ব্যক্তিত্ব

সারাজীবন বিতর্ক পিছু ছাড়েনি অমৃতা শেরগিলের

অরণ্যবহ্নি মজুমদার Sep 16, 2020 at 4:40 am ব্যক্তিত্ব

প্রচণ্ড প্রতিভার পাত্র উপচে গেলেই কি বিতর্ক জন্মায়? এ দুয়ের নিয়ত সহাবস্থান অন্তত সেরকমই সাক্ষ্য দেয়।

“Naked came I out of my mother’s womb and naked shall I return there….” তাঁর ব্যক্তিজীবন ও শিল্পকলা নিয়ে প্রবল বিতর্কের উত্তরে সপাটে বলেছিলেন অমৃতা শেরগিল। বিতর্ক তাঁকে তাড়া করত, নাকি তিনিই বিতর্ককে তাড়া করতেন বলা মুশকিল। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আমেরিকার জর্জিয়া ও’ কাফে আর মেক্সিকোর ফ্রিডা কালহোর পরেই চিত্রশিল্পী হিসেবে যে ফিমেল আইকনের নাম একবাক্যে উঠে আসে তিনি নিঃসন্দেহে অমৃতা শেরগিল। ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রকলাকে গোটা বিশ্বের দরবারে যারা পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অমৃতার নাম একেবারে শুরুর দিকেই আসবে। তুলির টানের মতো ব্যক্তিজীবনেও অমৃতা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ছকভাঙা। প্রচুর কুর্নিশ। প্রচুর মিথ। প্রচুর নিন্দা। আর এই সবকিছুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাত্র উনত্রিশ বছরের অতিসংক্ষিপ্ত জীবনকাল দাপিয়ে বেঁচে গেছেন ‘ভারতীয় চিত্রকলার রাজকন্যা’।

জন্ম ১৯১৩ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। বাবা ভারতীয় শিখ। নাম উমরাও সিং শের-গিল। মা অভিজাত হাঙ্গেরিয়ান পরিবারের মেয়ে। নাম মারি আনতোয়ানেৎ। আট বছর বয়স পর্যন্ত অমৃতারা সপরিবারে হাঙ্গেরিতে ছিলেন। তারপর ১৯২১ সালে চলে আসেন ভারতবর্ষে, সিমলায়। প্রথম চিত্রকলা-শিক্ষা সিমলাতেই, মেজর হুইটমার্শ নামে এক চিত্রকরের কাছে। ১৯২৪ সালে মায়ের উদ্যোগে ইতালি গিয়ে ফ্লরেন্সের এক ক্যাথলিক স্কুলে অমৃতা ভর্তি হন। কিন্তু কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা হজম করতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন তিনি। অসুখী, বিলাসী, স্বভাব-একা অমৃতা এই সময় থেকেই স্বাধিকার-সচেতন ও বিদ্রোহী মেজাজের হয়ে উঠতে থাকেন। এই সময়পর্বেই শিল্পী হিসেবে তাঁর নিজস্ব একটা ‘Vision’ তৈরি হচ্ছিল। ষোলো বছর বয়েসের মধ্যে ছবি আঁকায় তিনি এত দক্ষ হয়ে ওঠেন যে ১৯২৯ সালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় প্যারিসে। প্রথমে গাঁ শ্যেমিয়ের, তারপর বিখ্যাত আর্টস্কুল একোল সুপিরিয়র দ্য বোজ-আর্ত। এখানে তিনি লুসিয়ে স্যামোঁর মতো শিল্পীকে পান শিক্ষক হিসেবে।


এখান থেকেই অমৃতার কেরিয়ারের মোড় ঘুরে যায়। ‘Young Girls’ নামে একটি ছবির জন্য মাত্র কুড়ি বছর বয়সে আকাদেমি স্বর্ণপদক পান এবং ফ্রান্সের গ্রাঁ সাঁলোর (Grand Salon) সদস্যপদ লাভ করেন। এত কম বয়েসে গ্রাঁ সাঁলোর সদস্য নির্বাচিত হওয়া একটি সর্বকালীন রেকর্ড। এই সময়ে তেলরঙের ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। নিজস্ব ‘সিগনেচার’গুলো খুঁজে পেতে শুরু করেন। ঝুঁকে পড়েন ন্যুড পেইন্টিং-এর দিকে। তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে দেখা দেয় এক ক্লান্ত বিষণ্ণ নগ্ন যুবতী। অনেকদিন পর্যন্ত এই নিঃসঙ্গতাবোধই ছিল তাঁর আঁকার মূল চালিকাশক্তি। ফরাসি চিত্রশিল্পী পল গগ্যাঁর প্রকাশরীতি তাঁকে প্রভাবিত করে। গগ্যাঁর বহুচর্চিত ‘তাহিতি শিল্পরীতি’ অনুসরণ করে অমৃতা তাঁর জীবনের সবচেয়ে সাহসী ন্যুড ছবিটি এঁকেছিলেন। সেটি ছিল তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি। নাম দিয়েছিলেন ‘Self Portrait as Tahitian’। বিতর্ক অবশ্য তার আগে থেকেই তাঁর নিত্য-সঙ্গী হয়ে পড়েছিল।

১৯৩৪ সালে ভারতে ফিরে আসার পর তাঁর শিল্পকলায় নতুন এক মাত্রা যোগ হয়। অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র, ত্রিবাঙ্কুর -মাতানচেরির ভিত্তিচিত্র, বাসোলি(কাশ্মীর)-র মিনিয়েচার ইত্যাদি দেখে অমৃতা উদ্বুদ্ধ হন। ইতিমধ্যেই গগ্যাঁর পাশাপাশি তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন ডাচ শিল্পী পিটার ব্রুখেল। তার সঙ্গে এবার যুক্ত হল দেশীয় প্রাচীন শিল্পকলার প্রভাব। শিল্পী হিসেবে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত ছোঁওয়ার সঙ্গে পালা দিয়ে লম্বা হচ্ছিল বিতর্কের তালিকা। শিক্ষক বরিস টেজলস্কি, আকবরপুরের নবাব ইউসুফ আলি খান বা ইংরেজ সাংবাদিক ম্যালকম মুগরিজের সঙ্গে লিভ টুগেদার, বান্ধবী মেরি লুইস চেনাসির সঙ্গে সমকামী সম্পর্ক ছাড়াও আরও সম্পর্কে জড়িয়েছেন। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে গোপন সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন, এমন গুজবও রয়েছে। তাঁর সঙ্গে কিছুদিন নিয়মিত পত্রবিনিময়ও হয়েছিল, ছিল দেখাসাক্ষাৎও। ১৯৩৮ সালে হাঙ্গেরিতে গিয়ে অমৃতা বিয়ে করেন তাঁর মামাতো ভাই ডঃ ভিক্টর এগানকে। কিছুদিন পর দুজনে ফিরে আসেন ভারতে। ১৯৪১ সালের ৫ ডিসেম্বর লাহোরে জরায়ুর রক্তপাতজনিত ইনফেকশনে মৃত্যু হয় তাঁর। জীবনে হোক বা শিল্পে, কোনোদিনই প্রচলিত রীতিনীতির ধার ধারেননি অমৃতা। সমাজের চোখরাঙানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো বাঁচতে চেয়েছেন। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মতোই অমৃতা বেঁচে থাকতে শিল্পী হিসেবে তেমন স্বীকৃতি পাননি। বরং বিতর্ক কুড়িয়েছেন অনেক বেশি। তাঁর যাবতীয় খ্যাতি মৃত্যুর পর। বত্তিচেল্লি বা গুস্তাভ কুরবেরের মতো শিল্পীদের পাশাপাশি অমৃতার আঁকা ‘Sleep’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ন্যুড মাস্টারপিসগুলির মধ্যে ধরা হয়। অন্যান্য বরেণ্য কাজের মধ্যে Camels, Brahmacharis, Ancient Storyteller, Nude Group, Two Girls, Professional Model, Tribal Women, Three Girls, Bride’s Toilet, Namaskar, Hungarian Peasant, Spanish Girl, Gipsy Girl ইত্যাদির নাম করা যায়। ভারত ছাড়াও হাঙ্গেরি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নরওয়ে, জার্মানি ইত্যাদি দেশের সেরা আর্ট গ্যালারিগুলোয় অমৃতার অনেক মাস্টারপিস রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ছবি রয়েছে দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্টস- এ।


স্ফুলিঙ্গ তাঁর পাখায় পেয়েছিল ক্ষণকালের ছন্দ। সেটুকুর মধ্যে স্বীকৃতি ছিল না তেমন। বরং মিলেমিশে ছিল প্রেম-অপ্রেম, ভ্রূকুটি, ধিক্কার, বৌদ্ধিক বিষাদ, আশ্রয়ের আকুতি ও আশ্রয়হীনতার যন্ত্রণা। সেসব গায়ে মেখেই রূপকথার রহস্যময় রাজকন্যার মতো অমর হয়ে রয়েছেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার কিংবদন্তি অমৃতা শেরগিল। 



ঋণ - ১) The Princess Who Died Unknown/ Kanwarjit Singh/ The Sunday Tribune/ 13 March, 2010

২) The Free Spirits of Indian Art/ The Daily Telegraph/ 24th February, 2007 

৩) Women Painters at 21st Century/ www.indianart.com

#Amrita Sher-Gil #Indian Painter #Indian Artist #Painting #Controversy #ভারতীয় শিল্পী #চিত্রশিল্পী #বিতর্ক #avant-garde #modern Indian art. #‎Budapest #Lahore #Victor Egan #National Gallery of Modern Art #অরণ্যবহ্নি মজুমদার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219128