বাংলা কবিতার বিশ্বনাগরিক, অমিয় চক্রবর্তী কাজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবেও
আচ্ছা, মানুষ কবিতা পড়ে কেন? হ্যাঁ, ইস্কুলের সিলেবাসে কবিতা থাকে। অবুঝ ছেলেবেলা দুলে দুলে মুখস্থ করে সেই সব। পাড়ার অনুষ্ঠানেও কিছু কবিতা আবৃত্তি করা হয়। তারপর?
অবসর বিনোদনের জন্য বই পড়াই কমে যাচ্ছে এখন। চারিদিকে বিনোদনের এত রঙিন হাত এবং হাতছানি। সেসব পেরিয়ে যদিও কেউ বইমুখো হয়, কবিতা হয়ে থাকে নির্জন। একাকী। যেন এক বিষণ্ণ পোস্টঅফিস। চিঠি পোস্ট করতে আসে না প্রায় কেউ। তবু আছে।
হ্যাঁ, এই তবু থেকে যাওয়াটা কয়েক হাজার বছর ধরে। পাঠকসংখ্যা খুব বেশি নয়। তবু কেউ কেউ কবিতা পড়ে। কেন?
আসলে কবিতায় জমা থাকে মানুষের অনুভূতির ইতিহাস। আবেগের ইতিহাস। যুগ থেকে যুগান্তরের পথে যখনই মানুষের বিশ্বাস ধাক্কা পেয়েছে, কবিতা সেই ইতিহাস লিখে রেখেছে। মানুষের চেতনায় যে দ্বন্দ্ব, যে লড়াই, তাকেও বুনে রেখেছে কবিতা। আসলে তো বুনে রাখে মন। কবিতা সেই বুননের ফল। কবিতা আসলে একটা way of mind। অমিয় চক্রবর্তী তাঁর The Dynasts and the post-war age in poetry বইটা শুরুই করেছিলেন এমন কথা দিয়ে।
“Modern poetry is charged with the problems of belief, conflicts of consciousness, and with the attempt to shape, in art, a way of mind which will indicate life’s saner amplitudes”.
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজ থেকে টমাস হার্ডির The Dynasts নিয়ে তিন বছর গবেষণার জন্য অমিয় চক্রবর্তী ডি. ফিল ডিগ্রি লাভ করেছিলেন ১৯৩৭ সালে। সেইসময়েই বেরোয় এই বই। তখন অমিয় চক্রবর্তী ব্রেজনোস্ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো।
তবে এইটুকুই তো তাঁর পরিচয় নয়। তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব, পৃথিবীর নানান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কিন্তু এইগুলো পেরিয়েও তাঁর পরিচয়, তিনি কবি। তাই তো তিনি কবিতাকে a way of mind হিসেবে দেখতে পারেন।
তিনি লিখেছিলেন, “আমারও নেই ঘর, আছে ঘরের দিকে যাওয়া”। এই অনিকেত অনুভব নিয়েই পৃথিবী ঘুরে একদিন অমিয় ফিরে আসবেন শান্তিনিকেতনে। ইতিমধ্যে তিনি হাভার্ড বোস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিয়ে করেছেন রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমা দেবীর পালিতা কন্যা নন্দিনীর শিক্ষক, হিয়োডির্স সিগার্ডকে। রবীন্দ্রনাথ যে ড্যানিশ-বালার নাম দিয়েছিলেন হৈমন্তী।
আসলে অমিয় চক্রবর্তী হয়ে উঠেছিলেন এমন এক আশ্চর্য মোহনা যেখানে এসে মিশত দেশ আর বিদেশের জল। যেখানে কোনও কাঁটাতার ছিল না। হয়ত সেই জন্যই তিনি লিখতে পেরেছিলেন আশ্চর্য সব কবিতা। কবিতাকে আমরা বলেছিলাম অনুভবের ইতিহাস। অনুভবের তো কোনও দেশ নেই!
“যেখানে সে ডুবে আছে
সেখানে জল নেই।”
এও তো অনুভব। মগ্নমৈনাকের সান্দ্র চিঠি। যে চিঠিতে একই সঙ্গে লেখা প্রেম আর বিরহের আখর।
“কোনদিন বুঝব না
কেন ঐ ছেলে তার পকেটে বুকের কাছে রাখে
চুল ওড়া কার ছবি…।”
পকেটে বুকের কাছে ছবি রাখা আছে বলেই সবটা বুঝিয়ে দিলেন অমিয়। কিছু বলার দরকার আর রইল না। আবার তিনি লিখলেন,
“কত দীর্ঘ দু-জনার গেল সারাদিন
আলাদা নিঃশ্বাসে”
দীর্ঘ শব্দটিকে প্রথাগত জায়গা থেকে সরিয়ে আনলেন অমিয়। ফলে বাক্যের সমস্ত জোর গিয়ে পড়ল ঐ দীর্ঘের ওপর। সারাটা দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেল অনেকটা। ফলে “আলাদা নিঃশ্বাসের” হাহাকারও গেল বেড়ে।
এই যে বিচ্ছিন্ন পংক্তিমালা আমরা তুলে আনছি অমিয় চক্রবর্তীর নানা কবিতা থেকে, আমরা আসলে দেখাতে চাইছি কীভাবে রচিত হয় অনুভবের ইতিহাস। আসলে তো কোনও কবিতাই বিচ্ছিন্ন নয়। কবি তাঁর সমস্ত জীবন ধরে রচনা করে চলেন একটাই দীর্ঘ কবিতা। সেই অনুভবের ডালির সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয় কিছু মানুষ। অন্যের মনের মধ্যে দেখতে পায় নিজের মনের ছায়া। আবহমানের বেদনায় এসে মেশে তার একান্ত ব্যক্তিগত শোক। সে বুঝতে পারে, সে আসলে একা নয়। কবিতা যারা পড়ে তাদের মধ্যে আসলে শোকের সম্পর্ক।
ঠিক একই সম্পর্ক সূত্রে বাঁধা পড়ে যান কবি আর পাঠক। যাকে অজস্র বর্ষার জলধারে খুঁজে পাওয়া গেল না তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কোনও কবিতার বইয়ে। ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দরজা গেঁথে যায় অলীক মিলনে। তবু কবিতা সবার নয়। আজকের এই বিজ্ঞাপন সর্বস্ব, চটকসার সময়ে দাঁড়িয়ে প্রায় অর্ধশতক আগের এক কবিকে পড়েন কিছু মানুষ। অমিয় চক্রবর্তীরা এই ভাবেই থেকে যান বাংলা ভাষার গহিন শিকড়ে।
*********************
#সিলি পয়েন্ট #ব্যক্তিত্ব #অমিয় চক্রবর্তী #বিবস্বান দত্ত #কবিতা #বাংলা পোর্টাল #web portal #Vivaswan Dutta # Amiya Chakrabarty #silly point