চার্লস থমাস উইলসন আর তাঁর মেঘকক্ষ
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ পরীক্ষাগারে গবেষণা করবার সময় এক স্কটিশ পদার্থবিদ বানিয়েছিলেন এমন এক যন্ত্র, যা পরবর্তী প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের কাছে হয়ে উঠেছিল চার্জযুক্ত বিভিন্ন কণা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করবার মূল আঁতুড়ঘর। জেমস শ্যাডউইকের হাতে পরমাণুর চার্জবিহীন কণা নিউট্রন আবিষ্কার বা কার্ল অ্যান্ডারসনের হাতে ইলেকট্রনের প্রতি-কণা পজিট্রনের (প্রতি-কণা বা anti-particle হল কোনো কণার একদম অবিকল প্রতিরূপ, দেখতে একই, তবে কিছু ধর্ম উলটো। আয়নায় কোনো মানুষ যেমন নিজেকে উলটো দেখেন, সেইরকম। যেমন ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক, পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক) আবিষ্কার, দুটোই হতে পেরেছিল ওই যন্ত্রটি ছিল বলে। আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রথমবার কেমব্রিজে পড়াশুনো করতে গিয়ে ওই যন্ত্রের আবিষ্কারকের কাছেই শিখেছিলেন ওই যন্ত্র ক্লাউড চেম্বার বা মেঘকক্ষ তৈরি করা, আর তিনিও এই বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন বছরকয়েক পরে। মেঘকক্ষের নির্মাতা সেই চার্লস থমাস রিজ উইলসনের আজ মৃত্যুবার্ষিকী।
তাঁর জন্ম ১৮৬৯-এর ১৪ই ফেব্রুয়ারি, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। তাঁর যখন বছর চারেক বয়স, বাবা মারা যান, এরপর উইলসন পরিবারের বাকিদের সঙ্গে চলে আসেন ম্যাঞ্চেস্টারে। প্রথম দিকে প্রাণিবিদ্যা পড়াশুনো করেন আওয়েন’স কলেজে, পরে বিষয় পাল্টে চলে আসেন পদার্থবিদ্যার দিকে। সিডনি সাসেক্স কলেজে বৃত্তি পেয়ে ভরতি হন, ওখান থেকে পদার্থবিদ্যায় গ্র্যাজুয়েট হন ১৮৯২ সালে। ইতিমধ্যে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ফটোগ্রাফির দিকে, মাঝেমধ্যেই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে মেঘের ছবি তুলতেন।
তাঁর মূল গবেষণার শুরু ১৮৯৫ সালে। তখন তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল আবহবিজ্ঞান, বিশেষ করে কৃত্রিমভাবে মেঘ তৈরির কাজ ছিল তাঁর অন্যতম এক কাজ। কোনো আবদ্ধ পাত্রের মধ্যে রাখা সম্পৃক্ত বাষ্পকে যদি পিস্টনের সাহায্যে হঠাৎ করে প্রসারিত করে ফেলা যায়, তবে ওই পাত্রের মধ্যে অল্প অল্প মেঘ তৈরি হয়। আর এই ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে উইলসন পরে তৈরি করবেন মেঘকক্ষ। অবশ্য তাঁর আগে এই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন পল-জাঁ কুলিয়ের এবং জন এইটকেন নামে দুই ফরাসি ও স্কটিশ আবহবিজ্ঞানী। তাঁদের কাজের মূল বিষয়টি ছিল এইরকম: একটা আবদ্ধ পাত্রের মধ্যে কিছুটা বাতাসকে আর্দ্র করে ফেলা হত, এরপর এরপরে সেটাকে দ্রুত প্রসারণ ঘটিয়ে ঠাণ্ডা করে ফেলা হলে ওই পাত্রের মধ্যে তৈরি হত বিন্দু বিন্দু মেঘ।
এই সালটি আমাদের বিশেষ ভাবে লক্ষ করা দরকার। মোটামুটি ওই বছর থেকেই পদার্থবিদ্যা একটা সম্পূর্ণ নতুন দিকে বাঁক নিতে শুরু করে। একদিকে উইলহেল্ম রয়েন্টগেন আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করে ফেলেন এক্স রশ্মি যা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, অন্যদিকে ঠিক এর পরের বছর ফরাসি বিজ্ঞানী অঁরি বেকারেল আবিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয়তা, পরমাণুর ভেতরমহলকে যা সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত করবে এরপরে। আর এর পরের বছর কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ পরীক্ষাগারের এক বিজ্ঞানী জোসেফ জন থমসন আবিষ্কার করেন যে পরমাণুর ভেতরের প্রায় সবটা জায়গাই ফাঁকা, আর ওই বিশাল শূন্যতার মধ্যে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এক ধরনের ঋণাত্মক কণা, যার নাম দেওয়া হয় ইলেকট্রন। আদিকাল থেকে চলে আসা পরমাণুর অবিভাজ্যতার যে পোক্ত ধারণা, তা ওই বছর থেকেই মুছতে শুরু করে। আরও পরে আস্তে আস্তে জানা যাবে, পরমাণু আসলে তিন রকমের কণার বাসস্থান— ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। তবে উইলসন তাঁর মেঘকক্ষ বানিয়ে চার্জযুক্ত কণাদের গতিপথ দেখবার কাজ শুরু করছেন যখন, প্রায় ওই সময়েই আর্নেস্ট রাদারফোর্ড কেমব্রিজে বসেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে পরমাণুর মধ্যে বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা, আর সেই ফাঁকা জায়গার মাঝখানে বসে আছে ভারী ক্ষুদ্রাকৃতি নিউক্লিয়াস আর ওর চারপাশে ঘুরছে ইলেকট্রনেরা।
উইলসন যে মেঘকক্ষ তৈরি করেন তা এইটকেন-এর চেম্বারের চেয়ে কিছুটা আলাদা। ওই আবদ্ধ পাত্রের মধ্যে রাখা হত অতি-সম্পৃক্ত জল বা অ্যালকোহলের বাষ্প। এবার ওর মধ্যে যখন কোনো চার্জ-যুক্ত কণা ঢুকবে, ধরা যাক তেজস্ক্রিয় আলফা বা বিটা কণা, তখন ওই বাষ্পের কণাদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটবে তেজস্ক্রিয় কণাদের, আর গ্যাসের অণু থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় ইলেকট্রনদের। এখন পরমাণুর মধ্যে থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে গেলে ওরা হয়ে যায় আয়নিত, আর ওই তেজস্ক্রিয় কণারা যে পথ দিয়ে যায় সেই পথে গ্যাসীয় আয়নিত কণার একটা পথ-রেখা তৈরি করে দিয়ে যায়। আয়নিত গ্যাসীয় কণাগুলির চারপাশে তৈরি হয় বিন্দু বিন্দু জলকণা, ওই জলকণাগুলির চেহারা দেখে বুঝে নেওয়া যায় চার্জযুক্ত কণাটির বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ ও আলফা নাকি বিটা কণা। অনেকটা আকাশে জেটপ্লেন তার পিছনে মেঘের একটা লম্বা রেখা ছড়িয়ে দিয়ে যায়, তেমনই চার্জ-যুক্ত কণারা মেঘকক্ষের মধ্যে মেঘের যেন একটা রেখা তৈরি করে দেয়।
উইলসনের মেঘকক্ষের গঠন খুব জটিল এমনটা নয়। মোটা দাগে ওর বর্ণনা এইরকম: এখানে থাকে একটা কাচের বড় গোলক। ওর মধ্যে থাকে সম্পৃক্ত বাষ্প আর কিছুটা তরল। ওর একদিকটা স্বচ্ছ, ভেতরে কী ঘটছে তা দেখবার জন্য। আর অন্যদিকে থাকে একটা পর্দা, যেটাকে হঠাৎ করে বাইরের দিকে সরিয়ে ভেতরের গ্যাসকে ঠাণ্ডা করে ফেলা হয়, ফলে ভেতরে তৈরি হয় একটা অতিপ্রৃক্ত গ্যাসের ভাণ্ডার। বাইরে থেকে চার্জযুক্ত কণা ওর ভেতর দিয়ে অতিক্রম করালে ওই গ্যাসের মধ্যে সেই কণার একটা দৃশ্যমান গতিপথ তৈরি হয়, ওটা দেখেই বিজ্ঞানীরা বুঝে নেন ওই চার্জযুক্ত কণার ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য। তবে কণার গতিপথ বুঝতে ভেতরে আলো ফেলতে হয়, সে ব্যবস্থাও থাকে এই যন্ত্রে। আর থাকে ছবি তোলার ব্যবস্থাও। মেঘকক্ষের মধ্যে ওই চার্জযুক্ত কণার গতিপথ অল্প সময় পরেই মুছে যায় সুতরাং ছবি তুলে না রাখলে পরে ও নিয়ে কাজ করা আর সম্ভব নয়। তাঁর এই মেঘকক্ষে কীভাবে চার্জযুক্ত কণার গতিপথ দেখা যায়, ব্যাপারটাকে তিনি একটি পেপারের মাধ্যমে লিখে ‘প্রসিডিংস অব রয়াল সোসাইটি’ জার্নালে প্রকাশ করেন ১৯১২ সালে। ওখানে দেওয়া ছিল তাঁর যন্ত্রের ছবি এবং ফটোগ্রাফিক প্লেটের নমুনাও। বছর কয়েক পরে ১৯১৯ সালে এই মেঘকক্ষ কাজে লাগিয়েই রাদারফোর্ড পরমাণুর দ্বিতীয় সদস্য, ধনাত্মক প্রোটন কণা আবিষ্কার করেন।
ছবি : রয়াল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত লেখাটির প্রথম পাতা ও উইলসনের মেঘকক্ষের মধ্যেকার চার্জযুক্ত কণার গতিপথের ছবি
১৯১১ সালে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ পরীক্ষাগারে বসে কাজ করবার সময়েই উইলসন তৈরি করেন ক্লাউড চেম্বার, বাংলায় যাকে আমরা বলতে পারি মেঘকক্ষ। পরবর্তীকালে এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীদের কাছে, যখন মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে অদৃশ্য এক ধরনের রশ্মি, যার নাম দেওয়া হয়েছিল কসমিক রশ্মি, সেই রশ্মির গতিপথ বা বিভিন্ন ধর্ম জানতে অনেকেই এই মেঘকক্ষ নিয়ে কাজ শুরু করেন।
উইলসনের এই আবিষ্কার তাঁকে এনে দিয়েছিল নোবেল পুরস্কার, ১৯২৭ সালে। সে বছর তাঁরই সঙ্গে এই পুরস্কার মিলিতভাবে পেয়েছিলেন আর এক বিখ্যাত পদার্থবিদ আর্থার কম্পটন, তাঁর নিজেরই নামে পরিচিত কম্পটন ক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য। কম্পটন ক্রিয়া নিশ্চিতভাবেই দেখিয়েছিল যে আলোর কণা-ধর্ম রয়েছে।
উইলসনের তৈরি ওই মূল মেঘকক্ষটি এখন রাখা আছে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ পরীক্ষাগারের মিউজিয়ামে। বিশ শতকের পদার্থবিদ্যার বিপুল গুরুত্বপূর্ণ এই যন্ত্রটি দেখতে যতটা সাধারণ, কাজে বা গুরুত্বে ততটাই অসাধারণ।
ছবি : কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ মিউজিয়ামে রাখা মূল মেঘকক্ষ যন্ত্রটি
............................................
সহায়ক লেখাপত্তর—
1) https://www.lindahall.org/about/news/scientist-of-the-day/c-t-r-wilson
2) https://www.daviddarling.info/encyclopedia/C/cloud_chamber.html.
3) মেঘকক্ষের গঠন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে
https://www.scienceabc.com/innovation/what-is-a-wilson-cloud-chamber.html
এবং আরও কয়েকটি ওয়েব-গদ্য।
#Wilson cloud chamber #Charles Thomson Rees Wilson #বিজ্ঞান #silly পয়েন্ট #অর্পণ পাল