প্রসঙ্গ : বৃষ্টিদিন
বৃষ্টিবাদলার ছোঁয়াচ নিয়ে যে দিনগুলো ঘুম ভাঙাত তাদের বড়ো আপন মনে হতো।
বাড়ি থেকে তড়িঘড়ি বেরোনোর তাগিদ ছিল না। প্রতিটা দিন আসত অখণ্ড ছুটির পরোয়ানা নিয়ে। তার ওপরে আলিস্যির প্রলেপ লাগাত ঝড়বাদলের সকাল।
ঘনিয়ে ওঠা মেঘ প্রশ্রয়ের চাদর হয়ে ঢেকে দিত সময়ের চোখরাঙানিকে। তাই অত সহজ ছিল ঘড়ির কাঁটার শাসন থেকে পালানো। দুর্যোগের ষড়যন্ত্রে বন্ধ থাকত নিয়মমাফিক পড়াশুনা আর খেলাধুলো।
এইসব দিনের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল একটা গল্প।
বিশেষ কিছুই নয়, তাতে ছিল দুই বোন আর এক ভাইয়ের বৃষ্টিদিন কাটানোর বৃত্তান্ত। এক বোন বৃষ্টি ভালোবাসত। বাদলা দিনে তার গলায় গান আসত। আর এক বোনের আসত কান্না। মোটেই পছন্দ ছিল না তার । এই বাদুলে উপসর্গ। এই ঝড়বৃষ্টি।
এরকম দিনে সব্বার ইস্কুলে ছুটি পড়ে যেত। কাজে মন বসত না। সামনের রাস্তায় রোদেপোড়া কদম গাছটা জলে স্নান করে তরতাজা! সবুজ পাতার মধ্যে গোলগোল ফুরফুরে হলদে কদম ফুল। চুষে ফেলে দেওয়া আমের আঁটি থেকে বেরিয়ে আসা ছোট্ট চারা, তার লাল পাতাগুলো জলে ভিজে চিকচিকে। আর শেওলাপড়া পাঁচিলটা যেন সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া।
পড়তে পড়তে মখমলে মোড়া পাঁচিলটার কথা এলেই ঘটে যেত একটা ম্যাজিক। পাঁচিলের পাশে উঠে দাঁড়াত একটা সাবেকি ধাঁচের ফ্ল্যাট। তার পেছন দিকে বনজঙ্গল। অযত্নের আগাছা। ঝোপঝাড়। ছেলেবেলার চেয়েও দূরে আরও-ছেলেবেলার দিকে... । বর্ষার জল ধুয়ে দিচ্ছে তার বিগত ধুলোর স্মৃতি । বেরিয়ে আসছে আদিমানবের পোশাকের গাঢ় সবুজ রং।
অনেকদিন আগে ওখানে একটা গোসাপ দেখে শিউরে উঠেছিলাম।
দিনগুলো সেইসময় আশ্চর্য দিয়ে মোড়া ছিল।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি তখন। পড়া হয়নি মেঘদূত। পাশে থাকার সুদূর দুর্গম নির্বাসন কাকে বলে জানা ছিল না। তখন বৃষ্টি পড়লে আনন্দ হতো। কোনও কারণ ছাড়াই। বৃষ্টি পড়লে মায়ের কেন মনখারাপ হয় সে রহস্যের কিনারা করতে পারতুম না কিছুতেই।
জানলার ধারে গুটিসুটি মেরে বসতাম। ভাইবোন না থাকার আফসোসটা এইসময় চূড়ান্ত পেয়ে বসত আমায়। ভীষণ ইচ্ছে করত বাড়িতে কেউ আসুক। এমন কেউ...
যাকে পাশে নিয়ে এক জানলায় একই বৃষ্টি একসঙ্গে দেখা যায়...
[কভারের ছবিটি শিল্পী Alison Tyler-এর আঁকা]।
#