নিবন্ধ

কলকাতার আড্ডা – চাঁদের দেশের গল্পসল্প

সরোজ দরবার Aug 21, 2020 at 6:59 am নিবন্ধ

সমবায়ের সভা। রোববার করে তাঁর বাড়িতে যে সৃজনশীল সমাগম, তার এহেন নাম দিয়েছেন শঙ্খবাবু। এদিকে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘পণ্ডিত নই, কথাটার উৎপত্তি জানি না। আওয়াজটা অ-সংস্কৃত, মুসলমানি। যদি ওকে হিন্দু করে বলি সভা, তাহলে ওর কিছুই থাকে না।’ বুদ্ধদেব তাই বাঙালির আড্ডাকে একেবারে স্বতন্ত্র জায়গা দিতে ইচ্ছুক; বিদেশ তো কোন ছাড়, সর্বভারতীয় আড্ডা-সংস্কৃতির থেকেও একে আলাদা করে তিনি বলছেন, ‘আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায়, তেমনই আড্ডা জমায়।’ সে মাধবীরাত কি শারদপ্রাত হোক বা শ্রাবণের রিমঝিম দুপুর– বাঙালির আড্ডার মেজাজ ও মর্জি দুই-ই যে আলাদা, বুদ্ধদেবের এ-কথার সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই। মক্কা শহরে আড্ডাবাজ হিসেবে নাম কামানো জনাকয়েক বাঙালির দৌলতে মুজতবা আলী সাহেব সুদূর কায়রোর অচেনা আড্ডাতেও আসর জমিয়েছিলেন দিব্যি। আর বাঙালির যা প্রাণভোমরা, বাঙালির প্রাণের শহর কলকাতার ইতিহাসে সে জুড়ে যাবে না, তাও কি হয়! গল্পে পটলডাঙার চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে পরশুরামের রায়বাহাদুর বংশলোচনের বৈঠকখানা, আর বাস্তবে সাগরময় ঘোষের সম্পাদকীয় দপ্তর থেকে বারদুয়ারি ছুঁয়ে বিশপ লেফ্রয় রোডের বসার ঘর অব্দি কলকাতার আড্ডার ইতিহাস ছড়ানো।

‘মুসলমানি’ শব্দটা, বুদ্ধদেব যা উল্লেখ করেছেন, ধরে একটু পিছিয়ে গিয়ে বাবরের দ্বারস্থ হওয়া যায়। বলা ভালো, বাবরের এক চিঠির। ততদিনে সুরাপান ছেড়েছেন বাবর। এই সুরাত্যাগের আগের বছর ‘সুরার পিপাসা এবং সামাজিক মেলামেশার ইচ্ছাটা মাত্রাহীনভাবে বেড়ে গিয়েছিল।’ ঘনিষ্ঠজনকে তাই পরামর্শ দিয়ে বলছেন, ‘আমুদে বন্ধুবান্ধব ও পুরোনো প্রাণের সুহৃদদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং সুরাপান অবশ্যই আনন্দদায়ক। কিন্তু এমন কোন অকৃত্রিম বন্ধু আছে যার সঙ্গে তুমি সামাজিক সুখের পেয়ালায় চুমুক দিতে পারো?’ হক কথা। বুদ্ধদেবও বলেন, ইচ্ছে করলেই আড্ডা দেওয়া যায় না, কেন-না ‘তার আত্মা বড় কোমল’।

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় আবার ঋষি লোমহর্ষণের ছেলে সৌতির কাহিনি সামনে এনে জানান, আড্ডার ইতিহাস ঠিক কতখানি প্রাচীন। সৌতি নাকি এমন আড্ডায় জমে গিয়েছিলেন যে, আড্ডা ভাঙতে-ভাঙতে গোটা মহাভারত শেষ। যাই হোক, যে-গঙ্গোত্রী থেকেই আড্ডা আসুক না কেন, বাঙালির কাছে তা বাংলার শিবঠাকুর হয়ে গিয়েছে। তার জুড়ি মেলা ভার।

আড্ডা নিয়ে যাঁরা কলম ধরেছেন, তাঁরাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, আড্ডা খানিক জলের স্বভাব। পাত্র পেলেই জমে যায়। এই যে খানিকটা অগোছালো, এলোমেলো, অথচ ভিতরে একটা আলতো শৃঙ্খলার আভাস পাওয়া যায়, এইটেই আড্ডার বৈশিষ্ট্য। যেহেতু উদ্দেশ্য স্থির নয়, বা আয়োজকের মন রাখার বালাই নেই, ফলে আড্ডা অনেকটা ‘ইনহিবিশন’ মুক্ত। মুক্তচিন্তার অনুশীলনের অপরিহার্য পরিসর। এই খোলা, উন্মুক্ত পরিসরের কারণেই আড্ডার সঙ্গে সৃজনশীলতার যোগাযোগ নিবিড়। অর্থাৎ আড্ডা দিলুম বলে খানিকটা গুলতানি নিশ্চিতই করা যায়, কিন্তু এই প্রসারতা না থাকলে আড্ডার দুধে জলই ভারী হয়ে যায় কেবল। সম্পর্কের বেশ ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’ থাকলেই আড্ডা জমে। এখানে খুনসুটি, দুষ্টুমি থাকে। মতভেদ তো থাকেই থাকে। কিন্তু দিনের শেষে এই আড্ডার জন্য প্রাণ আইঢাই-ও থাকে। সেই হেতু আড্ডা একটা খোলা আকাশ। যা অনেক বৈচিত্র‍্যকে অ্যাকোমোডেট করতে পারে। অনেক রাশভারী মানুষ এখানে তাই এমন রূপে হাজির হন যে, না জানলে বিশ্বাস হয় না। কলকাতার আড্ডার ইতিহাসের মধ্যে তাই বুনে দেওয়া আছে কলকাতার বাঙালির অনেকখানি ইতিহাস।

বাংলার তথা কলকাতার গুণীজনদের আড্ডা নিয়ে আস্ত আস্ত সব বই লেখা হয়েছে। সে-মহাভারতের ‘সামারি’ লিখে কাজ নেই। তবে, দু-একটা নমুনা হাজির করা যেতে পারে। সারস্বত মহলের আড্ডার দীর্ঘদিনের কেন্দ্র বইপাড়া। বুক কোম্পানি ও এম সি সরকারের বইয়ের দোকানের আড্ডাকে এই নিরিখে প্রাচীনতম বলা চলে। কফি হাউসের আড্ডা তো কিংবদন্তি। তবে, তারও আগে সাঙ্গুভ্যালির আড্ডা, বসুশ্রী সিনেমার দোতলা, চৌরঙ্গী কফি হাউসের আড্ডার কথা বিভিন্ন গুণীজনের লেখায় ফিরে ফিরে আসে; আর অসংখ্য চা-দোকানে জমে যাওয়া আড্ডারা তো প্রায় মহাকাব্যে প্রক্ষিপ্ত। বিমল কর বন্ধুর জবানিতে ঘোষণা করেছেন, যে ব্যাটা চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়নি সে বাঙালিই নয়! অপরিসর গলির ছোটো ঘরে কত যে বিখ্যাত আড্ডার জন্ম হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর সেই সব আড্ডা ঘিরে ঘুরে বেড়ায় আশ্চর্য সব গল্পেরা।

কল্লোলের জন্ম হয়েছিল পটুয়াটোলা লেনের একটি দোতলা বাড়িতে। সেখানে বসত আড্ডা; আর একটা ইজিচেয়ার দখল নিয়ে চলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অচিন্ত্যকুমার হয়তো দেখলেন, পবিত্র গাঙ্গুলী চেয়ারে বসে আছেন। তিনি ঢুকে একটু এদিক ওদিক করে বলতেন, এই শৈলজা তোকে বাইরে ডাকছে। এই ডাকে সাড়া দিতে গেলেই চেয়ারদখল। তা দখল হল তো হল। কিন্তু পবিত্র ফিরলেন, ভাবখানা এমন, যেন কিছুই হয়নি। একটু বাদে ঘরের ভিতর থেকে ডাক এলে, পবিত্র জানান, বউদি ডাকছে। এই বউদি নাকি কল্লোলের ‘ভবঘুরে’দের কাছে ‘অন্নপূর্ণা’ ছিলেন। তা, সে ডাক কে উপেক্ষা করবে! ফলে অচিন্ত্যকুমার উঠলেই আবার চেয়ারদখল। আসলে, বাইরে গিয়ে পবিত্রবাবু ‘অন্নপূর্ণা’ বউদির সঙ্গে এভাবেই চেয়ার দখলের গল্পটি সাজিয়েছিলেন।

এই হচ্ছে নিখাদ আড্ডার গল্প। সামান্য, মাধুর্যময়। আবার আড্ডায় শোনা গল্পের মাহাত্ম্যও কিছু কম নয়। যেমন শুনিয়েছেন ‘দেশ’ পত্রিকার এককালের কিংবদন্তি সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। তাঁর যুবাকালে এক আড্ডায় শোনা গল্প। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন মিত্র ও ঘোষের দোকানে। ৫০টা টাকা দরকার। সবেমাত্র দোকান খোলা হয়েছে। ক্যাশবাক্সে জমা পড়েনি। তাই বিভূতিবাবু যদি বিকেলে টাকাটা নেন তো ভালো হয়, এমত জানানো হল। রাজি হলেন তিনি। কিন্তু এখন এতটা সময় কী করবেন? কাছাকাছি জায়গা থেকে একজন নাপিতকে ধরে আনলেন। পাঞ্জাবিটা দোকানের ভিতরে রেখে, গায়ে কাগজ চাপিয়ে শুরু হয়ে গেল চুলছাঁটা। হেনকালে সেখানে হাজির তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখেই বিভূতিবাবুর প্রশ্ন, বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে? তারাশঙ্কর যতটা জানতেন সেই অনুমানে বললেন, গলদা চিংড়ি। তবে আর কি! দুপুরের খাওয়াটা তারাশঙ্করের বাড়িতেই হয়ে যাক, বিভূতিবাবুর প্রস্তাব। চললেন দুজনে তারাশঙ্করের বাড়িতে। খাওয়াদাওয়া হল। এমন সময়, তারাশঙ্কর তুললেন সাহিত্যের প্রসঙ্গ। তাঁর মত, বিভূতিভূষণ নিজেকে চেনা ঘেরাটোপে আটকে রাখছেন। পরিচিত পরিসর ছেড়ে বেরোচ্ছেন না। সমকালীন পরিস্থিতি তাঁর লেখায় সেভাবে আসছে না। অথচ বিভূতিবাবুর যুক্তি, বড়ো ঘটনা কিছু নয়, এই যে ছোটো ছোটো সুখদুঃখের জীবন পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও আনন্দের সঙ্গে বয়ে চলেছে, সেটাই আসল। কিন্তু তারাশঙ্কর তাও তাঁর যুক্তিতে অনড়। বিভূতিভূষণ পড়লেন ধন্দে। তাহলে কি তাঁর লেখা কিছুই থাকবে না? উত্তর মেলে না। বিভূতিবাবু সোজা চললেন কালিদাস রায়ের বাড়ি। বললেন তাঁর মনে সকল সংশয়ের কথা। কালিদাসবাবু সব শুনে বললেন, তারাশঙ্কর সরস্বতীকে যত গয়নাতেই সাজান না কেন, দেবীর নাকছাবিতে যে হিরেটা বিভূতিভূষণ বসিয়েছেন, তা গয়নার জৌলুসকে ছাপিয়ে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। শুনে শান্ত হলেন বিভূতিভূষণ। ফেরার পথে টাকা নিয়ে গেলেন, এবং কল্যাণী দেবী যে কাশীর বেগুন আনতে বলেছিলেন, তা মনে করে তড়িঘড়ি শেয়ালদার দিকে পা বাড়ালেন। জানি না, আড্ডা ছাড়া এ-গল্প উঠে আসত কি না। তবে, বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন, এই গল্পের মধ্যে আখ্যানের যে দ্বন্দ্ব, দুই ধারার কথা উঠে এসেছে, তা বিদ্যায়তনিক পরিসরে নিরন্তর চর্চার বিষয়। উত্তরকালে, উপন্যাস নিয়ে আলোচনায়, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আখ্যান বা অবস্থানের ব্যাখ্যানে দেবেশ রায় যেভাবে বিভূতিভূষণকে বুঝিয়ে দেবেন, তাতে বোঝা যাবে বিভূতিভূষণের লেখা সম্পর্কে সেদিনের নাকছাবিতে হিরের বিশেষণটি কতখানি অভ্রান্ত ছিল।

আড্ডার ভাষা আর-এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্থানিক বাকরীতি, বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা এখানে যেভাবে গুরুত্ব পায়, তা উল্লেখযোগ্যভাবে পুষ্টি জুগিয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যকে। এ ছাড়া আর-একটি বিষয় না বললে নয়। আড্ডা যেভাবে বহুস্বর সংগতির উদাহরণ হয়ে ওঠে, আখ্যানে তার তুলনা মেলা ভার। সদর্থেই এ যেন বারো ঘর এক উঠোন। ডায়ালজি থেকে পলিফোনিতে রূপান্তরের নমুনা এবং সেই হেতু সমাজতত্ত্বের দরজা-জানলাগুলোও খুলে যেতে পারে এই আড্ডার পর্যালোচনায়।

তবে, আড্ডার মহিমা অন্যত্র। আড্ডাই সেই জিনিস যা নিজের ওজনকে লঘু করে দেয়। স্বল্পবিদ্যা বা অতিবিদ্যার ভারকে সরিয়ে, অনেকের সঙ্গে মিলে, মতবৈচিত্র‍্যের ভিতর যে মতৈক্য, তা খুঁজে নিতে বলে। এখানে ব্যক্তিভার লঘু হয়। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন যে, আড্ডা হল চাঁদের দেশ। চাঁদে যেমন ওজন কমে যায়, আড্ডাতেও তেমনি ব্যক্তির অসহ ভার নেমে যায়। কথা বলে ওঠে সমষ্টি। যে-কোনো আড্ডার গল্প তাই প্রকৃত প্রস্তাবে চাঁদের দেশের গল্পসল্প-ই।



[পোস্টারে ব্যবহৃত ছবি : বিপ্রদীপ বৈদ্য, পোস্টার : অর্পণ দাস।]

আরও পড়ুন

#কলকাতা #আড্ডা #কলকাতার আড্ডা #সরোজ দরবার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

219121