গল্প

স্বর্গের ছবি

অভি বিশ্বাস Sep 20, 2020 at 6:36 am গল্প



~ ১ ~


“রাম চলেগা?”

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রঘুবীর বললেন, “সাথ মে গরম্ পানি হোগা?” 

“আরে সাহাব, বিলকুল হোগা… কিঁউ নেহি হোগা…”  বলে উঠে গেল রমেশ। 

পাহাড়ে ডিনার তাড়াতাড়ি হয়, কিন্তু সেটা হতেও আরো ঘণ্টা দুয়েক। নভেম্বর মাস। সন্ধে সবে সাড়ে ছটা। হিসেবের দু পেগ হুইস্কি অনেক আগেই শেষ, কিন্তু ঠান্ডায় বসে থাকে কার সাধ্য। 

আগুনে আরো কয়েক টুকরো কাঠ পড়তে দেখে উনুন ঘেঁষে এসে বসলেন রঘুবীর জালান। প্রায় ফুটন্ত জলটা কাপের রামে ঢেলে দিল রমেশ। দুহাত দিয়ে কাপটাকে ধরেও একটুও তাপ অনুভব করলেন না। 

এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। সোলার ল্যাম্প দিয়ে কাজ চালাতে হয়। তারও তেজ নিভু নিভু। রান্নাঘরে আলো বলতে উনুনের আগুন থেকেই যেটুকু হয়। 


‘হিল স্টেশান’ তো অনেক দূরের ব্যাপার, জীবনে সবচেয়ে উঁচু বলতে একবার টাটা সেন্টারের ছাদে উঠেছিলেন। ওঁর কাছে জগৎ মানে রিফ্র্যাক্টরি। 

ইস্পাত শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রিফ্র্যাক্টরি ব্রিক। এক বিশেষ ধরনের ইট, যা লোহা এবং স্টিল গলানোর চুল্লিতে অপরিহার্য। সেই ইট বানায় তাঁর কোম্পানি। সমগ্র পূর্ব ভারতের রিফ্র্যাক্টরি ব্যবসার একচ্ছত্র অধিকারী জালান রিফ্র্যাক্টরি লিমিটেডের কর্ণধার ষাট বছরের তরুণ রঘুবীর। 

পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি হাইট, টকটকে রং, কাঁচাপাকা চুল আর সাদা গোঁফের সুঠাম চেহারা। উইকেন্ডে ক্লাবে টেনিস আর পোকার, রোজ রাতে মেপে দু পেগ স্কচ। হয় গ্লেনফিডিচ, নয় ব্ল্যাক লেবেল। সকালে হেভি ব্রেকফাস্ট, দুপুরে হাল্কা স্যান্ডউইচ, রাতে স্যুপ, গ্রিলড চিকেন আর স্যালাড। দেখে কে বলবে তাঁর বয়স ষাট। বড়জোর চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বলা যায়… 

সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার ক্লাবের প্রাইভেট রুমে তাঁর ষাটতম জন্মদিনের পার্টির আয়োজন করেছিল বন্ধুরা। নাম দিয়েছিল ‘সুইঙ্গিং সিক্সটি’। 

আমোদ, হুল্লোড় আর মদের ফোয়ারা দিয়ে সুইংটা শুরু হয়েছিল ভালোই। 

গেলাসের টুং-টাং, ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ মার্কা হিন্দি গান আর সুস্বাদু খাবারের প্লেটে পার্টি তখন জমে উঠেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁকে নিয়েই কথা হচ্ছে। তাঁর ঈর্ষণীয় চেহারা, ব্যক্তিত্ব আর কর্মজীবনের ভূয়সী প্রশংসা চলছে চারপাশে। এসবের মাঝে এক বন্ধুর নিচুস্বরে করা একটিমাত্র মন্তব্য এক বাটি ঘন ক্ষীরের মধ্যে যেন এক বড়ি কুইনিনের মতো লেগেছিল। 

“… জীবনটা তো একঘেয়ে …” 


টাটা সেন্টারের আড়াইশো ফুট থেকে দুম্ করে ন হাজার ফুটের পাহাড়ি বুগিয়ালে এসে সুইস টেন্টে থাকাটা দারুণ এনজয় করছেন, কিন্তু ঠান্ডা ফ্যাক্টরটা পুরোপুরি হিসেবের মধ্যে ছিল না। কৈলাস আর সিংভি বলেছিল বটে এই সময়ে এই এরিয়ায় না এসে কোনও সি-সাইড গোছের জায়গায় যেতে, কিন্তু বরাবরের মতোই নিজের ইচ্ছা এবং একরোখামির ভিত্তিতে এতদূর চলে এসেছেন। 

ওক, পাইন আর রডোডেনড্রনে ঘেরা উত্তরখণ্ডের এই জায়গাটাকে ঠিক ইংরেজ আমলের ‘হিল স্টেশান’ বলা চলে না। তবুও, এইটাই তাঁর পছন্দ হয়েছিল, সঞ্জয়ের একটা কথা শুনে। 

মিনি সুইজারল্যান্ড। 

সঞ্জয় লাখোটিয়ার ছোট মেয়ে আর তার হাজব্যান্ড হানিমুনে এসেছিল এখানে। ওর মোবাইলে ছবি দেখে পার্টির রাতেই স্থির করে ফেলেছিলেন এইখানেই আসবেন। 


ঢেউখেলানো ঘাসভূমির ওপর ক্যানভাসের টেন্ট খাটানো। সামনে ঝকঝক করছে গাঢ়ওয়ালি হিমালয়ের অনন্য পর্বতশিখর চৌখাম্বা। পেছনে ঘন বন, তাতে কস্তুরী হরিণ ঘুরে বেড়ায়। টেন্ট থেকে হেঁটে একটু ওপরে উঠলে ম্যানেজার-কাম-কুক রমেশ সিং এর রান্নাঘর। কথাবার্তা সেইখানেই বসে হচ্ছিল। 

ঘণ্টাখানেক হল চৌখাম্বার ওপরটা লাল করে দিয়ে সূর্য বিদায় নিয়েছে। তিন লেয়ার গরম জামার ওপর জ্যাকেট ভেদ করেও হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাওয়ার অবস্থা। 

গরম জল নেওয়ার সময় রঘুবীর লক্ষ করলেন ক্যাম্পের অন্য অতিথিরাও রান্নাঘরে। ভাঙা চোয়ালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাঝবয়সি রোগামতো একজন লোক, সাথে একটি ছোট ছেলে। এরা আছে রান্নাঘরের পাশের টেন্টে। ওটার ভাড়া কম। 

আলাপ হয়নি, কারণ এরা আজ তুঙ্গনাথের মন্দির দর্শনে গেছিল। 

ক্যাম্প থেকে মাইল তিনেক দূর থেকে শুরু হয় তুঙ্গনাথ মন্দিরের জন্য যাত্রা। পৃথিবীর উচ্চতম শিবের মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আরাধ্য তুঙ্গনাথ। বহু লোক তীর্থ করতে বা এমনিতেও এখানে আসে। রঘুবীরেরও যাওয়ার কথা, আগামিকাল।

লোকটা একটু এগিয়ে এসে রমেশকে বলল, “আপকে পাস কোই ডেটল হ্যায়? হাত কট্ গেয়া।”

মুখটা একটু ঘুরিয়ে নিলেন রঘুবীর। রক্ত জিনিসটা অস্বস্তিকর। 

ডেটল লাগিয়ে রঘুবীরের সাথে চোখাচোখি হতেই অল্প হেসে নমস্কার জানাল লোকটি। 

“মাইসেলফ্ কল্পতরু সেন, ফ্রম বালুরঘাট, ওয়েস্ট বেঙ্গল।” 

“রঘুবীর জালান।” 

রামে চুমুক দিতে দিতে রঘুবীর লক্ষ করলেন যে লোকটির চেহারা উশকোখুশকো হলেও, চোখ দুটো স্থির আর উজ্জ্বল। ঠিক এইরকম চোখ উনি আরেকজনের দেখেছেন। 

গোঁফের তলায় মুচকি হেসে ঠিক করলেন একে একটু বাজিয়ে দেখা যাক। 

“আই অ্যাম অলসো ফ্রম ইওর স্টেট।”

“রিয়েলি?”

“শুধু স্টেট বললে ভুল বলা হবে, ফ্রম কলকাতা।”

“কলকাতা ! আপনি … এত ভালো বাংলা বলেন … আমার মাসির বাড়ি কলকাতায়, জানেন ! বেহালা ম্যান্টনে। কতদিন যাইনি …” বলেই দাঁত বার করে হেসে উঠল লোকটা। 

রমেশের দিকে তাকিয়ে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, “ও রমেশ ভাইয়া, মুঝে ভি থোড়া দিজিয়ে না গরম পানি…”। 

রমেশের রান্নাঘরে তাহলে রামের ঠেকটা চলে। রমেশ নিজেও নিয়েছে এক কাপ। 


“তো, মিস্টার সেন, কাম-কাজ কী করেন?” 

এই কথায় লোকটা হেসে পেছনে ঘুরে হাত দিয়ে ইশারা করল। বছর দশেকের রোগা ছেলেটা এগিয়ে এসে আগুনের পাশে বসে হাত সেঁকতে শুরু করল। 

“আমি আর্টিস্ট। ও হচ্ছে আমার অ্যাসিস্টেন্ট, নেপাল। আমরা খেলা দেখাই।”

“খেলা?”

“হ্যাঁ, মানে শো। ম্যাজিক শো।” 

গোঁফে একবার হাত বুলিয়ে রামে একটা বড় চুমুক দিলেন রঘুবীর। 

“আপনার বোধহয় ম্যাজিক দেখার তেমন অভ্যাস টভ্যাস নেই … ”

“দেখুন মিস্টার সেন, কিছু মাইন্ড করবেন না, লোককে বোকা বানানোর খেলা আমার কাছে সিম্পলি ওয়েস্ট অফ টাইম মনে হয়।” 

চুপ করে থেকে অল্প অল্প মাথা নাড়তে নাড়তে কল্পতরু বলল, “আ মাইন্ড অ্যাক্সেপ্টস ম্যাজিক সাবকনশাসলি, বাট ডিনাইস ইট কনশাসলি।” 

কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেলেন রঘুবীর। এরকম একটা কথা আশা করেননি লোকটার থেকে। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। 

রমেশ উঠে এসে জিজ্ঞেস করল আরেকটু রাম নেবেন কি না। দু পেগ হুইস্কির পর এক কাপ রাম যথেষ্ট ছিল, কিন্তু কেন জানি খালি কাপটা পেতে ধরলেন। 

আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তো মিস্টার সেন, এইখানে কী ম্যাজিক দেখাবেন? এখানে আপনার অডিয়েন্স কোথায়?” 

“আরে না না। এখানে ম্যাজিক নয়। এখানে জাস্ট ট্রেকিং।” 

“সামঝা। তো বাবা তুঙ্গনাথের মন্দির কেমন দেখলেন?” 

“ট্রেকটা দুর্দান্ত ! দুহাজার ফিট চড়াই। পাকা রাস্তা করা আছে, আপনি হেঁটেও যেতে পারেন, আবার ঘোড়াও নিতে পারেন। তবে পারলে হেঁটে যাওয়াটাই বেটার। মাঝে মাঝেই চায়ের দোকান। আপনি একটু করে উঠবেন, একটুখানি বসবেন। এক কাপ চা খাবেন। আপনার সামনে একশো আশি ডিগ্রি পাহাড়। আপনি একটু জিরোবেন। তারপর আবার হাঁটবেন।” 

এরপরেই রমেশ খাবার দিয়ে দিল, বাকি কথা টেবিলে বসেই হল। রঘুবীর বিশদে জেনে নিলেন মন্দিরে যাওয়ার ব্যাপারটা। 

খাওয়া শেষ করে সোলার ল্যাম্প নিয়ে যে যার টেন্টে ফিরে গেল। 

রঘুবীরের মাথায় কল্পতরু সেনের জাদু আর অবচেতন মন নিয়ে কথাটা ঘুরপাক খেতে থাকল। 



~ ২ ~


রোজকার মতো এখানেও ঘড়ি ধরে ছটার সময় ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তখনো আধো অন্ধকার। সাথে হাড় হিম করা ঠান্ডা। টেন্টের জিপার খুলে মাথাটা বার করে দেখেন চৌখাম্বার ওপর মেঘ জমে আছে। মানে আজ সানরাইজ দেখার চান্স কম। 

টেন্টের বাইরে ডেকচেয়ার পাতা। সাতটা নাগাদ রমেশ কফি দিয়ে গেল। আটটায় ব্রেকফাস্ট। রঘুবীরের সাথে গাড়ি আছে, ড্রাইভার কিষাণজিকে বলা আছে সাড়ে আটটায় বেরোবেন। 

সাতটা পনেরো নাগাদ আকাশ থেকে ছোট ছোট সাদা বুড়ির চুলের টুকরো ভেসে আসতে শুরু করল। শুরুতে জবুথবু, ইতস্তত। তারপর হঠাৎই ঝপ্ করে একটা গোটা পল্টন যেন ঝরে পড়ল। নিঃশব্দ সৈন্যদল, নেমে এল প্যারাশুট করে। কিছুটা সাদা কিছুটা ধূসর, কিছুটা ভাঙা কিছুটা গোটা, কিছুটা আলাদা বেশিটাই এক। 

দেখতে দেখতে রমেশের রান্নাঘর, টেন্টগুলো, পাইন গাছের বন, গোটা বুগিয়ালটাই ঢেকে গেল নরম সাদা তুলোর চাদরে। মিনি সুইজারল্যান্ড! 


“গুড মর্নিং!” 

কল্পতরু সেন কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। 

“লাগতা হ্যায় বাবা তুঙ্গনাথ আজ দার্শন দেনা নেহি চাহতে…” ব্যাজার মুখে বলে উঠলেন রঘুবীর। 

“আমাদেরও আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা … বাট, এ জিনিস বেশিক্ষণ চললে তো রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবে না।” 

“কফি?”

অন্য চেয়ারটায় জমিয়ে বসল লোকটা। নিজের হাতে কফি ঢেলে দিলেন রঘুবীর। কাপটা নিয়ে একটা সিপ মেরেই জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বার করে আনল। রাম। কফির মধ্যে ঢেলে নিল খানিকটা। সকাল সকাল মদ খাওয়ার অভ্যাসটাকে ভীষণ অপছন্দ করেন রঘুবীর। 

কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতেও তো আগে কখনো পড়েননি। 

সাড়ে দশটা নাগাদ বোঝা গেল দিনটা বরবাদ। আজ আর কেউই বেরোতে পারবে না। বরফ পড়া থামেনি, আর থামার কোনও লক্ষণও নেই। পায়ের পাতা ঢাকা বরফ ভেঙে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে টেন্টে ফেরত এসেছেন রঘুবীর। কল্পতরুকে নিয়ে সামনের ডেকচেয়ারে বসে। 

“আপনারা কি এরকম রেগুলার ঘুরে বেড়ান?” 

“শো-এর জন্য তো ঘুরতেই হয়। লাস্ট উইক হরিদ্বারে ছিল তিন দিন। তারপর হৃষীকেশে একদিন। ঠিক করা ছিল, এদিকে এলে তুঙ্গনাথটা করেই যাব। মাঝে একদিন এই টেন্টে থাকা। আজকের থাকাটা হিসেবের বাইরে। খরচাও হয়ে যাবে একগাদা।” 

পকেট থেকে শিশি বার করে আবার এক চুমুক লাগাল লোকটা। 

“আই হ্যাভ কাম ফর আ ভেকেশান আফটার থার্টি ফোর ইয়ারস, ইউ নো। লাস্ট গেছিলাম পুরী, ইন নাইন্টিন এইট্টি ওয়ান। উইথ মাই ওয়াইফ।” 

“এবারে একা এলেন…?” 

“উই গট্ ম্যারেড ইন নাইন্টিন এইট্টি। তার দু বছর পরই উনি আমাকে ছেড়ে চলে যান। ফর গুড। শি ওয়াজ আ জলি গুড উওম্যান, ইউ নো। স্ট্রং অ্যান্ড হেলদি। ইয়েট, দু দিনের জ্বরে … হঠাৎ করে…” 

এ কথা, সে কথায় উঠে এল তাঁর জন্মদিনের পার্টির কথা, আর কী করে চন্দন বড়ালের খোঁচা মারা কথায় ঝপ্ করে ঠিক করে ফেললেন যে একা একাই বেড়াতে যাবেন। 


আসলে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি তাঁর এখনকার বন্ধুদের কারোরই জানা নেই। 

আজীবন ভয়ংকর ব্যস্ত এবং বাস্তববাদী মানুষ রঘুবীর। তাঁর কাছে জীবন মানে ছিল কাজ। নতুন যে বাড়িটা বানাচ্ছেন। যে ফ্যাক্টরিটা খুলছেন। যে অর্থ, ঐশ্বর্য আর সমৃদ্ধি ক্রমাগত আয়ত্ত করে চলেছেন। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য। এই ছিল তাঁর জীবনের মতলব। 

কোনও আলংকারিক চিন্তা বা আবেগ বা রোমান্সের সময়ই ছিল না তাঁর। পরিবারের সবাই বলত তাঁর স্ত্রী তাঁকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, তাঁর থেকে। 

রঘুবীর জালানের স্ত্রী ছিল বাঙালি। সে ছিল আদর্শ গৃহবধূ। শান্ত, ঘরোয়া। পরনে আটপৌরে শাড়ি, মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পরিপাটি করে রেঁধে, ঘর পরিষ্কার করে, ধবধবে সাদা বিছানা পেতে তাঁর অপেক্ষায় রইত, তিনি ঘরে ফিরলে তাঁর যত্ন নেবে বলে। সে ছিল বলিষ্ঠ। দুর্বল বা ভঙ্গুর স্ত্রীলোক নয়। বিবাহিত জীবনে একদিনের জন্যেও অসুস্থ হয়নি। 

বিয়ের এক বছরের মাথায় তিনি তাকে উপহার দিয়েছিলেন একটি আংটি। এক সারিতে তিনটি নীলকান্তমণি, সোনায় বাঁধানো। চারপাশের কিনারা ধরে ছোট ছোট হিরে। ফর্সা আঙুলে জ্বলজ্বল করত নীলাগুলো, ঠিকরে পড়ত হিরের ঝলক। ১৯৮০ সালে ওই আংটির দাম পড়েছিল তেত্রিশ হাজার টাকা। 

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যখন তাঁর কর্মজীবনের তুঙ্গে দুদিনের জ্বরে সে তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। 

মুহূর্তের উন্মাদনায় চিতার আগুনে ছুড়ে দিয়েছিলেন সেই ছবিখানি – বিয়ের পর স্টুডিওতে গিয়ে তোলা তাঁদের একমাত্র জোড়ায় ছবি। যে ছবিটি সবসময় নিজের কাছে রাখত সে। এক মুহূর্তের জন্যেও হাতছাড়া করত না। 

সেই ঘটনার কথা ভেবে এখন আফসোস হয়, দুজনের একসাথে আর একটাও ছবি নেই। এখন সর্বদা সাথে থাকে তার একার একটি ছবি, আর সেই আংটিটি। 

রামের শিশিটা বাড়িয়ে ধরেছে কল্পতরু। না করলেন না রঘুবীর। অনেকখানি গলায় ঢেলে দিলেন। মিষ্টি ঝাঁঝে গলা থেকে জিভ অবধি জ্বলে গেল। 

“তো বোলিয়ে ম্যাজিশিয়ান বাবু, অ্যায়সা কোই ম্যাজিক হ্যায়, জো খোয়া হুয়া চিজ ওয়াপস লা সাকতা হ্যায়?” 

“আপনি কি জিনিস ফেরত আনার কথা ভাবছেন?”

“উও তাসভির… আমাদের দুজনের একসাথে তোলা সেই ছবিটা। বাকি জীবন কেটে যেত ওটা যদি ফেরত পেতাম। আর সময় ফুরোলে আমি ওটা সাথে করে নিয়ে যেতাম।” 

“আপনি কি মৃত্যুর পরে জীবনে বিশ্বাস করেন?” 

“দেখুন, আমি জানি হিন্দু সধবা স্ত্রী মৃত্যুর পর স্বর্গে যায়। কিন্তু আমি এও জানি যে এই পৃথিবীর সাথে সেই পৃথিবীর কোনও যোগাযোগ নেই। আমাকে অনেকে প্ল্যানচেটের অফার দিয়েছে, বাট আমি বিশ্বাস করি যে আত্মা একবার মুক্তি পেয়ে গেলে আর এ জীবনে ফিরে আসতে পারে না।” 


দুজনে চুপচাপ দেখতে থাকল সামনের সাদা আস্তরণ কীভাবে আস্তে আস্তে পুরু হয়ে উঠছে। 

অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলে উঠল কল্পতরু, “…কিন্তু প্র্যাকটিস-ই তো নেই বহু বছর…”  

“কিছু বললেন?”

“নাহ ! কিছু না… আসলে আপনি দুনিয়াদার মানুষ, ওসব কথা বিশ্বাস করবেন না। তাই বলে লাভ নেই।” 

“কী বলছেন একটু ক্লিয়ারলি বলবেন কি?” 

“শুনবেন? হাসবেন না তো?”

“না। হাসব না।”

“দাঁড়ান তাহলে। বলে লাভ নেই, একটা জিনিস চেষ্টা করে দেখি, হয় কি না। অনেকদিনের অনভ্যাস। ”

বলে উঠে নিজের টেন্টের দিকে গেল কল্পতরু। 


সাদা বরফের মধ্যে একটা কালো গোরু হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয়ে টেন্টের সামনের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গেল। খুরের চাপে গোল গোল গর্তগুলো যেন এক অজানা গ্রহের মাটিতে অজানা প্রাণীর পায়ের ছাপের মতো অদ্ভুত, অপার্থিব এক অনুভূতি এনে দিচ্ছে। বসে বসে দেখছেন রঘুবীর। 

থপ্ করে একটা আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখেন কল্পতরু ফিরে এসেছে, কাঁধে একটা রুকস্যাক। ইশারায় বলল টেন্টের ভেতরে যেতে। 

ভেতরে ঢুকে রঘুবীরকে খাটে বসতে বলে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল। হাত ঢুকিয়ে ভেতর থেকে একটা কুণ্ডলী পাকানো মোটা লম্বা কিছু বার করতে দেখেই রঘুবীর আঁতকে উঠে বললেন, “আরে বাপ রে ! সাপ নাকি ! … না না, ব্যাগ থেকে বের করবেন না !!” 

ততক্ষণে জিনিস্টা বার করে মাটিতে রেখে দিয়েছে লোকটা। 

“ভয় পাবেন না। এটা সাপ নয়। দড়ি।” 

বলেই খাটে বসা রঘুবীর আর মেঝেতে রাখা দড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রঘুবীরের দিকে পিঠ করে হাত নেড়ে ফিসফিস করে কীসব বলতে শুরু করল। 

লোকটা একটু সরে দাঁড়াতেই যা দেখলেন, তাতে রঘুবীরের চক্ষু স্থির হয়ে গেল। 

দড়িটা কুণ্ডলীকৃত সাপের ফণা তোলার মতো ধীরে ধীরে উঠে টেন্টের ছাদ ছুঁয়ে ফেলল। 

কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। 

তারপর হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে জোরে হাততালি দিয়ে উঠলেন রঘুবীর। 

“ব্রাভো! আপনি সত্যিকারের কালাকার আছেন।” 

“এই জাদু আমি শিখেছিলাম বাইশ বছর আগে, কিন্তু কোনোদিনও প্রয়োগ করিনি। উপার্জনের কারণে ব্যবহার করায় আমার গুরুর মানা ছিল। পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা এই জাদুর কথা শুনে নিন্দা আর উপহাস করেছে যুগ যুগ ধরে, কিন্তু তারা জানে না যে এ একান্তই ভারতীয় জাদু। আমাদের দেশের এক বিশেষ গোষ্ঠীর জাদুকরেরা প্রজন্ম ধরে এই জাদু তাদের শিষ্যদের দিয়ে গেছেন গোপন সংকেতে। শিষ্য তার জীবন দিয়ে সেই গুপ্তবিদ্যা রক্ষা করেছে, যাওয়ার আগে শুধুমাত্র তার যোগ্য উত্তরসূরির কানে মন্ত্র দিয়ে যেতে। এই জাদু কখনো কোনও মঞ্চে দেখানো হয় না। 

এ জিনিস প্রত্যক্ষ করেছেন এমন লোক জীবিত আছেন খুবই কম।”


জীবনে করেননি এমন অনেক কাজই এখানে এসে করে ফেলছেন রঘুবীর। আরো একটা যোগ হল তাতে। সুটকেসের চেন খুলে বের করে আনলেন হুইস্কির বোতল। দুটো কাচের বাহারি গ্লাস রাখা ছিল টেন্টে, তাতে এক পেগ করে ঢেলে একটা বাড়িয়ে ধরলেন। 

কল্পতরু ততক্ষণে দড়ি নামিয়ে গুটিয়ে আবার ব্যাগে পুরে ফেলেছে। 


নজরে রাখুন

মাংস


~ ৩ ~ 


বাইরে এখনও মেঘলা। ধূসর আকাশ থেকে তবুও কিছু বরফ পড়ে চলেছে ইতিউতি। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে হুইস্কি খেতে খেতে কল্পতরু বলে উঠল, “আপনি ইবন্ বতুতার নাম শুনেছেন?” 

“কৌন?...” 

“ফোর্টিনথ্ সেঞ্চুরিতে ইবন্ বতুতা নামে এক মুসলমান পর্যটক সুদূর মরক্কো থেকে পৃথিবী ভ্রমণে বেরোন। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্য প্রাচ্য হয়ে ভারতে এসে পৌঁছন। ঘুরতে ঘুরতে বিখ্যাত সব সুলতান, কাজি এবং সুফিদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। দিল্লির বাদশা মুহাম্মদ শাহ-এর রাজসভায় তিনি এই জাদু দেখেন। তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনিতে সর্বপ্রথম এই জাদুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

যে জাদুকর সেদিন মুহাম্মদ শাহ-এর সভায় এই আনোখা খেল দেখিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন সিওয়াসি গোষ্ঠীর লোক। এঁরাই এই জাদুর আবিষ্কারক। তারপর থেকে সাতশো বছর ধরে এই জাদু গুরু-শিষ্যের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিখেছে, আর তাদের জীবন দিয়ে রক্ষা করেছে।”

“আ… এক্সকিউজ মি, বাট একটা প্রশ্ন ছিল…” অনেকক্ষণ বাদে মুখ খুললেন রঘুবীর। তাঁর জিভ সামান্য জড়ানো। 

“বলুন…”

“আই মিন, জাদু বঢ়িয়া হ্যায়, কিন্তু এত লুকাছুপির কী কারণ বুঝলাম না… ” 

একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে কল্পতরু সেন বললেন, “দড়িটা হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখা অবধি অনেকেই করতে পারে, কারণ সে বিদ্যা চুরি হয়ে গেছিল বহুযুগ আগে। কিন্তু সে বিদ্যা সম্পূর্ণ বিদ্যা নয়। সিওয়াসি বংশের গুপ্তমন্ত্র আছে, যার প্রয়োগে একটি প্রাক-বয়ঃসন্ধির ছেলে কি মেয়ে যদি দড়ি বেয়ে উঠে যায়, তাহলে সে উঠতে উঠতে অন্য পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের একটা দরজার কাছে পৌঁছে যেতে পারে। সেই পৃথিবীতে তার প্রবেশ নেই, কিন্তু বার্তা আদান-প্রদান সম্ভব।”

রঘুবীর জালানের নেশা ছুটে গেছে। ভুরু কুঁচকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন কল্পতরু সেনের চোখের দিকে। 

কিন্তু সেই চোখে কপটতা নেই। তাঁর নিজের চোখের মতোই সে চোখ স্থির ও উজ্জ্বল। 

“তবে, এই খেলা যারা দেখাবে আর যারা দেখবে,” বলে চলল লোকটা, “সবার খুব বড় ঝুঁকি আছে। এদের মধ্যে কারও মনে যদি বিন্দুমাত্র দ্বন্দ্ব, বিদ্রুপ বা অবিশ্বাস থাকে, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।” 

“আপনি কী বলতে চাইছেন?”

“আমার গুরু আমাকে এই মন্ত্র দিয়ে বলেছিলেন, উপার্জনের জন্য এ বিদ্যা যেন কখনো ব্যবহার না করি। করলে সর্বনাশ হবে। কিন্তু যদি অন্য কোনও মানুষের কাজে নিঃস্বার্থ ভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এ বিদ্যা চমৎকারি।”


রঘুবীরের সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আরেক পেগ খেলে মনে হয় মাথাটা খুলবে। 

“নেপালকে দেখলেন তো কাল। নেপালের বয়স নয়। আপনি চাইলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।”

“আ মাইন্ড অ্যাক্সেপ্টস ম্যাজিক সাবকনশাসলি, বাট ডিনাইস ইট কনশাসলি।” যন্ত্রের মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল রঘুবীরের। 

“একদম !” বলে নিজের ঊরুতে এক চাপড় মেরে উঠল লোকটা। 

“কিন্তু, কোথায় হবে… আর কীভাবে?” 

“এই খেলার জন্য পনেরো গজ বৃত্তের একটা ফাঁকা জায়গা চাই। আর অন্তত পঞ্চাশ ফুট ওপরে উঠতে পারে এমন দড়ি। বৃত্তের ভেতর শুধু জাদুকর, দড়ি আর বাচ্চাটা থাকতে পারে। আর কেউ তার ভেতর ঢুকলেই খেল খতম!” 

“বাইরে তো বরফ …” 

“পেছনের জঙ্গলে গেলেই ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাবে। ওর একটু দূরেই আমাদের গাড়ি রাখার জায়গা। ওখানে ঘন গাছের জন্যে মাটিতে সামান্যই বরফ থাকবে। ক্যাম্পের অন্যান্য লোকেদের এড়িয়ে ব্যাপারটা করা যাবে। আর দড়ি তো আমার কাছেই আছে।” 

এক চুমুকে হুইস্কিটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন রঘুবীর। 

“ডাকুন। ছেলেটাকে ডাকুন।” 


দড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেল বাচ্চা ছেলেটা। উঠতে উঠতে হঠাৎ দেখেন সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কাছে রাখা স্ত্রীর ছবি দেখিয়ে তার নামধাম আগেই বলে দিয়েছিলেন ছেলেটাকে। 

মিনিট সাতেক পর দড়ির মাথায় আবির্ভাব হল ছেলেটার। আস্তে আস্তে নেমে এসে কী একটা জিনিস হাতে দিল কল্পতরুর। লোকটা মন দিয়ে তার কথা শুনল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল রঘুবীরের দিকে। 


হাত বাড়িয়ে ধরতেই চক্ষু চড়কগাছ। একটা ভাঙা, ঘষটানো মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। 

“ওঁর সাথে কথা হয়েছে ওর। উনি ওখানে খুব একলা। একটাও দিন যায় না যেদিন উনি আপনাকে চোখে হারান না। ওই ছবিই ওঁর একমাত্র সম্বল। ওটা দিয়ে দিলে ওঁর আর কিছুই থাকবে না। যদি ওটা উনি ফেরত পাঠান, তাহলে তার বদলে আংটিটা ওঁর চাই।” 

চশমাটা হাতে নিয়ে রঘুবীর জালানের দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। 


আলো কমে আসায় জঙ্গলে থাকাটা আজ আর নিরাপদ নয়। 

ঠিক হল পরদিন কাকপক্ষী ওঠার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। রমেশ বা তার পরিবারের কেউ যেন টের না পায়। এই মুহূর্তে ক্যাম্পে আর কোনও অতিথি নেই। 


~ ৪ ~


এক অদ্ভুত, অসামান্য সম্ভাবনার কথা মনে করে প্রায় সারা রাত না ঘুমিয়েই কেটে গেল রঘুবীরের। হুইস্কির বোতল শেষ হয় হয়। 

কল্পতরুর সাথে ঠিক করাই ছিল। ভোর পৌনে ছটায় সোলার ল্যাম্প হাতে নিয়ে ভারী বুট আর কান-মাথা ঢাকা গরম টুপি পরে খোলা জায়গাটায় হাজির হলেন তিনি। পুবের আকাশে তখন সবে রং ধরেছে। 

মিনিট পাঁচেক লেট করে কল্পতরু আর নেপাল এল রুকস্যাক আর একটা কাঠের বাক্স সাথে নিয়ে। 

জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সযত্নে বার করে আংটিটা হাতে দিলেন ছেলেটার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালেন বৃত্তের বাইরে। 

কাল বিকেলের পর আর বরফ পড়েনি। মাটি ভিজে আছে। 

গোল জায়গাটার মধ্যিখানে কাঠের বাক্সটা বসানো হল। বাক্স থেকে বার করে ওপর রাখা হল কুণ্ডলী পাকানো দড়ি। 

পরিচিত ভঙ্গিমায় রঘুবীরের দিকে পিঠ করে মন্ত্র বলা শুরু করল কল্পতরু। 

আস্তে আস্তে মাথা তুলে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল দড়িটা। দেখতে দেখতে গাছের মাথা ছাড়িয়ে আরো ওপরে উঠে গেল। জাদুকরের হাতের ইশারায় ছেলেটা দড়ি বেয়ে উঠতে থাকল। এবং দেখতে দেখতেই চোখের আড়ালে চলে গেল। 

এইবার অপেক্ষা। 


ঘড়িতে প্রায় দশ মিনিট কেটে যাওয়ার পর একটু উশখুশ করা শুরু করলেন রঘুবীর। কল্পতরু বাক্সটা ঘিরে ওপরের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পায়চারি করছে। 

আরো মিনিট পাঁচেক কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ ওপর থেকে একটা মাঝারি সাইজের গাছের ডালের মতো কিছু একটা ভেঙে এসে পড়ল। 

“এ কীইই !!! সর্বনাশ হয়ে গেছে !!!” চিৎকার করে উঠল লোকটা। 

“কী? কী হয়েছে??” 

হাতে করে একটু এগিয়ে আসতেই ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন রঘুবীর। একটা ছোট ছেলের পা। হাঁটুর নীচ থেকে কাটা, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। 

“এ কী সর্বনাশ করলেন আমাদের !! নিশ্চয়ই আপনার মনে কোনও অবিশ্বাস ছিল… আমি বারবার বলেছিলাম, কারও মনে এতটুকু অবিশ্বাস থাকলে এ পদ্ধতি প্রাণঘাতী হয় !!! এ জিনিস চেষ্টাই করতে নেই…” 

মাথা টলছে রঘুবীরের। সারা রাত এমনিতেই ঘুম হয়নি। 

রক্ত তিনি সহ্য করতে পারেন না। দেখলেই শরীর খারাপ লাগে, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতন হয়। 

হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল লোকটা। 

“আমি ওর মাকে কী জবাব দেব??”

রঘুবীরেরও চোখের জল বাগ মানছে না। 

দড়ি বেয়ে নেপালের দেহ নীচে নেমে এসেছে। দু হাত দিয়ে ডান হাঁটু ধরে জোরে জোরে কাঁদছে আর মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কল্পতরু ক্রমাগত মাথা চাপড়াচ্ছে। 


না! এ অনাচার তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না! 

তাঁর হাত পা কাঁপছে, তাও কোনোমতে সাহস যোগাড় করে বললেন, “সুনো, ইয়াহাঁ সে লাগভাগ পাচাস্ কিলোমিটার দূর এক ছোটা শেহের হ্যায়, শ্রীনাগর। মেরা গাড়ি লেকে তুরন্ত নিকাল যাও অউর ওয়াহাঁ কোই ডক্টর দিখাও। পহুঁচকে গাড়ি ভেজ দো, ম্যায় ইয়াহাঁ সব ক্লিয়ার কর কে আতা হুঁ। উসকা অপারেশান কারাউঙ্গা ম্যায়। জিতনা খরচা হোতা হ্যায় হোনে দো। ইস বাচ্চে কা জিম্মেদারি মেরি হ্যায়। ইসসে পহলে কোই অউর ইয়াহাঁ আ যায়ে, তুম ইসকো লেকে জলদি সে নিকলো। ম্যায় আয়া।” 

নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে ক্ষতের জায়গাটা বেঁধে, কাটা পা আর দড়ি বাক্সে পুরে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে চলে গেল কল্পতরু। 


গোলেমালে আর আংটির কথাটা কারও মনে রইল না।



অলঙ্করণঃ অভীক
#bengali #story #relationship #swarger chobi #abhi biswas #বাংলা #গল্প #স্বর্গের ছবি #অভি বিশ্বাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

40

Unique Visitors

215815