নিবন্ধ

'নিশীথে'-র আগে-পরে

নির্মাল্য কুমার ঘোষ Aug 30, 2020 at 1:11 pm নিবন্ধ

ওঁরা থাকে ওপারে: অষ্টম কিস্তি


১. রবীন্দ্রনাথের 'নিশীথে' গল্পটা তো আপনাদের সকলেরই পড়া। জমিদার দক্ষিণাচরণের প্রথমা স্ত্রী, যিনি অসুস্থ ছিলেন, তিনি ভুল ওষুধ খেয়ে মারা গেলেন। দক্ষিণাচরণ বিয়ে করলেন পূর্বপরিচিতা মনোরমাকে। এরপর থেকে যখনই ঘনিয়ে ওঠে মনোরমার সঙ্গে দক্ষিণাচরণের মিলন-মুহূর্ত, তখনই উদ্যত তর্জনী নিয়ে বারবার তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ান প্রথমা গৃহিণী! এই গল্পের মূল বিষয়বস্তু কী? সহজ করে বলতে গেলে, অতীতে করা-অপরাধ, তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভূতের মনোবিকারের রূপ ধরে। স্ত্রীর মৃত্যুতে দক্ষিণাচরণের কতখানি হাত ছিল, কেন একে আমরা "অপরাধ" বলতে পারি, সেসবের বিস্তারিত আলোচনায় নাই বা গেলাম!মনে আছে তো, আদ্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক এই গল্পকে সুকুমার সেন মশাই "ভূত-ছাড়া-ভূতের গল্প" বলেছিলেন? আমরা শুধু একটা কথাই বলতে পারি। রবীন্দ্রনাথের এই গল্পের "প্লট" কিন্তু অন্তত সেই আমলে খুব নতুন কিছু ছিল না! "নিশীথে" গল্পের যেমন উত্তরসূরি আছে, তেমনি আছে পূর্বসূরিও। প্রথমে উত্তরসূরির কথা। অন্তত এক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ত্রৈলোক্যনাথ |

২. ১৩১৫ বঙ্গাব্দে ছাপা হয় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'পাপের পরিণাম'। তার মুখ্য দুই চরিত্র সোনা-বউ আর কালাবাবা, যারা একসময় "রাজাবাবু"-কে মারতে চেয়েছিল, পরে তারাই সর্বত্র রাজাবাবুর "ভূত" দেখতে থাকে। এই দেখার মানসিক রসায়নটুকু খোলসা করে দেন গল্পের কথক -

"নিদ্রিত নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করিতে ইহারা উদ্যত হইয়াছিল। সে লোক একজনের স্বামী অপরজনের প্রাণরক্ষাকর্তা। এই দুষ্কর্মের চিন্তা সর্বদাই তাহাদের মনে জাগরিত ছিল। সুতরাং রাজাবাবুর আকৃতি সর্বদা তাহারা মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ দেখিত। ..... রাজাবাবুর ভূতকে দর্শন করে নাই, তাহাদের বিকার প্রাপ্ত মনঃসম্ভূত ছায়া দেখিত মাত্র।"
ভূতের গল্প যে আদতে ভূতের নয়, তা যে খুব গভীর-গোপন মনস্তত্ত্বের গল্প, ভাবতেও অবাক লাগে, কত আগে, সেই বিশ শতকের গোড়াতেই, ত্রৈলোক্যনাথ-রবীন্দ্রনাথরা তার সুলুক-সন্ধান করে ফেলেছিলেন

৩. উত্তরসূরি যেমন ত্রৈলোক্যনাথ, তেমনি পূর্বসূরি কালীপ্রসন্ন ঘোষ। কালীপ্রসন্ন ঘোষকে আজ আমরা ভুলে গেছি। এই ভদ্রলোক বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধু ছিলেন। 'বান্ধব' বলে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১২৮১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় থেকে ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এই 'বান্ধব' পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে পাশ্চাত্যের প্রেত-দর্শনের বিভিন্ন আখ্যান রচনা করেছিলেন কালীপ্রসন্ন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দ থেকে "ছায়া-দর্শন" নাম দিয়ে এই আখ্যানগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। তাতেই মিলবে একটি কাহিনি - "প্রেম সমুদ্রে প্রাণনাশি বিষ"। ইংল্যান্ডের কৃষিপল্লীর "প্রধান শিকার-রক্ষক" হান্ট কোনও এক "গ্রাম্যবিলাসিনী"র প্রতি অনুরাগবশত অবহেলা করে নিজের যুবতী স্ত্রীকে। অনাদরে, অবজ্ঞায়, রোগশয্যায় মারা যায় গৃহিণী। হান্ট বিবাহ করে মনোনীতাকেই। তারপরই নবপরিণীতা পত্নীর সঙ্গে মিলন-মুহূর্তে দেখা দিতে থাকে অবহেলিত গৃহিণীর প্রেত!! "ঐ ত আমার স্ত্রী, ঐ ত এল -ঐ ত এল" - ক্রমাগত এ-কথাই বলতে থাকে অপ্রকৃতিস্থ হান্ট! 'বান্ধব' পত্রিকা রবীন্দ্রনাথের কাছে একেবারে অপরিচিত ছিল না। কালীপ্রসন্নর এই গল্পই কি ফিরিয়ে লিখবেন রবীন্দ্রনাথ? পার্থক্য শুধু এই যে, 'নিশীথে' গল্পে দক্ষিণাচরণ, বারবার শুনতে পেয়েছেন পরলোকগতা গৃহিণীর মনোরমা-কেন্দ্রিক উদ্বেগাকুল উচ্চারণ - 'ও কে, ও কে, ও কে গো ?"

#ওঁরা থাকে ওপারে #নিবন্ধ #ধারাবাহিক নিবন্ধ #নির্মাল্য কুমার ঘোষ #Silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

219140