চুরি যাওয়া বিশ্বকাপ ট্রফি এবং একটি কুকুরের গোয়েন্দাগিরি
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হতে তখনও মাস চারেক বাকি। কিন্তু তখনই গোটা ইংল্যান্ড ফুটবল মাদকতায় বুঁদ হয়ে আছে। কারণ ‘ফুটবল ইজ কামিং হোম’—আধুনিক ফুটবলের ‘জনক’ ইংল্যান্ডের মাটিতে এই প্রথমবার ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সেই উন্মাদনাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার হলে ট্রফি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। আর সেখানেই হয় যত বিপত্তি! ২০ মার্চ, ১৯৬৬ —আচমকাই আবিষ্কার করা গেল যে ট্রফির জন্য তৈরি কাচের ক্যাবিনেটটি ফাঁকা। বিশ্বকাপ চুরি হয়ে গেছে। কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও চোর কীভাবে এল, কখন বাক্স খুলে ট্রফি নিল আর কীভাবে যে পালাল—পুরোটাই একটা ধোঁয়াশা! আর এ তো সাধারণ চুরিচামারি না—গোটা বিশ্বের কাছে মাথা নিচু করে দেওয়া একটা ঘটনা। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো বিভাগও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ট্রফির কোনো খোঁজ পেল না। কিন্তু চোর না পাওয়া গেলেও ট্রফিটি উদ্ধার হয়েছিল। না, কোনো শার্লক হোমস নয়, সেটা খুঁজে এনেছিল ‘পিকলস’ নামের একটি অতি সাধারণ কুকুর। ২৭ মার্চ সকালে পিকলসের আশ্চর্য ঘ্রাণশক্তি শুধু ট্রফি উদ্ধার করে আনেনি। বরং এক সপ্তাহ ধরে চলা একটা টানটান রহস্য কাহিনির ‘হ্যাপি এন্ডিং’ ঘটিয়েছিল।
গল্পটা আরেকটু আগে থেকে শুরু করা যাক। তখনও ‘বিশ্বকাপ’ নাম হয়নি, এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল টুর্নামেন্টটিকে লোকে চেনে ‘জুলে রিমে ট্রফি’ হিসেবে। আজকের বিশ্বকাপ ট্রফির থেকে তাকে দেখতেও অন্যরকম ছিল। সোনা ও লাপিস লাজুলিতে বাঁধানো ট্রফিটির গায়ে গ্রিক পুরাণের জয়ের দেবী ‘নাইকি’র দু-হাত ছড়িয়ে থাকা মূর্তি ট্রফির মাহাত্ম্যকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর আগে ১৯৫৮ ও ১৯৬২-তে পরপর দু-বার ব্রাজিল জুলে রিমে ট্রফি জিতেছে। ইংল্যান্ডের টিমও সেবার খুব শক্তিশালী। ক্যাপ্টেন ববি মুর তো আছেনই, গোলকিপার গর্ডন ব্যাঙ্কস, মিডফিল্ডার ববি চার্লটন, ফরওয়ার্ড জিমি গ্রেভস, জিওফ হার্স্ট সব অসামান্য প্লেয়ারে টিম ভর্তি। ফলে শুধু দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ বলে নয়, প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনায় ইংল্যান্ড বুক বেঁধে বসে আছে। ১৯৬৬-র জানুয়ারিতে যখন ফিফা ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফ.এ) হাতে সোনায় বাঁধানো ট্রফিটা তুলে দেয়, তখনও বিশ্বকাপের সাত মাস বাকি। মার্চ মাসে লন্ডনের বিখ্যাত স্ট্যাম্প কালেক্টর ও বিক্রেতা কোম্পানি স্ট্যানলি গিবনস সর্বসাধারণের জন্য বিশ্বকাপ ট্রফি প্রদর্শনের বিশেষ অনুমতি জোগাড় করে। মূলত তাদের বিরাট স্ট্যাম্প কালেকশনের জন্য দর্শক টানতেই এই ব্যবস্থা। যাইহোক এফ.এ-এর সঙ্গে কথা হল যে তারা বড়ো অঙ্কের ‘সিকিউরিটি মানি’ দেবে এবং বিশেষভাবে তৈরি ঘরে অস্ত্রসহ দুজন গার্ড আর সাদা পোশাকের পুলিশ সর্বক্ষণ ট্রফি পাহারা দেবে।
১৯ মার্চ প্রদর্শনী শুরু হল। ২০ মার্চ দুপুর বারোটা নাগাদ ভিড় একটু হালকা হয়েছে। এই সময়ে প্রহরীদের ‘শিফট’ও বদল হয়। আর সেই সময়ে প্রহরীরা দেখতে পেল কখন যেন ট্রফির ক্যাবিনেটটা জোর করে খোলা হয়েছে। মাঝের বাক্সটা ফাঁকা, ট্রফি বেপাত্তা। অথচ প্রহরীরা দাবি করল তাদের পাহারায় কোনো ত্রুটি ছিল না। কীভাবে এই ঘটনা ঘটল এ বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। অত্যন্ত রহস্যজনক একটা ব্যাপার! কীভাবে চুরি হলো-র থেকে বড়ো চিন্তার বিষয় কীভাবে সেটা উদ্ধার করা যায়। পুরো তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হল লন্ডনের বিখ্যাত পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে। দুজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও আদতে কাজের কাজ কিছু হল না।
আসল ঘটনা ঘটল পরদিন, ২১ মার্চ। ততক্ষণে ইউরোপে তো বটেই, সারা বিশ্বে ট্রফি চুরির ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে। লজ্জায় ইংল্যান্ডের মাথা কাটা যাওয়ার মত অবস্থা। এরকম এক সকালে ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোশিয়েসনের তৎকালীন চেয়ারপার্সন জো মিয়ার্সের কাছে একটা অচেনা ফোন আসে। এবং ফোনের নির্দেশ অনুযায়ী পরদিন সকালে মিয়ার্সের বাড়িতে একটা পার্সেল এসে পৌঁছোয়। যার মধ্যে ছিল বিশ্বকাপ ট্রফির একটা ‘অংশ’ আর একটা চিঠি। যেখানে দাবি করা হয় যে মিয়ার্স যদি পুরো ট্রফিটি ফেরত চান তাহলে তাঁকে ১৫,০০০ পাউন্ড দিতে হবে। যদি তিনি পুলিশকে জানান তাহলে ট্রফির সোনা গলিয়ে ফেলা হবে। জনৈক ‘জ্যাকসন’ নামের এক ব্যক্তি নিজেকে ‘ট্রফিচোর’ বলে দাবি করে ফোনও করে। অবশ্য এই ‘জ্যাকসন’-এর কাছে ট্রফি আছে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, পুরোটাই বুনো হাঁসের পিছনে ধাওয়া করা। কিন্তু আর কোনো উপায়ও নেই। টাকাটা তখন আর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়, আসল কথা ট্রফিটা উদ্ধার হওয়া। মিয়ার্স তাই পুরো ঘটনা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে জানিয়ে রাখলেন। তাদের ইন্সপেক্টর চার্লস বুগি-র নির্দেশ অনুযায়ী আসল ও জাল নোট মিলিয়ে তিনি পুরো টাকাটার বন্দোবস্তও করে রাখলেন। এবার শুধু পরবর্তী ফোনের অপেক্ষা।
ফোন এল—কিন্তু সেই ফোন মিয়ার্স ধরলেন না। তাঁর অ্যাসিস্টান্ট পরিচয় দিয়ে সেই ফোন ধরলেন ইন্সপেক্টর বুগি। টেমস নদীর উপরে ব্যাটারসি পার্কে টাকা ও ট্রফি অদলবদলের জায়গা ঠিক করা হল। অবশেষে দেখা মিলল জ্যাকসনের। টাকাও হাতবদল হয়ে গেল। এবার জ্যাকসন বুগিকে নিয়ে যাবে ট্রফির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে খানিক রাস্তা যাওয়ার পরেই জ্যাকসন বুঝতে পারল যে সে ফাঁদে পড়েছে। বেশ কয়েকটা গাড়ি তাকে অনেকক্ষণ ধরেই অনুসরণ করছে এবং পাশে বসা ব্যক্তিটিও আর যাই হোক, ফুটবল সংস্থার প্রেসিডেন্টের সহকারী নয়। গাড়ি থামিয়ে পালাতে যেতেই বুগি তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে জানা যায়, ‘জ্যাকসন’-এর আসল নাম এডওয়ার্ড বেচলে। পেশায় একজন ছিঁচকে চোর। বিশ্বকাপ চুরি করার মতো বুদ্ধি, দক্ষতা, সাহস কোনোটাই তার নেই। পরে তদন্তে আরও জানা যায় যে, বেচলে নয়, এই চুরির মাথা ছিল অন্য একজন। বেচলে-কে শুধু টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাকে দু’বছরের হাজতবাসের শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তার কাছে এমন কোনো খবর পাওয়া গেল না, যাতে আসল ট্রফিচোরের খোঁজ পাওয়া যায়। ফলে এত সব করেও ট্রফি উদ্ধার করা গেল না।
তীব্র উত্তেজনায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে গেছে ট্রফির সন্ধানে। কিন্তু কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। ঘরে-বাইরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। অবশেষে ২৭ মার্চ সকাল। দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের বাসিন্দা ডেভিড করবেট তার পোষা কুকুর পিকলসকে নিয়ে রোজ সকালের মতো বেউলা হিলের রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিল। হঠাৎই পিকলস অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। গন্ধ শুঁকে শুঁকে সে একটা ঝোপের ভিতরে ঢুকে যায়। সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে পুরনো খবরের কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট। করবেট প্যাকেটটা খুলেই বুঝে যায় তার হাতে রয়েছে এক অমূল্য সম্পদ। ট্রফির নিচে গত বিশ্বকাপের বিজেতার নাম খোদাই করা দেখে সে আরও নিঃসন্দেহ হয়। করবেট সেটা থানায় জমা করার পর তাকেও প্রথমে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল। অবশেষে পুলিশ কিছুদিন তদন্ত চালানোর পর সেটা এফ.এ-এর হাতে তুলে দেয়। এবং সেবার পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ইংল্যান্ড প্রথম বিশ্বকাপ জেতে। ৩০ জুলাই ফাইনালের পর রানি এলিজাবেথ যখন ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন ববি মুরের হাতে জুলে রিমে ট্রফি তুলে দিচ্ছে, তখন গ্যালারির বিশেষ আসনে বসে ‘পিকলস’ও জয়ধ্বনি জানিয়েছিল।
ববি মুর-দের মতো ‘পিকলস’ও তখন ন্যাশনাল হিরো। করবেট এফ.এ-এর থেকে ৬০০০ পাউন্ড পুরষ্কারমূল্য পেয়েছে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পিকলস-কে ‘ইন্টারভিউ’-এর জন্য ডাকা হচ্ছে। সে ‘ডগ অফ দ্য ইয়ার’-এর সম্মান পেয়েছে। এমনকি ‘দ্য স্পাই উইথ আ কোল্ড নো’জ’ বলে একটি সিনেমাতে সে অভিনয়ের সুযোগও পায়। কিন্তু তার পরের বছরেই ১৯৬৭ সালে নিজের কলারের চেন গলায় আটকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিকলস-এর মৃত্যু ঘটে। তাকে করবেটের বাড়িতেই কবর দেওয়া হয় আর তার গলার কলারটা এখন ম্যানচেস্টারের ন্যাশনাল ফুটবল মিউজিয়ামের অন্যতম আকর্ষণের বস্তু।
পিকলসের বুদ্ধিমত্তা, ট্রফি উদ্ধার ও অবশেষে বিশ্বজয়—সবই হল, কিন্তু চোর ধরা পড়ল না। এটাও জানা গেল না যে কীভাবে চুরি হয়েছিল। তার থেকেও রহস্যের বিষয় চোর ট্রফিটা ফেলেই বা দিল কেন? ২০১৮ সালে ‘ডেইলি মিরর’ পত্রিকায় সাংবাদিক টম পেটিফর তার নিজস্ব তদন্তে পুরো ঘটনাটি আবার নতুন করে তৈরি করেন। তার মতে এই চুরির মূল মাথা ছিল ওই সময়ের লন্ডনের কুখ্যাত অপরাধী সিডনি কুগুরেলে ও তার ভাই রেগ। টমের তদন্তে উঠে আসে যে ট্রফি চুরির কোনো উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না। ২০ মার্চ বিশ্বকাপের প্রদর্শনীতে গিয়ে প্রহরীদের গা-ছাড়া মনোভাব দেখে সিডনির মধ্যে লুকিয়ে থাকা চুরিবিদ্যার প্রতিভা চাগাড় দিয়ে ওঠে। কিছুটা নিজেকে পরীক্ষা করার জন্য, কিছুটা ‘মজা’-র জন্য সে ট্রফিটা চুরি করে নিয়ে আসে। সে-ই বেচলে-কে মুক্তিপণের মাধ্যম হিসেবে নিযুক্ত করে এবং বেচলে ধরা পড়ার পর ‘মজা নষ্ট হওয়ার’ জন্য সে ট্রফিটা ফেলে দেয়। টম আরও প্রমাণ করেন যে দুই ভাইই ছিল ফুটবলপ্রেমী, তাই তারা ট্রফিটা নষ্ট করতে চায়নি। রেগ-এর মৃত্যুর পর তার কফিনের পাশে জুলে রিমে ট্রফি-র একটা রেপ্লিকা-ও রাখা হয়েছিল। অবশ্যই এসবই অনুমান মাত্র। সঠিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ ‘আসল’ চোর কখনও ধরাই পড়েনি।
এখানেই শেষ নয়, এই ট্রফিটা আবার চুরি যায়। এবারের স্থান ব্রাজিল, সাল ১৯৮৩। এর আগে ১৯৭০ সালে তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জেতার পর তখনের নিয়ম অনুযায়ী জুলে রিমে ট্রফি চিরকালের জন্য ব্রাজিলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে নতুন ট্রফি বানানো হয়, যেটা আজও চলছে। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনের অফিস থেকে যে ট্রফিটা চুরি হয়ে যায়, সেটার সন্ধান আজও মেলেনি। ১৯৮৪-তে ফিফা ব্রাজিলকে একটা রেপ্লিকা ট্রফি দেয়। চুরির ঘটনায় অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়। চুরির কাজে তাদের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। কিন্তু ট্রফিটা আর পাওয়া যায়নি। অনুমান করা হয় ট্রফির সোনা গলিয়ে সেটা বিদেশে চালান করে দেওয়া হয়েছে। কে বলতে পারে, ব্রাজিলে পিকলসের কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে ট্রফিটা এতদিনে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যেত।
..................
#Pickles #World Cup #Jules Rimet Trophy #silly পয়েন্ট