কাস্ত্রো হাতুড়ি তারা
৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রোকে। একাধিক ডকুমেন্টেশন আছে। একটা সংখ্যাও এদিক ওদিক নয়। পাক্কা ৬৩৮ বার।
ফিদেলের প্রতিক্রিয়া? ২০০৪ সালে অলিভার স্টোনের তথ্যচিত্রে দাড়ি-গোঁফের ঘন জঙ্গলের ফাঁকে মুচকি হাসেন তিনি - “যুক্তরাষ্ট্রই আমাকে কিংবদন্তি করে দিয়েছে।”
সর্বসাকুল্যে দুটোই তো মাত্র চরিত্রের কথাই জানা গেছে এতদিনে, যাঁদের ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষমতা ছিল। একজন কাল্পনিক চরিত্র। আরেকজন রক্তমাংসের, কমিউনিস্ট। তাঁকে হত্যার জন্য একটি ভয়ানক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র পাঁচ দশক ধরে হিংস্র নেকড়ের মতো মরিয়া চেষ্টা করে গেছে, আর তিনি হাভানা চুরুট ঠোঁটে সামান্য ভুরু কুঁচকে হেলায় ডজ করেছেন পরপর প্রাণঘাতী আক্রমণ। হাজার বিতর্কের অবকাশ থাকলেও, অন্তত এই একটা কারণে বোধহয় সকলেই টুপি খুলতে চাইবেন ফিদেলের সামনে। আর কোনও রাষ্ট্রনায়ক পারেননি চার অক্ষরের এই দেশটার ঘৃণ্য আগ্রাসনের গালে পাঁচ দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে থাপ্পড় কষিয়ে যেতে। গোটা বিশ্বজুড়ে লাল স্বপ্ন ছিঁড়েফেঁড়ে মাটিতে মিশে যাবার পরেও বহুদিন পর্যন্ত ফিদেলের নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে থেকে গেছে ক্রুশবিদ্ধ কিউবা। ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও তাঁর পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞান থাকলে যে কেউ বুঝবেন, এ লড়াই কতটা অসম্ভব অসম এক লড়াই ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র- সমর্থিত বাতিস্তা সরকার ১৯৫২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করে। বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ফিদেল গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৯৫৩ সালের সেই অভিযান ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। ১৯৫৫ সালে বন্ধু আরেক কমিউনিস্ট বিপ্লবী চে’ গেভারাকে নিয়ে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেন ফিদেল। বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের পর কিউবায় প্রতিষ্ঠা করেন কমিউনিস্ট শাসন। কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন ১৯৫৯ সালে। ১৯৭৬ সালে দায়িত্ব নেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সেখান থেকে ২০০৮ সালে ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে শাসনভার তুলে দিয়ে অব্যাহতি নেওয়া পর্যন্ত সময়টুকুতে থ্রিলারের সমস্ত মশলা মজুত।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর ফিদেলের সম্পর্কটা অনেকটা কার্টুন নেটওয়ার্কের ‘দ্য রোড রানার শো’-র মতো। মার্কিন সেনা ও সি.আই.এ কীভাবে বছরের পর বছর ধরে ফিদেলকে হত্যা করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে, তাই নিয়ে একটা আস্ত ডকুমেন্টরিই তৈরি হয়ে গেছে। নাম ‘638 ways to kill Castro’। ডলান কানেলের নির্দেশনায় চ্যানেল ফোরের পরিবেশনায় তথ্যচিত্রটি ২০০৬ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পেয়েছিল ইউনাইটেড কিংডমে। ফিদেলের ৪৯ বছরের শাসনকালের পুরোটাই তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন নিরাপত্তারক্ষী ফেবিয়ান এসকালান্তে। এসকালেন্তের বয়ান থেকে জানা যায়, কতটা সুপরিকল্পিত ও অভিনব ছিল প্রতিটি ষড়যন্ত্র। চুরুটের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা থেকে শুরু করে তাঁর জুতো ও চুরুটের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য রাখা, বিভিন্ন সময়ে খাবারে বিষপ্রয়োগ, তাঁর ব্যবহৃত কলমে বিষযুক্ত সূচ রাখা, পোশাকে জীবাণু ছড়িয়ে রাখা ইত্যাদি নানাবিধ নিত্যনতুন উপায়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায় সিআইএ। সিআইএর আরেকটি মোক্ষম ষড়যন্ত্র ছিল সাবেক স্ত্রী মিরতাকে হাত করে কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা। বিষযুক্ত ক্যাপসুল দিয়ে তাঁকে হত্যা করার ফন্দি আঁটা হয়। কোল্ডক্রিমের কৌটোয় রাখা ছিল এই ক্যাপসুল। এই চেষ্টাও শেষমেশ সফল হয়নি। শুধু হত্যার চেষ্টাই নয়, ফিদেলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টাও কম করেনি সিআইএ। একবার এক বেতারকেন্দ্রে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন ফিদেল। এ সময় স্টুডিওতে নেশাজাতীয় দ্রব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর প্রভাবে অদ্ভুত আচরণ করেন ফিদেল। তবে আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি সিআইএর। শাসনকালের একেবারে শেষের দিকে ২০০০ সালে পানামা সফরেও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। বক্তৃতা-মঞ্চের পোডিয়াম ডেস্কে ৯০ কেজি বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল। সেবারেও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান ফিদেল। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্যন্তিক চেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নব্বই বছর বয়সে এসে স্বাভাবিক বয়সজনিত মৃত্যুর আমন্ত্রণ গ্রহন করেছেন অলৌকিক ফিদেল। ইচ্ছামৃত্যু নয় অবশ্যই। তবে তার চেয়ে কম কিছুও নয়।
ফিদেলের রাজনীতি আজ ডোডোপাখি হয়ে গেছে। দুরাচার দৈত্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কমান্দান্তের নন্দনকাননে। তবু ফিদেল আজও এক অনিঃশেষ স্বপ্নের নাম। হ্যাঁ। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তাঁর অনেক রাষ্ট্রনীতিই সমালোচনা বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে। দেশের মানুষের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। তার সবটা মিথ্যেও নয় হয়তো। কিন্তু এত মস্তানির সঙ্গে মার্কিন দাদাগিরির মুখের ওপর যোগ্য জবাব খুব বেশি লোক দিতে পারেননি। বিশেষত বিশ্ব একমেরু হয়ে যাবার পরেও। অমেরুদণ্ডীদের এই দুনিয়ায় শুধু এটুকুই কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে খুব বেশি লোক এটা বলার ধক রাখেন না যে, “বিপ্লবের সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে, আমাদের যৌনকর্মীরাও গ্র্যাজুয়েট...।”
গতকাল (১৩ অগাস্ট) ছিল তাঁর জন্মদিন। বেঁচে থাকলে চুরানব্বই পূর্ণ করতেন। পুঁজি তাঁর প্রিয় বন্ধু চে’-কে টি শার্ট আর টুপি বানিয়ে বেচে দিয়েছে। দেখে ভালো লাগে, বন্ধুর মতো দুর্ভাগ্য ফিদেলের এখনও হয়নি। বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে, অলৌকিক ৬৩৮।
#ফিদেল কাস্ত্রো #মৃণালিনী ঘোষাল #ফিচার #স্মরণ