ভঙ্গুর সাম্রাজ্যের এক অতন্দ্র প্রহরী
পৃথিবীতে নানা ভাষায় যে গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে সর্বাধিক লেখালিখি হয়েছে, তিনি নিঃসন্দেহে আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি শার্লক হোমস। প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া উচিত, হোমস চরিত্রের সর্বাঙ্গীণ বিশ্লেষণ বা তার বিস্তারিত ঠিকুজি নির্ণয় এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, বরং এই লেখা তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও সমাজের কিছু বিশেষ দিক পর্যালোচনা করে সেই পরিপ্রেক্ষিতে হোমস চরিত্রটির বিচার করতে আগ্রহী।
তৎকালীন একাধিক নথিপত্র ও রচনা প্রভৃতি থেকে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইংরেজ জনমানসে দেখা দিয়েছিল এক সুগভীর অনিশ্চয়তা। চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব অনুসরণকারী কিছু বিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক বলতে থাকেন যে প্রাণের জগতের গতিপথ হল একটি সাইন কার্ভের মতো, যেখানে উল্লেখযোগ্য উন্নতির পরে পতন অবশ্যম্ভাবী। এ ছাড়া এডউইন রে ল্যাঙ্কেস্টারের মতো কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেন যে ক্রমাগত উন্নতির বদলে শুধুমাত্র অস্তিত্ব নিশ্চিত করবার জন্য যে-কোনো প্রাণী বা জাতি বেছে নিতে পারে ক্রমশ অবনমনের পথ, টিকে থাকার জন্য যে সর্বতোভাবে উন্নত হওয়া জরুরি তা কখনোই নয়। ইংরেজ জনগণের মনে ঘনিয়ে আসে এক মারাত্মক আশঙ্কা, তবে কি উন্নতির শিখরে বসে থাকা ব্রিটিশ জাতির পতনও আর বেশি দূরে নেই? সুবিশাল রোমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের মতো একদিন এই বিরাট সাম্রাজ্যও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির দ্বারা চিন্তিত হবার কারণ ছিল যথেষ্ট। পৃথিবী জুড়ে ইংরেজ পণ্যের চাহিদা হ্রাস, বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী নতুন রাষ্ট্রের উত্থান, বুয়র যুদ্ধে হেনস্থা, আইরিশ সমস্যা, নারীদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন, এ সমস্ত কিছুই কায়েমি স্বার্থের একাধিপত্যকে করে তুলেছিল শঙ্কিত। বুয়র যুদ্ধের আগে নাকি সরকার গঠিত কমিটির রিপোর্টে জানা যায়, অন্তত সত্তর শতাংশ ব্রিটিশ পুরুষ সামরিক দায়িত্বপালনের উপযুক্ত নন। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ অভিযোগ করতে থাকেন, শহুরে জীবনের চরম ভোগবাদ ও দূষণলাঞ্ছিত পরিবেশ ব্রিটিশদের ভেতরে ভেতরে ফোঁপরা করে দিচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইংরেজ জাতির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের অ্যালান কোয়াটারমেইন, রিচার্ড জেফ্রিস রচিত আফটার লন্ডন, রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড, অস্কার ওয়াইল্ডের দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে প্রভৃতি একাধিক রচনায় উঠে এসেছে জাতির এই ক্রমবর্ধমান পচনের প্রসঙ্গ, শহুরে জীবনের অস্বাস্থ্যকর বাস্তব তুলে এনেছে হেনরি মেহিউ রচিত লন্ডন লেবার অ্যান্ড দ্য লন্ডন পুওর ও জেনারেল উইলিয়াম বুথের ইন ডার্কেস্ট ইংল্যান্ড প্রভৃতি বইগুলি। এর সঙ্গেই যোগ হয় আরেকটি আশঙ্কা, সাইন কার্ভের তত্ত্ব সত্যি হলে আপাত অনুন্নত উপনিবেশের শাসিত জাতিগুলিও যদি ক্রমশ হয়ে ওঠে উন্নত, এবং উলটো পথে হামলা চালিয়ে বসে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধেই? ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া ইংরেজ জাতির ক্ষমতা আছে তো তাদের মহড়া নেবার? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা, রিচার্ড মার্শের দ্য বিটল, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের শি প্রভৃতি কাহিনিতে এই আতঙ্কই যেন বারংবার ধ্বনিত হতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা পাঠ করলে বোঝা যায়, হোমসের মতো একটি অসাধারণ চরিত্রের প্রবেশ তৎকালীন ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক জগতে কতটা অনিবার্য ছিল। ডয়েলের প্রথম জীবনের রচনা জে হাবাকুক জেফসন’স স্টেটমেন্ট গল্পে পাওয়া যায় সুদূর এক আদিবাসী দ্বীপ থেকে ইংল্যান্ড আক্রমণের এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের কথা। শার্লক হোমস নিছক পেশাদার গোয়েন্দা নয়, বৃহত্তর অর্থে সে হল ভঙ্গুর হয়ে আসা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এমন এক অতন্দ্র ও একনিষ্ঠ প্রহরী, যে একাই রুখে দিতে পারে উপনিবেশের দূর প্রান্ত থেকে সাম্রাজ্যের প্রতি ধেয়ে আসা একের পর এক আক্রমণ। উল্লেখ করা যায়, হোমসের প্রথম কাহিনি আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে ওয়াটসন লন্ডন শহরকে তুলনা করে জঞ্জাল ও পাঁকের স্তূপের সঙ্গে। আহত, ভগ্নহৃদয় ওয়াটসন হোমসের সঙ্গলাভের পর যেন মন্ত্রবলে হয়ে ওঠে উৎসাহিত, উজ্জীবিত। শার্লক হোমসের নিশ্চিত উপস্থিতি যেন এভাবেই নিয়ত প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে চলেছে বিগতযৌবন, সমস্যাজর্জর এক সাম্রাজ্যের দুর্বল ধমনিতে।
হোমসের একাধিক কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই যে গোলমালের সূত্রপাত উপনিবেশের হাত ধরেই– দ্য সাইন অফ দ্য ফোর গল্পে আগ্রা দুর্গের গুপ্তধন, দ্য বসকম্ব ভ্যালি মিস্ট্রি গল্পে অস্ট্রেলিয়ার সম্পত্তি, অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য স্পেকলড ব্যান্ড গল্পে ভারতের সাপ, অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডেভিল’স ফুট গল্পে আফ্রিকার বিষাক্ত শিকড় বা অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডাইং ডিটেকটিভ কাহিনিতে সুমাত্রা থেকে পাওয়া রোগের জীবাণু। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গতে বাঁধা গোয়েন্দারা এসব সমস্যার সমাধানে অক্ষম, তাই লেসট্রেড বারে বারেই ছুটে আসে হোমসের কাছে। হোমস ব্যতিক্রমী, কারণ সে পারিপার্শ্বিকের এই ভোগসর্বস্ব শহুরে সমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। সে অবিবাহিত, একা একা থাকে, ওয়াটসন ছাড়া বন্ধু নেই তার, পছন্দসই কেস পেলে খাওয়া ঘুম বিসর্জন দিয়ে দিনের পর দিন তার পিছনে পড়ে থাকতে পারে, প্রচারসর্বস্ব এই সমাজে রহস্য সমাধানের পর সংবাদপত্রে তার নামটুকুও প্রকাশ পায় না। লক্ষণীয়, রহস্য সমাধানের পর ইংরেজ সম্ভ্রান্ত ঘরের একাধিক সদস্যকে সে দোষী জেনেও ছেড়ে দেয়, সমাজপতিদের প্রতি তার সহমর্মিতা সত্যিই উল্লেখ করবার মতো। ওয়াটসনের ভাষা অবলম্বন করেই তাই বলা যায়, হোমস হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেই বিনিদ্র রক্ষক, মাকড়সার মতোই যার জাল বিস্তৃত সারা লন্ডন জুড়ে, ইংরেজ জাতির কোনও শত্রুরই তার হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। মৃত্যুর পরেও তাই পাঠকের চাহিদায় তাই এম্পটি হাউস গল্পে ফিরে আসতে হয় তাকে, অবসর গ্রহণের পরেও মৌমাছি চাষ ফেলে হিজ লাস্ট বাও গল্পে ছুটে আসতে হয় শত্রুকে ঠেকানোর জন্য। শাসকের আশঙ্কার শেষ নেই, তাই শার্লক হোমসেরও বিশ্রাম নেই, থাকতে পারে না।