মুক্তগদ্য

বাগাল ও সেই আদিবাসী ছাত্রাবাসটি: এক লাল-মাটির গঞ্জ-শহরের গল্পকথা

রূপা সেনগুপ্ত Aug 28, 2020 at 4:33 am মুক্তগদ্য

আমোদপুর বা আহমদপুর :

বীরভূম জেলার এই গঞ্জ শহরটায় শীত দিনের শেষে যেন একটু তাড়াতাড়িই পড়ে যায়। বিকেল তিনটে মানেই মনে হয় সবাই বুঝি উঠোনে কাঠের উনুন জ্বালিয়ে রান্না শুরু করে দিয়েছে। চারদিকে পাতলা ধোঁয়া আর ব্লক ক্যাম্পাসের রাস্তার হলুদ আলোগুলোকে কে যেন আস্তে আস্তে ঘন অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তারপর সূর্যটা ঝুপ করে এক্কেবারে ডুব দেয়। এই পুরো দৃশ্যটা সদ্য আমোদপুরে পৌঁছে আমাকে বড্ড মায়াবী করে তুলেছিল।

সালটা ১৯৯৪ ; ছেলের বয়স মাত্র চার মাস। সেটা ছিল এমনই এক শীতকাল। জানুয়ারি মাসের তেইশ তারিখ। বর বিডিও সাহেব। ছোট শিশুপুত্র আর বৃদ্ধ বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেছি লাল-মাটির গঞ্জ-শহরটিতে। পেতেছি নতুন সংসার। কলেজ জীবনে বাম-রাজনীতি করা আমার কানে ওই 'সাহেব' কথাটা কট করে বাজত। সাদাসিধে সরল ধুলোমাখা শ্যাম যখন শনিবার সকালে এসে একগাল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বলত - “সাহেব বুলেছিলেন বাথরুম পায়খানাটো পরিষ্কার করে দিতে, দুবো?” বুঝতাম ওকে আমার কলেজী বিদ্যা ফলানো বৃথা। আমি কিছু বলার আগেই উত্তরা পিছন থেকে মুখ বাড়িয়ে বলত - “দাঁড়া কেনে, টুসকিপারা জল দিয়ে কী হবেক, আগে তু দু-বালতি জল ভরে লিয়ে আয় গা।”

 উত্তরার কথা:

 উত্তরা আমার লোকাল গার্জিয়ান। ও আমার সব কাজে সাহায্য করে। অত্যন্ত স্নেহময়ী । দোষের মধ্যে একটু পাড়াবেড়ানি।

উত্তরা কাঠুরিয়া! আমার চোখ কপালে। এমন পদবি তো কখনো শুনিনি আমাদের শহরে। ওই বোঝাল, “শোনো, আমরা বাউড়ি বটে, কাহার বাউড়ি।” আমার তখন এই বর্ণবিভাজন জ্ঞান এক্কেবারে শূন্য।  আমাদের শ্রীরামপুর শহরে আমি বর্ণভেদের কিছুই টের পাইনি তেমন করে। মাল-বাগদি-বাউড়িদের কথা বা তাদের দিনযাপন, তাদের জীবন-জীবিকা সবই আমার অজানা। 

সন্ধ্যে হলে উত্তরা খুব জমিয়ে মুড়ি মাখত। এই মুড়ি দিতে লাভপুর থেকে এক মাসিমা আসতেন ছোট লাইনের ট্রেনে চেপে। আমোদপুরে তখন টিন হিসেবে মুড়ি বিক্রি হত। চুরানব্বই সালে যতদূর মনে পড়ে, এক টিন মুড়ির দাম ছিল আঠেরো টাকা। উত্তরা কোমর বেঁধে ময়দানে, হাতে একটা সরু ভাঙা ছোট কোন গাছের ডাল। মাসিমা বস্তা থেকে মুড়ি ঢালছেন, উত্তরা লাঠি দিয়ে টিন পিটিয়ে পিটিয়ে যতটা সম্ভব ঠেসে ভর্তি করা যায়, করে নিচ্ছে। আমি তো হতবাক, লজ্জিত। ও আমায় প্রায় চোখ পাকিয়ে বলল- “দাঁড়াও কেনে, ই ভাবেই লিতে হয়।” তারপর দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা মাঝারি সাইজের গামলা নিয়ে এসে বলল- “মাসি ফাউটো ইটোয় দাও। বৌদির তো লতুন সমসার। ইর পর থিকে ছুটো কৌটোতে রিখে দুবক।” অর্থাৎ কিনা এক টিন মুড়ির সাথে এক ছোট কৌটো মুড়ি ফ্রি।

উত্তরা প্রথমে ঢুকেই একটা কথা প্রায় অনুরোধের গলায় বলেছিল - “আমাকে তুমরা ছেড়ে দুবেক লাই তো?” হায় কপাল! ওতো জানে না যে আমি উল্টো ভাবনায় আতঙ্কিত। আমি ভাবছি, এর আবার হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে না তো? রাত্রে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমার বর জানায় যে উত্তরার বাবা এসেছিলেন অফিসে, বলেছেন ও বিবাহিতা। একটা দু-বছরের বাচ্চা মেয়ে ওর আছে, শ্বশুরবাড়িতে। ওর শাশুড়ি ওকে একা বাবার ঘরে ফেরত রেখে গেছেন। ও মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত। সৎমায়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারছে না। ওর বাবার আশা, আমাদের বাড়িতে ক'টা বছর অন্তত ও একটা ভদ্রস্থ জীবন কাটাতে পারবে । আমরা যদি ওকে  রাত- দিনের জন্যও রাখি, ওঁর কোনও আপত্তি নেই। নেই কোন বিশেষ টাকার দাবি। 

এসব শুনে পাশের ঘরে বসা উত্তরার দিকে তাকিয়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ও দেখি তখন আমার ছেলের লম্বা চুলে ঝুঁটি বাঁধছে আর ভাব জমাচ্ছে। হয়তো মনে পড়ছে নিজের দু বছরের সন্তানের কথা।

উত্তরা এরমধ্যে বুঝে গেছে ওর ছোঁয়া জল আমাদের বাড়িতে 'অ-চল' নয়। এ-ও বুঝে গেছে, ও আমাদের সঙ্গে একই আসরে বসে ঠ্যাং ছড়িয়ে ভাত-মুড়ি খেতে পারে। আর তারপর থেকে বাবাকে, ও ‘বাবা’ বলেই সসম্মানে ডাকতে শুরু করল। 


বাগাল:

আমোদপুরের প্রকৃতি এমন সুন্দর! মন মাঝে মাঝে যেন নিজেই নিজের কাছ থেকে দূরে হারিয়ে যায়। এক-একদিন জোর করে উঠে পড়ি বিডিও সাহেবের জিপে। দেখতে পাই পর্ণমোচী হালকা অরণ্যের দীর্ঘ জঙ্গলের শেষে ঘন সবুজ মিশ্র বনভূমি। মাঝে সেই লাল মাটির রাস্তা। একদল মহিলা শুকনো পাতা বা গাছের ডাল ভেঙে গুছিয়ে মাথায় নিয়ে চলেছেন দূরের কোনও গ্রামে। মাঝে মাঝে রাস্তায় উঠে আসে একপাল গরু। পিছনে এক রাখাল বালক, যার সঙ্গে থাকা গরু তাড়ানোর লাঠিটা আমার কল্পনায় বাঁশি। 

ইতিহাসে বলে সরাইকেলা, ময়ূরভঞ্জ ইত্যাদি জেলার আদিবাসী মানুষেরা শিকারে যাওয়ার আগে নিজেদের উদ্দীপ্ত করতে পশুপাখিদের ডাক, চলন, লাফ ইত্যাদি অঙ্গভঙ্গিকে নকল করে নাচতেন। পরবর্তীকালে এই প্রথাই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ‘ছৌ নাচ’ নামে পরিচিত হয়। ছৌ নাচের জন্য আমাদের বাংলার আর এক রাঙামাটির জেলা পুরুলিয়া বিখ্যাত। যাই হোক, ছৌ নাচ এখানে আমার লেখার বিষয় নয়। 

সারাদিন মনিবের গরু চড়াতে নিয়ে যাওয়া প্রান্তিক আদিবাসী মানুষ, উত্তরার ভাষায় 'বাগাল', আমার ভাবনার বেশিরভাগ স্থান জুড়ে। কোথাও যেন আমি কল্পনায় এদের মধ্যে ছৌ শিল্পীদের ছায়া পাই। আমার কল্পনায় এরা বাঁশি বাজায়, এরা বাছুরের সঙ্গে তারই মত লাফিয়ে বেড়ায়, এরা কোকিলের ডাক নকল করতে পারে আর নিশ্চয়ই পারে বিড়ালের মত নিঃশব্দে হেঁটে নিজেদের পেট ভরানোর জন্য  বুনো মোরগ শিকার করতে। এদের কথা ভাবতে ভাবতে পার হই খানিকটা পথ। এটা তো আসলে তাদের জীবনের একটা আপাত আলোকিত দিক, বাকি দিকটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। 

এদের লেখাপড়া, এদের বাকি দীর্ঘ জীবন আমাকে চিন্তিত করত। অবশ্য আমি শুরুতে যে চিত্র দেখেছিলাম তার অনেকটা বদল আমি বীরভূমে থাকাকালীনই দেখে এসেছি। গ্রামের জীবিকা ছেড়ে এঁরা শহরে 'জন মুনিষ' খাটতে চলে গেছেন তখন অনেকেই। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন কৃষকজীবন। তখনই অনেকটা পাল্টে গেছে এঁদের জীবনযাপন। আমার ধারণা জাতীয় সড়ক, বিভিন্ন নদীর ওপর তৈরি সেতু, এই সবই গ্রামজীবনকে পাল্টাতে সাহায্য করেছে। এদের মধ্যে ঢুকেছে শিক্ষার আলো। কিন্তু সেটা তখনই কতখানি, তা আমি তখনও বুঝি নি।


আদিবাসী ছাত্রাবাস:

আমোদপুরের কাছেই একটা আদিবাসী আশ্রমিক ছাত্রাবাস ছিল। আমি সেখানেও বরের সঙ্গে  পৌঁছে গেলাম একদিন। গ্রামটার নাম কুসুমডিহি। এখানে এসে আমি প্রথম প্রথম গ্রামের নাম খাতায় টুকে রাখতাম। আমি তো মল্লিকপাড়া, মান্নাপাড়া, ঘোষপাড়া এই জাতীয় পদবি ধরে পাড়ার নাম; কিংবা ডাক্তারবাগান বা কুণ্ডুবাগান - এইসব নাম শুনে অভ্যস্ত। কুচুইঘাটা বলে একটা গ্রাম পেরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে যাওয়া বিডিও সাহেবের গাড়ির পিছনে আমি আর উত্তরা। সঙ্গে আমার কোলে ছেলে আর তার হাতে একটা ছোট স্টিলের গ্লাস। আমার ছেলেটা তখন খুব ছোট, ওই গ্লাসটা ছাড়া কোথাও যেতে চাইত না।

আসলে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করত যে কী রকম সংখ্যায় ছেলেরা থাকছে, কেমন তাদের বাসা, তাদের ভাল লাগা-না লাগা। ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। সুপারিনটেনডেন্ট বদি কোড়া। খুব হাসিমুখে আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। বেশ অনেকটা জায়গা ঘিরে ঝকঝকে তকতকে উঠোন, বাগান আর লম্বা বড় বড় খান দুই কী তিন পাকা ঘর নিয়ে একটা বাড়ি। তার গায়ে লাগানো একটা রান্নাঘর। বদি কোড়া দেখালেন, তাঁরা রান্নাঘরের সবজি ও মাছ ইত্যাদি ধোয়ার পর সেই জল সরু নালির মাধ্যমে বাগানে পাঠান। ওঁর কথা শুনে তাকিয়ে দেখলাম গাঁদা চন্দ্রমল্লিকায় বাগান ভরে আছে। আছে কিছু সবজি ও ফলের গাছও। আমার মন ভাল হয়ে গেল ওই সুন্দর বাগানটি দেখে। সেদিনও ছাত্রদের ঘরে প্রত্যেকের বই খাতার সঙ্গে একটা করে সেই মুড়ির টিন দেখতে পেলাম। প্রায় প্রতিটি ছাত্রই সঙ্গে করে এনেছে বাড়িতে ভাজা মুড়ি। এদের চাহিদা কম। খুব শান্ত ধীর। অভিযোগও হয়ত কম। এই ছাত্রদলের সঙ্গে আমি পরেও বনভোজন, ওখানকার স্থানীয় ভাষায় ‘পৌষলা’, করতে গেছি। 

ছাত্রদের ঘরের বারান্দা পেরিয়ে দুটো ঘর । এক ছাত্র বলল, কোনও অভিভাবক দূর থেকে দেখা করতে এলে ওই ঘরে থাকেন। অর্থাৎ কিনা আমাদের শহুরে ভাষায় ‘গেস্ট হাউস’। আমার খুব মনে আছে আমরা ওইদিন ছাত্রদের সঙ্গে বসেই দুপুরের ভাত খাই। জলের গ্লাস হাতে করে নিয়ে আসা একটা ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে বসে ভারী আমোদের সঙ্গে বাকি সব ছাত্ররা ভাত খেল। একটা কথা আমার মনে হল তখন, শিক্ষা নামক সূর্যের থেকে বিচ্ছুরিত ফোটনকণা এদের শরীরের রক্তকণিকায় যেন সালোকসংশ্লেষের মতোই খাদ্য তৈরি শুরু করেছে। তাদের পরিবার থেকে এত দূরে, মায়ের কোল ছেড়ে আসা এই আশ্রমিক জীবনে সেটাই তাদের বাঁচার রসদ। 

 বাড়ি ফেরার পর মনে হল, কোথাও কি দুজন মায়ের মাতৃত্ব হালকা করে পরস্পরকে ছুঁয়ে গেল? একজন মা, যিনি ছেলের সঙ্গে দেন নিজের হাতে ভাজা মুড়ি সমেত মুড়ির টিন; আর একজন মা যিনি ছেলের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ান একটা ছোট্ট স্টিলের গ্লাস? আমি ওই মায়েদের মন খুব সহজেই ছুঁতে পারি আজ। সেই দিনটির পর পেরিয়ে এসেছি প্রায় চব্বিশ বছর। সন্তানকে সামান্য কয়েকমাস দূরে ছেড়ে থাকার কষ্টে আমি বুঝেছি ছাত্রাবাসে পাঠানো ওই প্রায় কোলের ছেলেদের ছেড়ে থাকা মায়েদের মনোকষ্টটা ছিল ঠিক কতখানি।


[কভার ছবি ঋণ : ফারহান শাদিক, flickr.com] 

#আদিবাসী #আহমদপুর #গদ্য #লোকজীবন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

38

Unique Visitors

215814