ্ছদশিল্পীদের আমরা পেয়েছি। কিন্তু তাঁদের হাতেও বইয়ের প্রচ্ছদ বইয়ের যথার্থ প্রবেশক হয়ে উঠতে পারেনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। নিছক ভালো ছবির দাবিই মিটিয়েছেন তাঁরা। আলাদা করে বইয়ের আত্মাকে ছোঁবার সচেতন চেষ্টা দেখা যায়নি সেভাবে। এই অভাব পূরণ করল সিগনেট প্রেস। প্রবাদপ্রতিম দিলীপকুমার গুপ্তের (ডিকে নামে সমধিক পরিচিত) পরিচালনায় বাংলা প্রকাশনার দুনিয়ায় কার্যত বিপ্লব আনল সিগনেট। বাংলায় বই-নির্মাণ বিষয়টা এই প্রথম সমস্ত দিক থেকে পরিপূর্ণতা পেল। আর তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সত্যজিতেরও।
এ তথ্য প্রায় সকলেরই জানা যে, সত্যজিৎ রায়কে নিয়মিত পেশাদার প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল সিগনেট প্রেস। তবে তাঁর প্রথম প্রচ্ছদ-ডিজাইন অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে, ১৯৪০ সালে। এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’ বইয়ের প্রচ্ছদ করার ভার তাঁর ছেলেকে দিয়েছিল। সত্যজিৎ তখন প্রেসিডেন্সি থেকে ইকোনমিক্সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শান্তিনিকেতনে ফাইন আর্টসের ছাত্র। গড়পারের রায়-পরিবারের সহজাত শিল্পবোধের উত্তরাধিকারের সঙ্গে নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষার চমৎকার এক ককটেল তৈরি হচ্ছিল। সত্যজিৎ বরাবর স্বীকার করেছেন কলাভবনের কাছে তাঁর অকুণ্ঠ ঋণ। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় ফিরে পরের বছর জুন মাসেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি. জে. কিমারে জুনিয়ার কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন। কিমারের ম্যানেজার দিলীপকুমার গুপ্ত সে বছরই সিগনেট প্রেস শুরু করেন এবং সত্যজিৎকে দলে টেনে নেন। সঙ্গে অন্নদা মুন্সী, মাখন দত্তগুপ্ত, ও. সি. গাঙ্গুলী, সূর্য রায়ের মতো শিল্পীরাও ছিলেন। সিগনেটের জন্য সত্যজিতের করা প্রথম প্রচ্ছদ অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ (১৯৪৪)। কবিতার বইয়ের জন্য প্রথম প্রচ্ছদ আঁকেন তারও কয়েক বছর পর।
নিয়মানুসারে প্রচ্ছদ এমন এক শিল্পমাধ্যম, অন্য এক শিল্পমাধ্যমের শাসন কিছুটা মেনে নেওয়াই যার বিধিলিপি। ‘কিছুটা’-ই, কারণ শিল্প কখনও সম্পূর্ণ পরানুগত হতে পারে না। যা নিঃশেষে পরানুগত, তা শিল্প নয়। ফলে সমস্ত দেশে-কালেই প্রচ্ছদ মূল বিষয়ের উদ্দীপন বিভাব হয়ে থেকেছে। কখনও বিষয়কে ছুঁয়ে থাকা অনিবার্য মনে করেনি। কবিতার প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে বিষয়টা অনেক বেশি জটিল, যেহেতু কবিতা এক নিবিড় আন্তরিক উদ্ভাস, মানব-অনুভূতির সবচেয়ে গভীরে থাকা অনির্দেশ্যপ্রায় প্রদেশ। এমন কোনও সূত্র পাওয়া যায় না, যা থেকে বলা যাবে যে সত্যজিৎ কবিতার নিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। তবে কাব্যগ্রন্থের জন্য করা তাঁর প্রচ্ছদের সংখ্যা নেহাত কম না। আধুনিক বাংলা কবিতা যে সম্পূর্ণত এক মন্ময় সাহিত্য-প্রকরণ, কবিতার পাঠক না হলেও, হয়তো তিনি সে বিষয়ে একেবারে অ-সচেতন ছিলেন না। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদ সত্যজিৎ এঁকেছিলেন কিছুটা যেন পরাবাস্তবধর্মী করে। প্রথাগত অর্থে সুন্দরের ধারপাশ ঘেঁষেননি। দৃশ্যত এ প্রচ্ছদ মোটেই রোমান্স-রসের উৎস্রোত আনবে না পাঠকের মনে। টানা, সরু, আড়ভঙ্গিমায় তাকিয়ে থাকা চোখে মাদকতা থাকলেও লম্বাটে গড়নের মুখ ও নাক, মুখ আর চুলে অজস্র রেখার ঘন বুনোট নিয়ে বাস্তব-অতিক্রমী এক নারী-মুখাবয়ব এঁকেছেন তিনি। চোখ, নাক ও দীর্ঘাকৃতি মুখের আদলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখের গড়ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। লতাপাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা সেই মুখে ‘বাংলা টাচ’ রেখেছেন মাথায় অতিপরিচিত ডিজাইনের শাড়ির ঘোমটা দিয়ে। অনেকেই জানেন, এই প্রচ্ছদ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং জীবনানন্দ। বনলতা দৃশ্যত সুন্দর হবেন, এমনই নিশ্চয়ই কবির অবচেতনের দাবি ছিল। তবে কোথাও মনে হয়, এখানে দৃশ্যের দাবির পাশাপাশি কবির মনোজগতের মূল সুরটিকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন সত্যজিৎ, যে প্রবণতা পরবর্তীকালে আর বিশেষ চোখে পড়ে না।
সে বছরই নরেশ গুহ-র ‘দুরন্ত দুপুর’ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ সত্যজিৎ একেবারে অন্যভাবে করলেন। কাঁচা হলুদ রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে বিছিয়ে দিলেন এলোচুল ছড়িয়ে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা এক নারীর ঊর্ধ্বাঙ্গ। খুব সহজ-সরল কয়েকটা আঁচড়ে বইয়ের নামকবিতার উত্তাপকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অনেকে এই প্রচ্ছদে ফরাসি শিল্পী অঁরি মাতিসের অনুসরণ লক্ষ করেছেন। ১৯৫৩-তে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘অমাবস্যা’-র প্রচ্ছদে সত্যজিৎ কালো জমির ওপর অফ হোয়াইট রঙের প্যাস্টেলে অমসৃণ টানে লম্বাটে, খানিক ডিম্বাকৃতি এক নারীর মুখ আঁকলেন। এখানে আবারও, সামান্য হলেও, ধরা পড়ল রবীন্দ্রনাথের ছবির অনুরণন। লক্ষণীয়, এই প্রথম কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি নিজস্ব ধাঁচের ক্যালিগ্রাফি ব্যবহারের চেষ্টা করলেন। তাঁর পরবর্তী কাজগুলোতে আমরা ক্যালিগ্রাফির গুরুত্ব উত্তরোত্তর বাড়তে দেখব। ১৯৫৩ সালে করা আরেকটি প্রচ্ছদ বিষ্ণু দে-র ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ বইয়ের জন্য, যাতে তিনি হলুদাভ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর ছোটো কালো আয়তাকার পরিসর তৈরি করে ওই হলুদাভ সাদা রেখায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকা এক বীণাবাদিনী নারীর ছবি আঁকলেন। বাঙালির সাংগীতিক চেতনার ঐতিহ্যকে আভাসিত করতেই যেন কালীঘাটের একটি বিখ্যাত পটচিত্রের হুবহু অনুসরণ করলেন তিনি। কবির নাম ও গ্রন্থনামের অক্ষর-ছাঁদেও চেষ্টা করলেন লোকশিল্পের ছোঁয়া দেওয়ার।
এই সময় থেকে বেশিরভাগ বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি মূলত ক্যালিগ্রাফির দিকেই ঝুঁকতে শুরু করছিলেন। অক্ষর-শিল্পের প্রতি সহজাত আগ্রহ ছিল তাঁর। তাঁকে আরও উসকে দিয়েছিল কলাভবনের শিক্ষা। এ ব্যাপারে শান্তিনিকেতনের কাছে, বিশেষত বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর ঋণ অপরিসীম। বাংলা পুথি, দেবনাগরি, তিব্বতি, আরবি, চাইনিজ বা জাপানিজ হরফের স্টাইল তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। নানারকম হরফের সঙ্গে নিজস্ব স্টাইল মিশিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ‘সমর সেনের কবিতা’ আর ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ - দুটো বইয়ের ক্ষেত্রেই ক্রোম হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর লাল কালির অক্ষরে পুথির ধরন অনুসরণ করলেন। ‘সমর সেনের কবিতা’-য় তিনটে শব্দকে ওপরে-নিচে সাজিয়ে অক্ষরগুলোর লেজ টেনে বাড়িয়ে দিলেন। মাঝের শব্দটাকে একটু ডানদিকে সরিয়ে স্পেসটা ভালোভাবে ব্যবহার করলেন। ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’-য় চারটে শব্দকে একেবারে তলায় তলায় বসিয়ে শব্দের ডানপাশের মাত্রাগুলোকে বাড়িয়ে দিলেন, আর সম্পাদকের নামের নিচে জুড়ে দিলেন ছোট্ট একটা মোটিফ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’-র প্রচ্ছদে কালচে মেরুনের ওপর হলুদাভ সাদার সরু রেখাগুলো জাপানি অক্ষরের কথা মনে করায়। খেয়াল করার বিষয়, ক্যালিগ্রাফির কাজগুলোয় নামকবিতার বা কাব্যগ্রন্থের মেজাজের চেয়ে তিনি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন শিরোনামের শব্দগুলোকে।
১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালি’-র মুক্তির পর সিনেমা-সংক্রান্ত কাজের চাপে সত্যজিৎ পেশাদার শিল্পের জগত থেকে অনেকটাই সরে আসেন। বিজ্ঞাপন সংস্থার চাকরি আগেই ছেড়েছিলেন। সিগনেটকেও বেশি সময় দিতে পারছিলেন না। ১৯৫৭ সালে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’-র প্রচ্ছদে বিবর্ণ সবুজের ওপর সরু লাল-সাদা আঁচড়ে বাঙালি জনপদবধূর ছবি দিয়ে প্রতীকায়িত করলেন বাংলার আবহমান নিসর্গ-সৌন্দর্যকে। সে বছরই জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থেরও সিগনেট সংস্করণ বের হয়, যার প্রচ্ছদ সত্যজিৎ ডিজাইন করেন ক্যালিগ্রাফিতে। জীবনানন্দের সইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে অক্ষরের ছাঁদ তৈরি করেছিলেন ‘পাণ্ডুলিপি’-র অনুভূতি সঞ্চারিত করার জন্য। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত জীবনানন্দের ‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র প্রচ্ছদের ক্যালিগ্রাফিতে আবার বিনোদবিহারী-ঘরানা স্পষ্ট।
১৯৬১-তে নতুন করে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্তের পর থেকে তারই সূত্রে আঁকাআঁকির মধ্যে আবার প্রবলভাবে ফিরে আসতে হয়। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালে দুটি সম্পাদিত কবিতাগ্রন্থের প্রচ্ছদ করেন। এফ জে পাওলিক, হাইনরিখ হাকার ও ধীরেন মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত ‘জার্মান শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আর বিষ্ণু দে-সম্পাদিত ‘একালের কবিতা’। দুটোতেই তিন রঙ ব্যবহার করেছেন। প্রথম বইটির অক্ষর-ছাঁদে জার্মান কাঠিন্য সঞ্চারের চেষ্টা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব না। ‘রেফ’-টিকে স্পর্ধার ভঙ্গিতে যেন তুলে দিয়েছেন উপরের দিকে। আর দ্বিতীয় বইটিতে সবুজের দুটো শেডের সঙ্গে সাদা ব্যবহার করে ‘একাল’ শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যসুখেরও দাবি মিটিয়েছেন।
সন্দেশের জন্য শুধু রঙ-তুলি না, তাঁকে কলমও ধরতে হয়েছিল। তারপর সেখানেও তৈরি হল আরেক ইতিহাস। ১৯৬৫ সালে তাঁর প্রথম বই ‘প্রোফেসর শঙ্কু’ প্রকাশিত হবার পর থেকে প্রতি বছর নিজের একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদের দায়িত্বও নিয়ম করে তাঁর এসে ঘাড়ে চাপতে শুরু করে। ফলে এরপর থেকে অন্যদের বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য সময় বের করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। তবে মূলত অনুরোধ রাখতে বা নিকটজনের মুখ চেয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রচ্ছদ, অলংকরণ বা লোগোর কাজ করে যেতে হয়েছে তাঁকে। সাত-আটের দশক মিলিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মোট চারটি কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি করেছিলেন। ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’ (১৯৭৫), ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’ (১৯৭৬) ‘শব্দরা আমার বাগানে’ (১৯৮১) এবং ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’ (১৯৮৩)। সবকটিই ক্যালিগ্রাফি-নির্ভর।
সামগ্রিকভাবে প্রচ্ছদভাবনার ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি ক্যালিগ্রাফিতেও সত্যজিৎ খুব বেশি পুনরাবৃত্ত করেননি নিজেকে। চোখের কাছে তো বটেই, মনন বা অনুভূতির কাছেও আলাদা করে সেই প্রচ্ছদগুলোর আবেদন নিঃসন্দেহে অসামান্য। তবে তাঁর সমস্ত প্রচ্ছদের চারিত্র্যে একজন টিপিকাল গদ্যশিল্পীর স্বভাব ধরা পড়ে, যেমন ধরা পড়ে তাঁর ফিল্মের ক্ষেত্রেও। ঋজু, সটান ন্যারেটিভ তাঁর লেখারও প্রধান গুণ, তাঁর ফিল্মেরও। লক্ষ করলে তাঁর প্রচ্ছদ বা অলংকরণেও একই মনোভঙ্গি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। কবিতার মনোভঙ্গি বা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে হয়তো সেভাবে বন্ধুতা হবার কথাই ছিল না তাঁর করা প্রচ্ছদের। তবু একেবারে শুরুর দিকের প্রচ্ছদগুলোয় সম্ভবত তিনি নামকবিতার আঁতের কথাটুকু রেখায় ধরেছিলেন। ক্রমশ যত ক্যালিগ্রাফির দিকে ঝুঁকেছেন, কেবল শিরোনামের শব্দগুলোর শিল্পিত রূপকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন প্রধানত। কাব্যগ্রন্থের জন্য করা প্রথম প্রচ্ছদেই জীবনানন্দের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আর পরবর্তী জীবনে তুমুল ব্যস্ততার যৌথ সমীকরণ কবিতার গহন এলাকায় প্রবেশের পথে কি ঈষৎ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তবে?
এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য তর্কসাপেক্ষ। গবেষণাসাপেক্ষও বটে। এসব কিছুর পরেও, সত্যজিৎ রায় তর্কাতীতভাবেই বাংলা প্রচ্ছদের দুনিয়ায় একজন প্রবাদপুরুষ। সমসময়ে অজিত গুপ্ত, খালেদ চৌধুরী, সমীর সরকার বা সুধীর মৈত্ররাও স্মরণীয় সব প্রচ্ছদ করছিলেন। তবে কবিতাগ্রন্থের ক্ষেত্রে বাংলা প্রচ্ছদশিল্পকে কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই অপেক্ষা করতে হয়েছে সত্যজিতের অনতি-পরবর্তী আরেক অসামান্য প্রচ্ছদশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর জন্য।
ঋণ: ১) ‘রং তুলির সত্যজিৎ’, দেবাশীষ দেব, সিগনেট প্রেস
২) সৃজিতা সান্যাল
[প্রচ্ছদের ছবিগুলি ইন্টারনেট এবং দেবাশীষ দেবের উপরোক্ত বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে]
[কভার ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]