বঙ্গসন্তানের হাত ধরে স্বাস্থ্যপরিষেবায় বিপ্লব
আইআইটির অধ্যাপক, তাঁর হাত ধরেই স্বাস্থ্যপরিষেবার খোলনলচে বদলানোর স্বপ্ন দেখছে গ্রামীণ ভারত। এটুকু বললে হয়ত সার বক্তব্যটা বোঝানো যায়, কিন্তু পুরোটা বলা হয় না। যদি বলি, বিজ্ঞানে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ভাটনগর পুরস্কার বিজেতা এক বাঙালি বিজ্ঞানীর তৈরি প্রযুক্তির মাধ্যমে নামমাত্র খরচে সনাক্ত করা যাচ্ছে ডায়াবেটিস থেকে ওরাল ক্যানসার, তাহলে একটু নড়েচড়ে বসতে হয় বৈকি!
বস্তুত নড়েচড়ে বসার মতোই কাজ করেছেন আইআইটি খড়গপুরের মাইক্রোফ্লুইডিক্সের অধ্যাপক ডঃ সুমন চক্রবর্তী। তাঁর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষা এবং বহু বছর গবেষণা করার প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে একের পর এক বানিয়ে চলেছেন নতুন প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে কোনোরকম দামী যন্ত্রপাতি বা টেস্টিং ল্যাবরেটরি ছাড়াই, গবেষণাগারের সাধারণ উপকরণ দিয়েই মেপে ফেলা যাচ্ছে বিভিন্ন রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলি। অধ্যাপক মশাই নিজে যদিও একে ‘নতুন প্রযুক্তি’ বলতে নারাজ, তাঁর মতে এই কাজ আসলে রোগনির্ণয়ে ব্যবহৃত প্রযুক্তির মূলে থাকা বিজ্ঞানটুকু বুঝে সেটাকেই কম খরচায় করে ফেলার চেষ্টা। বাজারচলতি গ্লুকোমিটারের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে হলেও নিম্নবিত্তের কাছে তা অলীক গল্প, অথচ রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার উপস্থিতি মাপতে যে উৎসেচক প্রয়োজন তা সহজলভ্য। অধ্যাপক চক্রবর্তী এই উৎসেচকের ক্রিয়াকে নিয়ে এসেছেন গবেষণাগারে ব্যবহৃত অতিসাধারণ ফিল্টার পেপারের টুকরোতে। এক টুকরো কাগজ, তাতে একফোঁটা রক্ত পড়লেই কাজ হাসিল! রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে রং বদলেই টের পাওয়া যাবে। একইভাবে মাপা যাচ্ছে ক্রিয়েটিনিন থেকে লিপিড প্রোফাইল। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে মফস্বলে ঢুকলে যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা অপ্রতুল হয়ে পড়ে আর প্রত্যন্ত গ্রামের সীমানায় ঢুকলে শূন্য হয়ে যায়, সেই সব জরুরি পরিষেবা এখন চলে আসছে হাতের মুঠোয়। শুধু এই নয়, সাম্প্রতিক আবিষ্কারের জোরে ডঃ চক্রবর্তী ও তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন কম খরচে নির্ণয় করা যায় মুখের ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগও! এই কাজের জন্য তাঁরা বানিয়ে ফেলেছেন একরকম থার্মাল ইমেজিং টর্চ – রোগীর মুখের ভিতর তাক করলে সেই অংশের তাপমাত্রার তারতম্যকে ডিজিটাল ছবিতে পরিণত করা যাবে সহজেই। শরীরের তাপমাত্রার অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক রক্তপ্রবাহ, তাই থার্মাল ইমেজিং থেকে মুখের ভিতরের রক্তচলাচল সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। অন্যদিকে ক্যানসার আক্রান্ত অংশে সবসময় নতুন নতুন রক্তজালক তৈরি হয় দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার জন্য; তাই মুখের কোনও অংশে ক্যানসার আছে কিনা তা বুঝতে পারার মতো দুরূহ কাজও এই যন্ত্রের বলে সহজসাধ্য। এই প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির জন্য গবেষকরা সাহায্য নিচ্ছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI (artificial intelligence)-এর। বিভিন্ন রোগীর ওরাল ক্যানসারের ধরন বিভিন্ন; এই বিভিন্নরকম থার্মাল ইমেজিং তথ্য দিয়ে AI-কে বারবার শিক্ষাভ্যাস করালে একসময় তাপমত্রার তারতম্যের ছবি দেখেই ক্যানসারের নির্দিষ্ট পর্যায় বা গতিপ্রকৃতি সঠিক ভাবে বলে দেওয়া সম্ভব।
ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রোগী পিছু চিকিৎসকের অনুপাত হাস্যকর, যেখানে সবচাইতে কাছের হাসপাতালে গেলে সব পরীক্ষা করানো যায় না, দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করার ব্যস্ততা ছেড়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যেখানে বিলাসিতা, সেখানেই এই ধরনের প্রযুক্তির সার্থকতা। এখানেই অধ্যাপক চক্রবর্তীর কাজ মনে করিয়ে দেয় যে বিজ্ঞানসাধনার আসল উদ্দেশ্য মানবোন্নয়ন। যে দেশে অধ্যাপনা আর গবেষণা মানে সরকারি খরচে ঝাঁ-চকচকে কাজ করে নামী জার্নালে ছাপানো আর নানাবিধ কনফারেন্স ও কমিটির মাথায় বসে আগামী প্রোমোশনের ছক বানানো, সে দেশের নিরিখে ডঃ চক্রবর্তীর মতো মানুষেরা আর তাঁদের কাজ, সবটাই হয়ত ব্যতিক্রমী।
.....................
#IIT Kharagpur #Public Health #Suman Chakraborty #silly পয়েন্ট