বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

নক্ষত্রপুঞ্জের বিভা হয়ে আছেন প্রথম ভারতীয় মহিলা পদার্থবিদ

অনিন্দ্য পাল May 11, 2021 at 6:14 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

....................................

গত শতাব্দীর কথা। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ সিসিল ফ্রাঙ্ক পাওয়েল পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন, পাইয়ন (Pion) নামে একটা সাব-অ্যাটমিক কণা আবিষ্কার করার জন্য। পুরষ্কার পাওয়ার পর বিজ্ঞানী পাওয়েল তাঁর লেখা ‘দি স্টাডি অফ এলিমেন্টারি পার্টিকেলস বাই দি ফটোগ্রাফিক মেথড’ বইতে এক জায়গায় লিখছেন, “... the physical basis of their method was correct and their work represents the first approach to the scattering method of determining momenta of charged particles by observation of their tracks in emulsion.” এই লেখাটুকু পড়ে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়, পাওয়েল তাঁর নোবেলজয়ী কাজের জন্য কারও কাছে ঋণী। পুরো বইটি পড়লে জানা যায়, সত্যিই তিনি ভারতবর্ষের দুই আপাতবিস্মৃত বিজ্ঞানীর গবেষণার পথ ধরেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁদের একজন, দেবেন্দ্রমোহন বসু আর অন্যজন তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরী। 

ভারতবর্ষে তেজস্ক্রিয়তা আর নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক গবেষণার সূচনা হয় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগ্নে  দেবেন্দ্রমোহনের হাত ধরে। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি করে ফিরে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে তিনি মেঘ-প্রকোষ্ঠ (ক্লাউড-চেম্বার) নিয়ে গবেষণার গোড়াপত্তন করেন। এই গবেষণার উৎসাহ তিনি পেয়েছিলেন কেম্ব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে কর্মরত সি.টি.আর উইলসনের কাজ দেখে। ১৯২৩ সালে নাইট্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভাজন-প্রক্রিয়ার মেঘ-প্রকোষ্ঠে তোলা ছবি নেচার পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই ছবি দেখে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের জনক লর্ড রাদারফোর্ড তাঁকে প্রশংসা করে চিঠি পাঠান। ১৯৩৭ সালে আচার্য জগদীশচন্দ্র অবসর নিলে ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিরিশ বছর বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তার পদ অলনহকৃত করেন শ্রী দেবেন্দ্রমোহন বসু। আর দেবেন্দ্রমোহন এই দায়িত্ব নিয়ে আসার পরই বিভা চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর গবেষণায় একটা নতুন দিগন্ত তৈরী হয়েছিল।

বিভা চৌধুরী ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন বসুর শাশুড়ি, বিখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের স্ত্রী নির্মলা সরকারের বোন ঊর্মিলার তৃতীয় সন্তান। ১৯১৩ সালে তার জন্ম হয় কলকাতায়। বিভার বাবা ছিলেন, বিখ্যাত চিকিৎসক বঙ্কুবিহারী চৌধুরী। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়েছিলেন বিভা। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সম্মান অর্জনকারী তৃতীয় মহিলা। বিভার ইচ্ছা ছিল গবেষণা করার, সেই লক্ষ্যে তিনি একটি মর্নিং স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। স্কুলটি সম্ভবত রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পুরনো স্কুল, ‘সুনীতি শিক্ষালয়’। মেয়েদের এই স্কুলে সকালে পড়িয়ে গবেষণার জন্য চলে যেতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনতে যতটা মনে হয়, বাস্তব ছিল তার থেকেও কঠিন। স্নাতকোত্তর পাশ করার পর বিভা এসেছিলেন দেবেন্দ্রমোহন বসুর কাছে, তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত পালিত প্রফেসর। বিভার গবেষণা করার ইচ্ছা শুনে তিনি বলেন, “মেয়েদের দেবার মত কোনো কাজ আমার কাছে নেই”। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। সেই সময় ভারত কেন, সমস্ত পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা করা মহিলার সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু বিভার আগ্রহ আর নাছোড় মনোভাবের কাছে দেবেন্দ্রমোহন হার মানলেন। পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রমোহন যখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দায়িত্ব নিয়ে চলে আসেন, সেই সময় বিভা সেখানে এসে কণা পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। দেবেন্দ্রমোহনের অন্যতম কৃতী ছাত্র হরপ্রসাদ দে-এর উপর ভার পড়ে বিভাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিষয়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবার। প্রসঙ্গত, এই হরপ্রসাদ দে-কে বলা হত “এক্সপেরিমেন্টাল হ্যান্ড অফ ডি এম বোস”।

বিভা চৌধুরীকে এখানে “কসমিক রে” বা মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব দিলেন দেবেন্দ্রমোহন। কিন্তু মাটির কাছাকাছি মহাজাগতিক রশ্মি খুব কম পরিমাণে আসে, কারণ বায়ুমন্ডল তাদের গতিপথে বাধা দেয়। তাই গবেষণার জন্য বিভা এবং হরপ্রসাদ চলে গেলেন দার্জিলিং, সান্দাকফু এবং ফারিজং-এ। কসমিক রে কী? মহাবিশ্বে নানা ঘটনায় অনেক প্রোটন-নিউট্রন বা অন্য মৌলিক কণা ও পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরি হয় এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাকাশে সুপারনোভা বিস্ফোরণ কসমিক রশ্মির একটা উৎস। এই মহাজাগতিক রশ্মির কণাদের গতিশক্তি খুব বেশি, তারা প্রায় আলোর বেগে চলাফেরা করে। আমাদের পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে এইরকম অসংখ্য কণা ধাক্কা মারছে, কিন্তু বায়ুমণ্ডল থাকার জন্য তারা সরাসরি মাটিতে নেমে আসতে পারে না। বায়ুমণ্ডলের অণু-পরমাণুদের সঙ্গে এই কণাদের সংঘর্ষে অনেক নতুন মৌলিক কণা তৈরি হয়।

যাই হোক, সান্দাকফু এবং ফারিজং-এর ২১৩০-৩৬৬০ মিটার উচ্চতায় তাঁরা ফটোগ্রাফিক প্লেট নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সেখানে তাঁরা ইলফের্ড R-২ এবং হাফটোন ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলোকে কসমিক রে বিকিরণের স্রোত খাওয়ালেন প্রায় পাঁচ মাস ধরে। সান্দাকফুতে সাধারণ লঘু চাপের বায়ুতে এবং ২০ সেমি জলের নীচে এক গুচ্ছ করে প্লেট রাখা হয়েছিল। আর তিব্বতের ফারজিং-এ একগুচ্ছ প্লেট রাখা ছিল পোস্ট অফিস বিল্ডিং-এর আড়াই ফুট পুরু কাদা আর কাঠের তৈরি ছাদের নীচে। 


আরও পড়ুন : কলেজের গণ্ডি পেরোননি করোনাভাইরাসের আবিষ্কর্তা / সিদ্ধার্থ মজুমদার

বিভা ও দেবেন্দ্রমোহন এই পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দুই ধরনের ভর পেলেন। একটার মান ইলেকট্রনের ভরের দুশো গুণের কাছাকাছি, অন্য একটা মান তিনশো গুণের কাছাকাছি। এখন আমরা বুঝেছি যে তাঁরা দুই ধরনের কণা দেখেছেন কিন্তু তাদের পুরোপুরি আলাদা করতে তাঁরা পারেননি, ভর নির্ণয়েও অনেকটা ত্রুটি ছিল। তাঁদের পরীক্ষা থেকে দেখা গেল, বেশি ভরের কণাগুলো পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বেশি। এই বিষয়ে পরপর কয়েকটি গবেষণাপত্র তাঁরা প্রকাশ করলেন। কয়েক বছর পরে ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনে সিসিল পাওয়েল ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে দুই ধরনের মেসন আলাদা করে পান। ভর মাপার জন্য তিনি বিভাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিই ব্যবহার করেন, তবে পদ্ধতিটা তিনি নিজেই বার করেছিলেন। আসলে বিভাদের ফটোগ্রাফিক প্লেটেই প্রথম ধরা দিয়েছিল পাইয়ন ও মিউয়ন (Muon), এই দুই ধরনের কণা। পাইয়নের ভর ইলেকট্রনের ভরের ২৭৩ গুণের কাছাকাছি, অন্যদিকে মিউয়নের ভর হল ইলেকট্রনের ভরের ২০৭ গুণ। পাইয়ন হল বিজ্ঞানী ইউকাওয়ার প্রস্তাবিত কণা, সে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে পীন বলের মাধ্যমে ক্রিয়া করে। মিউয়নরা পীন বলে অংশগ্রহণ করে না। পাওয়েল এও দেখালেন যে পাইয়ন ভেঙে মিউয়নের জন্ম হয়। ফটোগ্রাফিক প্লেটের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণার পদ্ধতির উন্নতি ঘটানো ও তার সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের মেসন আবিষ্কারে জন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ইউকাওয়া নোবেল পেয়েছিলেন তার আগের বছর।

আরও পড়ুন : গোটা একটা নক্ষত্র সম্প্রদায় আবিষ্কার করেও নোবেল-উপেক্ষিতা জোসেলিন বার্নেল / অর্পণ পাল

১৯৪৫ সালে বিভা চৌধুরী ম্যাঞ্চেস্টার যান, সেখানকার মহাজাগতিক রশ্মি গবেষণাগারে প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের সাথে যোগ দিয়ে শুরু করেন গবেষণা। সেখানে তাঁর গবেষণাপত্র “Extensive air showers associated with penetrating particles” জমা দেন ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে। এর তিন বছর পরে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তৎকালীন সময়ে একজন মহিলা হিসেবে তাঁর এই কর্মকাণ্ড সাড়া ফেলে দেবার মতোই ছিল। ম্যাঞ্চেস্টারের  স্থানীয় পত্রিকা, ‘মর্নিং হেরাল্ড’ বিভা চৌধুরীর গবেষণার কাজ ও সাক্ষাৎকারকে “Meet India's New Woman Scientist- she has an eye for cosmic rays”- এই নামে প্রকাশ করেছিল। বিভা চৌধুরীই ছিলেন টাটা ইনস্টিটিউটের প্রথম মহিলা গবেষক। ১৯৪৯-১৯৫৭ এই আট বছর তিনি টাটা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে আমেদাবাদে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্য আসেন বিভা চৌধুরী। তখন বিক্রম সারাভাই ছিলেন সেখানকার প্রধান। এসময়ে বিভা কোলার গোল্ড ফিল্ডস-এর ওপর গবেষণারত ছিলেন, কোলার সোনার খনির ভিতরে নেমেও মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত বিক্রম সারাভাই মারা যাওয়ার পর বিভাকে তাঁর পরিকল্পিত কাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়েই তিনি স্বেচ্ছাবসর নেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবনের শেষের দিকে তিনি সলিড স্টেট ডিটেক্টর ব্যবহার করে ভারী কণা সংক্রান্ত গবেষণা করেছিলেন। অবসর নেওয়ার পরেও কলকাতায় ফিরে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে তিনি অতিথি গবেষক হিসেবে উচ্চশক্তির কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে রিসার্চের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন।

আরও পড়ুন : কোশ গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপিকা অর্চনা শর্মা / স্বপন ভট্টাচার্য

১৯৯১ সালের ২রা জুন তাঁর মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগেও নেচার পত্রিকায় তাঁর পেপার ছাপা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন, প্যারিসে একটা বিশেষ ঘোষণা করে। ঘোষণাটা ছিল, পৃথিবী থেকে ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরে আবিষ্কার হওয়া সেক্সট্যান নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত একটি নক্ষত্রের পরিবারে পৃথিবীর মত গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেই গ্রহের নাম দেওয়া হয়েছে, সন্তোমশা। আর সেই নক্ষত্রটির নাম? বিভা লাইটবিম।

.......................................... 

[সিরিজ পোস্টার : অর্পণ দাস]  

#বিজ্ঞান #প্রযুক্তি #বিভা চৌধুরী #দেবেন্দ্রমোহন বসু #বিজ্ঞান By নারী #সিরিজ #series #নিবন্ধ #Cosmic Ray #মহাজাগতিক রশ্মি #অনিন্দ্য পাল #সিলি পয়েন্ট #silly পয়েন্ট #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

49

Unique Visitors

215831