অস্বস্তিকর এক আত্মসমীক্ষা: দ্য ফ্যালকন অ্যান্ড দ্য উইন্টার সোলজার
সিরিজ: দ্য ফ্যালকন অ্যান্ড দ্য উইন্টার সোলজার প্রযোজনা: মার্ভেল স্টুডিওজ সৃজন: ম্যালকম স্পেলম্যান পরিচালনা: কার্ল স্কগল্যান্ড অভিনয়: অ্যান্টনি ম্যাকি, সেবাস্টিয়ান স্ট্যান, ওয়াট রাসেল, এরিন কেলিম্যান, ড্যানিয়েল ব্রুল, এমিলি ভ্যানক্যাম্প প্রমুখ
মার্ভেল সৃষ্ট সুপারহিরোদের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, মার্ভেলের অতিমানবদের কিছু বিশেষ শক্তি থাকলেও তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ সময়েই আমাদের পারিপার্শ্বিক সমাজের অতিপরিচিত চরিত্রগুলির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়, যা তাদের ভক্তদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে। নিউ ইয়র্ক শহরের আর পাঁচটা হাইস্কুল পড়ুয়ার মতোই বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যাগুলোয় ভুগতে থাকা পিটার পার্কার তেজস্ক্রিয় মাকড়সার কামড় খেয়ে হয়ে ওঠে স্পাইডারম্যান, সমকামীদের প্রতি সমাজের অসংবেদনশীল আচরণ দেখেই স্ট্যান লি’র মাথায় আসে এক্স মেনের চরিত্রগুলোর কথা। প্রায় একবছর পর ভয়ঙ্কর কোভিড সংক্রমণের প্রথম ঢেউ কেটে যাবার পরে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অবলম্বন করে ফিরছে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স। বিপর্যস্ত পৃথিবীর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, ছোট মাপের পর্দার সঙ্গে তাল মিলিয়েই মার্ভেল সুপারহিরোরা যেন এবার আরো বেশি মানবিক। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অ্যাভেঞ্জার্সের তিন মহাবলী নায়কই বর্তমানে অনুপস্থিত- টনি স্টার্ক মৃত, স্টিভ রজার্স অবসর নিয়েছেন এবং অমিতশক্তিশালী থর গার্ডিয়ান্সদের সাথে বেরিয়ে পড়েছেন মহাজাগতিক নিরুদ্দেশ যাত্রায়।
ওয়ান্ডাভিশন ধারাবাহিক যেমন অতিমানবিক দুই প্রেমীকে ছোট্ট শহরের সাদাসিধে পাড়ায় এনে ফেলে, তেমন দ্য ফ্যালকন অ্যান্ড দ্য উইন্টার সোলজার সিরিজেও প্রাথমিক ঝাঁ চকচকে অ্যাকশন সিকোয়েন্সের পরেই আমরা দেখতে পাই, স্যাম উইলসন লোন নিয়ে জেরবার, পারিবারিক মাছধরা নৌকাটি বেচতে রাজি না হওয়ায় বোনের সঙ্গে তার নিত্যি খিটিমিটি লেগেই থাকে। ঘিঞ্জি মহল্লায় থাকা স্যামের জীবন আচমকাই আমাদের মনে পড়িয়ে দেয়, ফ্যালকন হিসেবে মহাশক্তিধর অতিমানবদের দলে তার ঠাঁই হলেও আদতে সে একজন কৃষ্ণাঙ্গ, তাই অবধারিত ভাবেই একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর মার্কিন নাগরিক। বাকির সঙ্গে তর্কাতর্কির সময় যখন হঠাৎ পুলিশ এসে কোনো কারণ ছাড়াই স্যামকে দোষী ঠাউরে বসে, আমাদের মনে পড়ে যায় সম্পূর্ণ অনুমানবশতঃ দোষী সাব্যস্ত হওয়া জর্জ ফ্লয়েডের উপর শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ডেরেক শভিনের নির্মম অত্যাচারের কথা, যার ফলস্বরূপ সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন। বাকি তৎক্ষণাৎ ফুঁসে উঠে পুলিশটিকে বলে, “আপনার কোনো ধারণা আছে আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন?” স্যামের পরিচয় পাবার পর পুলিশটি ক্ষমা প্রার্থনা করলেও প্রশ্ন থেকেই যায়, ফ্যালকনের জায়গায় একজন সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ থাকলে ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি মিটত কি?
মানুষে মানুষে বৈষম্যের কথা রয়েছে সারা সিরিজ জুড়েই। থ্যানোসের কালান্তক অঙ্গুলিহেলনের পরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল যেসব ব্যক্তি, তারা ফিরে আসায় নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছে বিরাট সংখ্যক মানুষ। এই বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঘিরে গড়ে ওঠে কার্লি মর্গেনথাউয়ের আন্দোলন, উদ্বাস্তুদের উপর সুপার সোলজার সিরাম প্রয়োগের মাধ্যমে সে তৈরি করতে চায় এক বিদ্রোহী সৈন্যদল। কিন্তু ব্যারন জিমোর কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সুপার সোলজার সিরামও প্রকৃতপক্ষে আরেক ধরণের বৈষম্যেরই জন্ম দেয়। কার্লির গলাতেও তাই শোনা যায় ভবিষ্যতের একনায়কতন্ত্রের বিভাজনমূলক সুর- “আমরা চিরকাল এই গ্রহে রয়েছি, কিন্তু সরকার খালি যেগুলো নতুন করে ফিরে এসেছে তাদের নিয়েই ভাবে”। কথাগুলোর সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য পাওয়া যায় ভারতবর্ষে ‘নবাগত’ মুসলিমদের প্রতি সরকারের তথাকথিত তোষণের বিরুদ্ধে ভারতের ‘আদি’ বাসিন্দা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জ্বালাময়ী অভিযোগের। আবার ব্যারন জিমোর নিজের বিরাট আর্থিক ক্ষমতার পিছনেও রয়েছে চরম বৈষম্যমূলক মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থা, এ সত্যও যেন আমরা ভুলে না যাই।
বাদ পড়েনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধ্বজাধারীদের আস্ফালনের কথাও। স্যাম স্টিভের ঢাল হস্তান্তর করবার পরে মার্কিন সরকার নতুন ক্যাপ্টেন আমেরিকা হিসেবে নির্বাচিত করে জন ওয়াকার নামক আফগানিস্তান ফেরত এক কুশলী মিলিটারি অফিসারকে। সচেতনভাবে টেনে আনা হয়েছে আফগানিস্তান ও ইরাকে বুশের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা। বন্ধুর মৃত্যুর পরে রাগের চোটে ওয়াকার যখন কার্লির এক সহকারীকে সর্বসমক্ষে ঢাল দিয়ে পিটিয়ে মারে, একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীকে দেখা যায় তা ভিডিও রেকর্ডিং করতে। অবধারিত ভাবেই দর্শকের মনে পড়ে যায় ইন্টারনেট ছড়িয়ে যাওয়া আবু ঘ্রাইবে বন্দি সন্দেহভাজনদের উপর মার্কিন সেনা অফিসারদের নির্মম উৎপীড়নের ক্যামেরাবন্দি দৃশ্য। ছবিগুলিতে নির্যাতনকারীর ভূমিকায় প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমান চার্লস গ্রেনার ও লিন্ডি ইংল্যান্ড প্রভৃতি একাধিক মিলিটারি অফিসারকে কোর্টমার্শালের পরে বাহিনী থেকে বিতাড়িত করা হয় বটে, কিন্তু ‘ইউ আর ঈদার উইথ আস, অর এগেনস্ট আস’ বলা রাষ্ট্রপতি বুশ বা ‘শিট হ্যাপেনস’ এর মত চরম অসংবেদনশীল মন্তব্য উচ্চারণ করা বিদেশমন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের মত আসল খলনায়কদের গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। তাই বিচারাধীন জন ওয়াকার যখন উচ্চপদস্থ সেনানায়কদের সামনে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘আমাকে আপনারাই তৈরি করে এখন মুখরক্ষার জন্য ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন’, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার চিরকেলে বৈষম্যের কথা। প্রসঙ্গত, ওয়াকারের বন্ধু লেমার একজন কৃষ্ণাঙ্গ, কিন্তু আফগানিস্তানকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খেলায় অংশ নিয়ে বাহবা কুড়োতে সেও বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। ক্ষমতা বড়োই বিপজ্জনক জিনিস, সাগিনা মাহাতো অনেকদিন আগেই দেখিয়ে দিয়ে গেছে।
সিরিজের অন্তিম এপিসোডে স্যাম উইলসনের নতুন ক্যাপ্টেন আমেরিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ তাই এত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রধান সুপারহিরোর তকমা গায়ে সেঁটেও সে নিজস্ব বিবেচনাবোধ বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয় না, বরং সর্বসমক্ষে জননেতাদের মৃত কার্লির যুক্তিগুলো ঠাণ্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করে। স্যামের কোনো বিশেষ সুবিধা নেই, সে শ্বেতাঙ্গ নয়, জন্মগতভাবে অতিমানবিক নয়, এমনকি অ্যাভেঞ্জার্সের প্রথম সারির সদস্যও নয়। তার মূলধন শুধু মানুষে মানুষে বিভেদ ঘুচিয়ে সমন্বয় সাধনের ঐকান্তিক ইচ্ছা। স্যামের উদ্যোগেই মিউজিয়ামে স্থাপিত হয় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সুপার সোলজার ইজায়া ব্র্যাডলির মর্মর মূর্তি, পুনরুদ্ধার ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়ের। পারিবারিক নৌকাটি শেষ অবধি বেচবে না বলেই ঠিক করে স্যামের বোন, সে বুঝতে পেরেছে এই নৌকা আসলে কৃষ্ণাঙ্গদের আত্মাভিমানের সঙ্গে সমার্থক, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতীক। পরিশেষে দেখা যায়, উইন্টার সোলজার হিসেবে সম্মোহিত অবস্থায় খুন করা এক যুবকের বাবার কাছে সরাসরি গিয়ে কৃতকর্ম স্বীকার করে বাকি, মুক্তি পায় অবিরাম বিবেক দংশনের হাত থেকে। দিনের পর দিন অত্যাচারিত নেটিভ আমেরিকান, কৃষ্ণাঙ্গ, চিনা অভিবাসী প্রভৃতিদের কাছে এভাবেই কি একদিন সরাসরি নিজের অপরাধ স্বীকার করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? কল্পনা করতে বড্ড ইচ্ছে করে!
বাকির ভূমিকায় ভালো অভিনয় করেছেন সেবাস্টিয়ান স্ট্যান, তবে স্যাম উইলসনের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে সত্যিই চমকে দিয়েছেন অ্যান্টনি ম্যাকি। জন ওয়াকারের ভূমিকায় ওয়াট রাসেল সুন্দর, বিশেষ করে বিচারালয়ের দৃশ্যে তার অভিব্যক্তি মন ছুঁয়ে যায়। ড্যানিয়েল ব্রুল যথারীতি দুর্দান্ত, তবে আলাদা করে বলতে হবে শ্যারনের চরিত্রে ঝকঝকে এমিলি ভ্যানক্যাম্প এবং বীতশ্রদ্ধ ইজায়া ব্র্যাডলির ভূমিকায় কার্ল লুম্বলির মর্মস্পর্শী অভিনয়ের কথা। তবে কার্লি মর্গেনথাউয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে এরিন কেলিম্যানের অভিনয় খুবই সাদামাঠা লাগে। ম্যালকম স্পেলম্যান সিরিজের বিষয়বস্তু দারুণ সাজিয়েছেন, কিন্তু কার্ল স্কগল্যান্ডের পরিচালনা আরেকটু ভালো হলে হয়তো বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য কাটছাঁট করে সিরিজটিকে আরো গতিশীল করে তোলা যেতে পারত। আলাদা করে মনে দাগ কাটতে পারেনা হেনরি জ্যাকম্যানের আবহসঙ্গীতও। শেষ এপিসোডে ইউ.এস এজেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জন ওয়াকারের ক্রিয়াকলাপ এবার কোন পথে যায়, তা দেখতে মুখিয়ে থাকবে মার্ভেলের ভক্তকুল। বিশ্বাস করতে ভীষণ ইচ্ছে হয়, পর্দায় কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাপ্টেন আমেরিকাকে দেখানোল পাশাপাশি চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী ট্রাম্প সরকারের হাত থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার বাস্তব পৃথিবীতেও সত্যিই হাঁটবে মৈত্রীর পথে, মিলনের পথে।