বিরিয়ানি-কথামৃত
"ডালভাত আর বিরিয়ানির পার্থক্যটা বোঝার চেষ্টা করো। প্রথমটা নেসিসিটি, দ্বিতীয়টা লাক্সারি।"
সিজিদ্দার 'বাইশে শ্রাবণ'-এর এই বাণীটা বাঙালির 'মিম'ময় মস্তিষ্কে একেবারে গেঁড়ে বসে গেলেও এই কথাটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে বিগত দু-দশকে বোরোলিনকে পিছনে ফেলে বিরিয়ানি নামক খাদ্যটি বঙ্গজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। Gen X বাঙালির কাছে ভাপা ইলিশ, চিংড়ির মালাইকারি, চাইনিজ চিলি চিকেন বা সাবেকি মোগলাইকে পিছনে ফেলে প্রিয় খাদ্যের লিস্টে এগিয়ে এসেছে বিরিয়ানি। প্রথম ডেট হোক বা জামাই ষষ্ঠী, কলেজের ফেস্ট হোক বা বিয়েবাড়ি, বন্ধুদের রিইউনিয়ন হোক বা অফিস পার্টি - খাদ্যরসিক বাঙালির প্রথম পছন্দ কিন্তু আজকাল বিরিয়ানি। বাঙালির একটা আবেগের নাম হয়ে গেছে বিরিয়ানি। তার জনপ্রিয়তা কিন্তু শহর কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলি বা মফস্বলেও পৌঁছে গেছে। সেই জন্যই হয়তো আরসালান বা হাজি-র বিরিয়ানির সাথে সদর্পে পাল্লা দিতে পারে ব্যারাকপুরের 'দাদা বৌদি'।
এখানে বলে রাখা ভালো যে কোভিড-কালের পর সারা বিশ্বের সর্বাধিক গুগল-করা খাবারটি হল বিরিয়ানি। কাজেই, বলা যেতেই পারে যে দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিরিয়ানি কিন্তু অনেকটাই আন্তর্জাতিক। কিন্তু বাঙালি বিরিয়ানি নিয়ে এতটাই পসেসিভ যে অনেক সময় আমরা ভেবে বসি যে আমাদের বিরিয়ানিটাই সেরা এবং অথেনটিক। তাই হায়দ্রাবাদ বা অন্ধ্র বিরিয়ানিকে দেখে অনায়াসে বাঙালি নাক সিটকে বলতে পারে, "এটা বিরিয়ানি হল! ছো ছো!"
আবার বাংলার বাইরে থাকার সুবাদে এটাও জানি যে অবাঙালিরাও কিন্তু আমাদের আদরের বিরিয়ানিকে নিয়ে খিল্লি করতে পিছপা হন না। একজন তো বলেই দিলেন, "আপনাদের বড় আলুর দোষ মশাই। সব কিছুতে আলু। একটা মোগলাই খাবারেও কিনা আপনারা আলু গুঁজে দিলেন!" এটা শুনে আপামর বঙ্গসমাজ গর্জে উঠবে জানি। আরে ওই আলুটিকে নিয়ে কত প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। আমি নিজে পারলে স্কেল কম্পাস দিয়ে আলুটি দুভাগ করে তবে শেয়ার করতাম। সেখানে কিনা বলে বিরিয়ানিতে আলু অনাহুত? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর - কিন্তু এই রহস্যের সমাধান করতে আমাদের উল্টাতে হবে ইতিহাসের পাতা আর খুঁজে নিতে হবে বিরিয়ানির প্রত্যাবর্তনের সুস্বাদু কাহিনী। চলুন যাওয়া যাক বিরিয়ানির বিবর্তনের ইতিহাস-সন্ধানে।
এটা শুনেই আপনি যতই ভুরু কুঁচকান না কেন, ভাতের সঙ্গে মাংস রান্নার প্রথম উদাহরণ পাওয়া যায় তামিল সঙ্গম সাহিত্যে ২ খ্রিস্টাব্দে। খাবারটার নাম ছিল 'অন্ন সুরু'। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলকে খেতে দেওয়া হতো এই খাবার। যদিও তাতে বিশেষ কোনো মশলার প্রচলন না থাকায় অনুমান করা যায় যে বিরিয়ানির এই পূর্বসূরি খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। এক্ষেত্রে সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রে রান্না করার সুবিধের মত ব্যবহারিক দিকগুলোই প্রাধান্য পেয়েছিল।
এরপর চলে যাবো আমার ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে। নিজের হাতি-ঘোড়াবাহিনি নিয়ে দিল্লি আক্রমণ করতে আসছেন দুর্ধর্ষ মঙ্গল দস্যু তৈমুর লং। সেই তৈমুর যিনি নাকি ঘোড়ার উপর ঘুমাতে পারতেন আর চরম নৃশংস ছিলেন। ইতিহাসে তিনি ত্রাসের প্রতিশব্দ হয়ে যান। তাঁর ত্রাস এতটাই ছিল যে আজও অভিনেতা সইফ আলী খানকে নেটিজেনরা তার পুত্রের নামকরণ নিয়ে ট্রোল করছেন। যাই হোক বলা হয় তৈমুর হাতি-ঘোড়া ছাড়া নিজের সাথেই এনেছিলেন মাটির বড় বড় পাত্র। যেখানে তাঁর সেনাদল ঘাঁটি গাড়ত, সেখানে কাটা হতো বড় বড় উনুন আরে সেই উনুনে চাপিয়ে দেওয়া হতো ভাত, নুন আর গোস্ত। সারা দিন হালকা আঁচে সেধ্য হতো সেই মিশ্রণ আর সেনা যেত সমরে। আমারা যারা দম বিরিয়ানির ভক্ত তাঁদের বলি, দমের ধারণার জন্ম কার্যত এখান থেকেই। আর একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, অন্য খাবারের তুলনায় কিন্তু বিরিয়ানির পরিমাণ (portion)-টা সাধারণত প্লেটে অনেকটাই বেশি হয়। যতই দোকানদার দাম বাড়ান না কেন সাধারণ ভাবে পরিমাণ কিন্তু কমাতে দেখা যায়না। এই ব্যাপারটারও কিন্তু একটা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে। হিসেবটা সহজ। তখন তো আর ফ্রিজ ছিল না। কাজেই দিনের রান্না দিনের-দিন শেষ করতে হবে। যতই মেপে রান্না হোক না কেন, যুদ্ধ করতে যত জন যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিনের শেষে কিছু কম লোক ফিরবে। এবার তাদের মধ্যেই রান্না তো ভাগ হবে। স্বাভাবিক নিয়মেই এক-এক জনের ভাগ্যে পরিমাণ জুটত বেশি করে। একেই হয়তো বলে কারোর পৌষমাস আর কারোর সর্বনাশ।
কাজেই একটা ব্যাপারে ধারণা করা গেল যে আমার যে ফর্মে বিরিয়ানি খেয়ে থাকি সেটা পারস্য থেকে এসেছে বললে ভুল বলা হয়, কারণ তার ধরনধারন থেকে রন্ধনপ্রক্রিয়া - সব কিছুই ভারতে আসার পর অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। 'বিরিয়ানি' কথাটির উৎপত্তি হলে পারসি শব্দ 'বিরিয়ান' থেকে যার আক্ষরিক অর্থ ' Fried before cooking'। বর্তমানে গুগল অনুযায়ী বিরিয়ানির জন্মস্থান হিসেবে ভারত,পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরানের নাম পাবেন। তবে জন্ম যেখানেই হোক না কেন, তার বড় হওয়া এবং জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছানো কিন্তু আমাদের ভারতেই । কাজেই বিরিয়ানিকে ঘিরে আমাদের আবেগ যে এতটা লাগামছাড়া, এই বিষয়টাকে ঠিক অহেতুক বলা যায় না। চলুন এবার ওল্টানো যাক ইতিহাসের আরও কিছু পাতা।
সময়টা ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ। দিল্লী তখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। মসনদে তখন শাহজাহান। ১৬১২ সালে তার নিকাহ হয় মমতাজ মহল এর সাথে। হ্যাঁ, সেই মমতাজ মহল, যাঁর সমাধিতে শাহজাহান নির্মাণ করেন তাজমহল। প্রেমের অমর প্রতীক। মমতাজকে যদি আমরা তাজমহলের জন্য মনে রাখি তাহলে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে বর্তমান মুগলাই বিরিয়ানির স্রষ্টা সম্ভবত এই মমতাজ মহল নিজেই। যদি কখনো শাহজাহানকে গাল পেরে "বেশি আদিখ্যেতা" বলার কথা মনে হয়, তাহলে মনে রাখবেন ওনার বউই সম্ভবত বিরিয়ানি আবিষ্কার করেছিলেন।
ঘটনাটা ঘটে, যখন মমতাজ মহল একবার মুঘল সেনাদের ছাউনি দেখতে যান। সেখানে সৈন্যদের রুগ্ন স্বাস্থ্য দেখে তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। সেনা দুর্বল মানেই দেশ বিপদে। তাই তিনি তলব করলেন মুঘল খানসামাদের। বেগমের নির্দেশে তৈরি হল এক অতি সুস্বাদু, উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাদ্য যেখানে থাকল চাল, গোস্ত আর বিভিন্ন রকমের মশলা। বিরিয়ানির বর্তমান চেহারার যাত্রা শুরু এখন থেকেই। বিরিয়ানি নামটির প্রচলনও মুঘল হেঁসেল থেকেই চালু হয়। মুঘল রাঁধুনিরা মশলা ব্যবহারের জাদুকর ছিলেন। আর সেই সময় পারস্য,ইরান,চিন থেকে প্রচুর মশলা ভারতে আসছে। এইসব অনুকূল পরিস্থিতি মিলেমিশেই মমতাজ মহল-এর অনুপ্রেরণায় তৈরি হল বর্তমানের বিরিয়ানি।
মুঘল শাহী হেঁসেলে খুব অল্প দিনের মধ্যেই প্রচুর নাম কামিয়ে নিল এই বিরিয়ানি। তারপর মুঘল খানসামাদের হাত ধরে এই সুখাদ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। বাদশা আওরঙ্গজেবের সময় হায়দরাবাদের নিজামের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকল। হায়দ্রাবাদ হয়ে উঠল মুঘল সংস্কৃতির একটি অনুপম নিদর্শন। নিজাম বরাবর খাদ্য রসিক ছিলেন। তাই মুঘল দরবারের শাহী বিরিয়ানি নিজামের প্রদেশেরও মূল আকর্ষণ হয়ে উঠতে শুরু করল। হায়দ্রাবাদে এসে কিন্তু বিরিয়ানি নিজের রূপ বেশ কিছুটা পরিবর্তন করে নিল। যোগ হল স্থানীয় মশলা। তাই হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি নিজের জন্য একটা বিশেষ জায়গা করে নিল যা কিন্তু মোগলাই বিরিয়ানি থেকে আলাদা। এখান থেকে আবার বিরিয়ানি ছড়িয়ে পড়ল অন্ধ্রতে। সেখানে মশলার পরিমাণ বাড়ল আর অন্ধ্র-বিরিয়ানির জন্ম হল। স্থানীয় ফেভারিট কারিপাতাও হয়ে উঠল বিরিয়ানির অঙ্গ।
হায়দ্রাবাদের মত মুঘল বিরিয়ানি আরো একটি জায়গায় প্রচুর সম্মান পায়, সেটা হলো অযোধ্যার নবাবদের কাছে। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই অযোধ্যার নবাবরা দিনে-দিনে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। লখনউ তখন সংস্কৃতি,কৃষ্টি, কলার এক অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠছিল। একের-পর-এক ইমারত তৈরি হচ্ছে নবাবদের নজরদারিতে। শুধু ইমারত নয়, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও দারুন শৌখিন ছিলেন লখনউয়ের নবাবরা। নবাব আসাদ-উদ-দৌলার সময় বিরিয়ানি একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে। আওয়াধি বিরিয়ানি কিন্তু স্বাদে, গন্ধে মোঘল বিরিয়ানির সমগোত্রীয়। যদিও মশলা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন খানসামারা, আর তাঁদের নিরন্তর উৎসাহিত করে চলেছেন নবাব।
সময়টা ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ। লখনউ-এর মসনদে বসলেন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ। সেই সময় মোঘল সম্রাট বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর দিল্লিতে টিম-টিম করে জ্বলছেন। বাংলাতে সিরাজকে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের খুঁটি মজবুত করে পুরো ভারতের দখল নেওয়ার অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে আছে। কিন্তু নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ এইসব রাজনৈতিক কূটকচালির উর্ধ্বে ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিল্পী। ১৩ টি ভাষা জানতেন। ১০৫ টি গজল লিখেছিলেন। এমন ক্ষণজন্মা মানুষ হয়তো ইতিহাসে হাতে-গুনে পাওয়া যাবে। কিন্তু রাজ্যপাট তাঁর জন্য ছিল না আর ইংরেজরা তারই সুযোগ নিল। বিভিন্ন অজুহাতে তাঁরা অবশেষে সরিয়ে দিলেন ওয়াজিদকে। উজিররা নবাবকে পালাতে বলেন। কিন্তু ওয়াজিদ অন্য ধাতুর তৈরি মানুষ ছিলেন। সাধে মানিকবাবু ওঁকে নিয়ে ছবি বানানোর কথা ভাবেন! যখন ইংরেজ এসে তাকে গ্রেপ্তার করলো,তখন উজিররা পগার পার। ওয়াজিদকে জিগ্যেস করতে তিনি হেসে বলেন, তাঁকে জুতো পরিয়ে দেওয়ার কেউ না থাকাতে তিনি আর পালাতে পারেননি। ইংরেজ সরকার ওয়াজিদকে কলকাতাতে গৃহবন্দি করে। সাধের লখনউ ছেড়ে নবাব পৌঁছান ব্রিটিশ-রাজধানী কলকাতাতে। তার সঙ্গীসাথীদের মধ্যে মুখ্য ছিল তাঁর প্রিয় ৮-১০ জন খানসামা। যতই বন্দী হোন না কেন, খাদ্যরসিক ওয়াজিদের খানসামাদের ছাড়া চলবে না কিছুতেই।
মেটিয়াবুরুজের কাছে বিচলি ঘাটে ১৮৫৬ সালে ওয়াজিদ আলী শাহের স্টিমার ভিড়েছিল। মনে মনে বোধহয় নিজের সাধের লখনউকেই সঙ্গে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন নবাব। তাঁর সঙ্গে ছিল বাবুর্চির দল, বাইজির দল, বাদক-গায়কদের দল, এমনকী কিছু পোষ্য প্রাণীও। বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা পেনশন ধার্য করে ইংরেজ সরকার। কিন্তু এতে কি আর নবাবের চলে? ব্রিটিশ আইন ব্যবস্থার উপর গভীর আস্থা ছিল নবাবের। তাই তিনি ঠিক করেন বিলেত গিয়ে স্বয়ং রানির সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু অনিয়মিত জীবনযাপনের জন্য তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় তাঁর চিকিৎসক তাঁকে জাহাজ সফর করতে দিতে রাজি হন না। এমত অবস্থায় ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহ হয় এবং ওয়াজিদের বেগম হজরত মহল লখনউতে ইংরেজদের বিরোধিতা করেন। কোপ এসে পড়ে নবাবের উপর। একে তাঁর শখ-আহ্লাদ মেটাতে গিয়ে বাৎসরিক আয় আর কুলাচ্ছে না - বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ঝাড়লণ্ঠনের মত নানা সামগ্রী; অন্যদিকে ব্রিটিশের সাথেও সদ্ভাব নেই। দিনে-দিনে মানসিক অবসাদে ডুবে যাচ্ছেন নবাব। এদিকে পারস্য থেকে রপ্তানি করা মশলা আর আসছে না নবাবি হেঁসেলে। খাবার ব্যাপারে একটা বিরাট দুর্বলতা ছিল নবাবের। শাহী খানসামারা বুঝতে পারছিল যে নবাবের মানসিক অবসাদের এটাও একটা বড় কারণ। কিন্তু আর্থিক সমস্যা থাকলে তাদের আর কী করার থাকতে পারে।
এই মাহেন্দ্রক্ষণেই জন্ম হয় আমাদের বাঙালি বিরিয়ানির। হালকা ফুরফুরে, কারণ বেশি মসলা দেওয়া যাবে না। মাংসের পরিমাণও কমাতে বাধ্য তারা। কী উপায়? কুছ পরোয়া নেহি - আলু হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। এইভাবে মুঘল বিরিয়ানিতে স্থান পেল বাঙালির প্রিয় আলু। সেই সময় আলু ছিল নবাবের খারাপ অবস্থার প্রতীক,কিন্তু কে ভেবেছিল যে আগামী ১৫০ বছরে সেই আলু শুধু বিরিয়ানির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই হয়ে উঠবে না, বরং বিরিয়ানির বাঙালিয়ানার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে! পরের অংশটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। নবাবের মৃত্যুর পর খানসামাদের চাকরি গেল। ততদিন কিন্তু কলকাতায় বাবু-শ্রেণির প্রতিপত্তি বাড়ছে ইংরেজদের সুনজরে থাকার জন্য। আর নবাবি খানাপিনার প্রতি তাঁদের প্রগাঢ় আকর্ষণ। শাহী খানসামারা খুলতে শুরু করল তাদের নিজেদের হোটেল। আর কি দেখতে দেখতে মোগলাই বিরিয়ানি হয়ে গেলো বাঙালির হট ফেভারিট।
হালকা মন খারাপ হচ্ছে কি? বিরিয়ানি আসলে ঠিক আমাদের নয় বলে? আরে মশাই ছাড়ুন তো! বিরিয়ানি আসুক যেখান থেকেই যে ভালোবাসা তাকে বাঙালি দিয়েছে তা হয়তো গোটা বিশ্বে কেউ দেয়নি। আর তার স্বীকৃতিস্বরূপ মোগলাই, হায়দরাবাদি বিরিয়ানির পাশে কলকাতা বিরিয়ানিও আজ একটি উজ্জ্বল নাম।
বিরিয়ানির গল্প এখানেই শেষ নয়। জানেন কি, বর্তমানে ভারতবর্ষে ৫০ রকমের বেশি প্রকারের বিরিয়ানি পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কাশ্মীরি, অন্ধ্র, মালাবার, বোম্বাই, থালাপাকাত্তি , মাঙ্গালোরের বিরিয়ানি বিখ্যাত। বিরিয়ানির দুটি প্রকারভেদ - কাচ্চি আর পক্কি। কাচ্চি হলে মাংস আর ভাত সম্পূর্ণ এক সাথেই রান্না হবে, আর পক্কি হলে মাংস আর ভাত আলাদা রান্না হয়ে পরে মিশ্রিত হবে। দিল্লিতে বিখ্যাত বিরিয়ানিতে গোটা মশলা বা 'খারি মশালে' দেওয়া থাকে, আবার লখনউতে মশলা মুখে পড়তে পারবে না। কেশর দিয়ে তৈরী হয় জাফরানি বিরিয়ানি আর দুধ দিয়ে তৈরি হয় মোলায়েম, নাজুক সুফিয়ানি বিরিয়ানি। মালাবার বিরিয়ানিতে দেখা যায় পর্তুগিজ রান্নার কিছু প্রভাব। ব্যাঙ্গালোরের হস্কুটে আনন্দ দম বিরিয়ানি খেতে লোকে লাইন দিতে শুরু করে ভোর ৫টা থেকে। দেশভাগের পর ঢাকার বিরিয়ানি বা পেশাওয়ারের বিরিয়ানি কোথাও যেন মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করে আমাদের পড়শী দেশগুলোর সাথে নিরন্তর বিভেদ। তবে যতই প্রকার ভেদ থাকুক না কেন এটা জেনে রাখা ভালো যে বাস্তবে ভেজ বিরিয়ানি বলে কিছু হয় না। এটা স্রেফ একটা oxymoron।
পড়ুন খাদ্য ও খাদ্যবিলাস নিয়ে সিলি পয়েন্টের সিরিজ 'রসিয়ে কষিয়ে'
আসলে বিরিয়ানি এখন একটা আবেগের নাম। জাতি, ধর্ম, বিভেদ, ঘৃণার বিভেদরেখা ছাপিয়ে আজ বিরিয়ানি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটা চমৎকার নিদর্শন। আর শুধু হিন্দু-মুসলিম কেন, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন বা বার্লিন, এমনকি চিনের বিয়েবাড়ির মেনুতেও স্থান করে নিচ্ছে আমাদের বিরিয়ানি। ছোটবেলা থেকে 'unity in diversity' কথাটা পড়ে এসেছি কিন্তু হয়তো একমাত্র বিরিয়ানিতেই আমরা এই বাক্যটির সত্যিকারের প্রতিফলন দেখতে পাই। ফলে সিজিদ্দা যতই বলুন না কেন, বিরিয়ানি কিন্তু আমাদের জন্য লাক্সারি নয় - বরং আমাদের বেঁচে থাকার ও ভালো থাকার এক দুর্নিবার প্রকাশ।
তাই বলি, অনেক হয়েছে ডায়েটের কচকচানি, আজ রাতে হয়ে যাক বিরিয়ানি।
..................
#Biryani #Mughal Empire #বিরিয়ানি #silly পয়েন্ট