মদ্যপানের বিকল্প ও ধনতন্ত্রের জয়যাত্রা
সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ। অতলান্তিকের ওপারের দেশ জার্মানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পের রাস্তায় জোরকদমে এগিয়ে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেকটা ইংল্যান্ডের মতই এখানেও শিল্পায়নের হিড়িকটা মূলত উত্তরাঞ্চলেই বেশি, দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখনও কৃষিপ্রধান এস্টেটের আধিক্য। শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি রোজগারের আশায় উত্তরের কারখানাগুলির আশেপাশে ভিড় জমাচ্ছে অভিবাসীদের দল, এবং গৃহযুদ্ধের পরেও দক্ষিণাঞ্চলে চলতে থাকা চোরাগোপ্তা অত্যাচার এড়াতে পালিয়ে আসা একঝাঁক কৃষ্ণাঙ্গ, পরবর্তীকালে যাদের একদল ক্রমশ হয়ে উঠবে হার্লেম নবজাগরণের পুরোধা। তবে সাহিত্য বা সংস্কৃতি নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই কারখানাগুলির শ্রমিকদের জীবনের গল্প চলত চেনা ছকেই, ইংরেজ ডিকেন্সের উপন্যাস হার্ড টাইমস বা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের দ্য ম্যাঞ্চেস্টার পেপার্স, অথবা রাশিয়ার ম্যাক্সিম গোর্কির মাদার উপন্যাসের মতই এই শ্রমিকদের জীবনেও চরম সত্য ছিল দুটি- হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও দিনের শেষে অপরিমিত মদ্যপান। মদ্যপানের ফলে মার্কিন শ্রমিকদের বর্ণনা পারিবারিক অশান্তি ও দুঃখ দুর্দশাকে উপজীব্য করে স্টিফেন ক্রেন ১৮৯৩ সালে রচনা করেন ম্যাগি: আ গার্ল অফ দ্য স্ট্রিটস নামক উপন্যাস।
মদ্যপানের প্রভাব কমিয়ে শ্রমিকদের কীভাবে সুস্থ জীবনে ফেরানো যায়, একথা তখন ভাবছিলেন আমেরিকার বেশ কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। এ ধরনের ভাবনা থেকেই এক সমাধানের সন্ধান দিলেন আটলান্টার ফার্মাসিস্ট জন স্টিথ পেম্বারটন। নিজের প্রতিষ্ঠান পেম্বারটন মেডিক্যাল কোম্পানিতেই ১৮৮৬ সালে কোকা পাতা ও কোলা বাদামের নির্যাস দিয়ে তৈরি করে ফেললেন এক নতুন বিকল্প পানীয়, তাঁর খাতাঞ্চি ফ্র্যাঙ্ক রবিনসন সেটির নাম দিলেন ‘কোকা কোলা’। বহুল পরিচিত কোকা কোলার নামাঙ্কনটিও রবিনসনের কীর্তি। পেম্বারটন বিশ্বাস করতেন এই নতুন পানীয়টি শক্তিবর্ধক হবার পাশাপাশি পেটব্যথা ইত্যাদি নানারকম শারীরিক সমস্যার উপশম ঘটাতে সাহায্য করে। স্থানীয় সোডা বিপণিগুলিতে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এই নতুন পানীয়, পণ্যটির বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দ্রুত উপলব্ধি করে ১৮৯১ সালে আটলান্টারই আরেক ফার্মাসিস্ট আসা ক্যান্ডলার মাত্র আড়াই হাজার ডলারের বিনিময়ে কোকা কোলার সমস্ত স্বত্ব কিনে নিয়ে পরের বছর কোকাকোলা কোম্পানি স্থাপন করেন, এবং বিপণনের এক নতুন ইতিহাস রচনা করেন। বিপণনের ক্ষেত্রে ক্যান্ডলারের আগ্রাসী মনোভাব ছিল কিংবদন্তি, শোনা যায় তিনি কর্মচারীদের বলতেন, ‘আমাদের লক্ষ্য আমেরিকার প্রতিটি কোণ কোকা কোলার পোস্টারে ঢেকে দেওয়া, যাতে প্রত্যেক আমেরিকানের মনে এই নতুন পণ্য সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। তারা যেদিকেই তাকায় সেদিকেই যেন কোকাকোলার নাম দেখতে পায়। ক্রমশ প্রত্যেকটি মার্কিন রাজ্য এবং কানাডাতেও ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে কোকাকোলার। দুটি বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে, ঠাণ্ডা যুদ্ধের কঠিন আবহেও ১৯৭৮ সালে চিনের বাজারে ব্যবসা করবার অনুমতি পেয়ে যায় কোকাকোলা।
অন্যদিকে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে নিউ বার্নের জনৈক ফার্মাসিস্ট ক্যালেব ব্র্যাডহ্যাম ১৮৯৩ সালে নিজের ফার্মেসিতে চিনি, জল, ক্যারামেল, লেবুর রস, নাটমেগ এবং কোলা বাদাম মিশিয়ে ব্যাডহ্যাম প্রস্তুত করে ফেললেন আরেক নতুন পানীয়, যা নাকি তার দাবি অনুযায়ী একাধারে শক্তিবর্ধক ও হজমে সহায়ক। স্রষ্টার নামানুসারে প্রথমে ‘ব্র্যাড’স ড্রিঙ্ক’ বলে অভিহিত হলেও ১৮৯৮ সালের ২৮শে অগস্ট এই নতুন পানীয়ের নাম রাখা হয় ‘পেপসি’, পেপসিন উৎসেচকের নামে। বিপণনের অভিনবত্বে পিছিয়ে ছিল না পেপসিও, মোটরচালিত যানে বাহিত প্রথম পণ্যগুলির একটি ছিল এই পানীয়। ত্রিশের দশকের কুখ্যাত মন্দা প্রভৃতির ধাক্কা কাটিয়ে দ্রুত বাজারের উপর পাকা দখল কায়েম করে পেপসি, ১৯৬৫ সালে নরম পানীয় প্রস্তুতকারী পেপসি কোলা ও চিপস প্রস্তুতকারক সংস্থা ফ্রিটোলে ইনকরপোরেটেড মিলিত হয়ে জন্ম নেয় হালফিলের পেপসিকো।
সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি কোকাকোলা ও পেপসি কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছে কর্পোরেট দৈত্যে, ক্যান্ডলারের আগ্রাসী মনোভাব ক্রমশ হয়ে উঠেছে মার্কিন নব্যধনতন্ত্রের ভিত্তি, একই রাস্তায় হেঁটেছে একের পর এক বহুজাতিক সংস্থা। বর্তমান সমাজ শিক্ষা সংস্কৃতি প্রভৃতি যাবতীয় ক্ষেত্রে এই মতবাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্বন্ধে মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক জর্জ রিৎজার আলোচনা করেছেন তাঁর দ্য ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন অফ সোসাইটি বইতে। আজ ভাবতে অবাক লাগে, সর্বগ্রাসী মার্কিন ধনতন্ত্রের সম্ভবত সর্বাধিক পরিচিত প্রতীক যে দুটি পণ্য, তাদের আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে ঘটেছিল শ্রমিকদের একটু সুস্থভাবে বাঁচতে সাহায্য করবার জন্য!