ভয়ের ইতিবৃত্ত : এডগার অ্যালেন পো
‘By a route obscure and lonely, Haunted by ill angels only, Where an Eidolon, named Night, On a black throne reigns upright...’ --Edgar Allan Poe, ‘Dream-Land’
পাশ্চাত্য হরর সাহিত্যের ইতিহাসের রূপরেখা নির্মাণে সবচেয়ে বেশি অবদান যিনি রেখেছেন, তাঁর নাম এডগার অ্যালেন পো (১৮০৯-১৮৪৯)। ইউরোপিয়ান গথিক-কে আমেরিকান আঙ্গিকে এনে নবরূপ প্রদান, সাইকোলজিক্যাল হরর উপধারার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, এবং অতি অবশ্যই আধুনিক হরর-এর পথনির্দেশ দেওয়া—পো-এর মুকুটে পালকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এই মার্কিন সাহিত্যক নেহাত কয়েকটা গল্প লিখেই নিজের কাজে ইতি টানেননি, বরং ভয়ের মূলতত্ত্ব নিয়ে ব্যাপকভাবে চর্চা করেছেন, পাশাপাশি সুপারন্যাচারাল কাহিনির নির্মাণ, গদ্যছন্দ এবং নান্দনিকতাকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলত তাঁর হরর হয়ে উঠেছে শিল্প, পরবর্তী সময়ের তাবড় লেখকদের কাছে আদর্শ, নিবিড় অনুপ্রেরণা।
পো-এর কলমে গথিক হরর-এর নিদর্শন পেতে অনেক সমালোচকই ‘মেটজেঙ্গারস্টাইন’ গল্পের দিকে তাকান। তাঁর এই কাহিনি হোরেস ওয়ালপোল-এর ‘কাসল অফ অট্রান্টো’ দ্বারা অনুপ্রাণিত কি না সে নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু সুপারন্যাচারাল-এর ব্যবহারের দিক দিয়ে ‘মেটজেঙ্গারস্টাইন’ যে সাধারণ গথিক-এর তুলনায় অনেকাংশেই আলাদা, এই কথা সবাই একবাক্যে মেনে নেবেন। এক অর্থে এই কাহিনির গথিক বৈশিষ্ট্য কেবল এর আবহতেই সীমাবদ্ধ থাকে, মূল থিম-এ রেখাপাত করে না। তাই হয়তো পাঠকের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে গা ছমছমে বর্ণনাকেই হাতিয়ার করেন লেখক— ‘The eyes, before invisible, now wore an energetic and human expression, while they gleamed with a fiery and unusual red; and the distended lips of the apparently enraged horse left in full view his sepulchral and disgusting teeth.’
পো-এর সবচেয়ে পরিচিত গথিক হরর কাহিনি নিঃসন্দেহে ‘দ্য ফল অফ দ্য হাউজ অফ আশার’। শব্দচয়ন থেকে পরিবেশ রচনা— প্রতিটা ক্ষেত্রেই অসামান্য মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন পো, প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষে, কেন্দ্রীয় চরিত্র রডরিক আশার-এর নৈরাশ্যময়তার আশ্রয়ে আতঙ্ককে পাঠকের সামনে এনেছেন। ভাইবোনের মধ্যেকার অস্বাভাবিক যৌনতা তো বটেই, পারিবারিক সম্পর্কের আড়ালে লুকোনো গোপন অভিশাপেরও ইঙ্গিত দেয় এই গল্প, চিহ্ন সাজিয়ে দেয় জড় এবং চেতনের মধ্যেকার অশুভ আত্মিক যোগাযোগের। কাহিনি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ‘হাউজ অফ আশার’ নেহাত এক পুরোনো বাড়ি নয়, বরং জীবন্ত এক সত্তা; রডরিক ও তার বোন ম্যাডেলাইন-এর জীবনের সঙ্গে এক তারে বাঁধা। অন্তিমে কথকের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যায় আশার-এর বাড়ি; একের অস্তিত্বহীনতায় বিলীন হয়ে যায় সব— এমনই আশ্চর্য দ্যোতনায় শেষ হয় গল্প।
‘দ্য কাস্ক অফ অ্যামনটিল্লাডো’ পো-এর অন্যতম প্রিয় ‘প্রিম্যাচিওর বেরিয়াল’ থিম-কে পাঠকের সামনে আনে, এবং ভয়াল ‘রিভেঞ্জ টেল’ হিসেবে সার্থকতা খুঁজে নেয় অনায়াসেই। ‘ফার্স্ট পার্সন পয়েন্ট অফ ভিউ’-তে রচিত এই গল্পের কথক মন্ট্রেসর অপমানের জ্বালা মেটাতে তার বন্ধু ফরচুনেটো-কে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাতাল বন্ধুকে দুর্লভ মদ ‘অ্যামনটিল্লাডো’-র লোভে ভুলিয়ে মাটির তলাকার ক্যাটাকুম্ব-এ নিয়ে যায় মন্ট্রেসর, তারপর জ্যান্ত পুঁতে দেয় দেওয়ালের পেছনে। আসন্ন মৃত্যুকে সামনে দেখে অসহায়, ভয়ে দিশেহারা ফরচুনেট-এর সংলাপ যেমন এই কাহিনিকে অন্য মাত্রা দেয়, তেমনই কথকের প্রায় উন্মাদ ক্ষোভ, বিবেকহীনতা ও নিষ্ঠুর শীতলতা পাঠককে স্তব্ধ করে রাখে। প্রায় সতেরো দশক পেরোনোর পরেও পো-এর গায়ে কাঁটা দেওয়া এই গল্পের ধার বিন্দুমাত্র কমেনি, এখানেই তার মাহাত্ম্য।
ভয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘ডপলগ্যাংগার’ থিম-কে একাধিকবার ব্যবহার করেছেন পো, এবং প্রতিবারই সফল হয়েছেন। ‘উইলিয়াম উইলসন’-এর কথাই ধরা যাক। গল্পের কথকের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় তারই মতো দেখতে অন্য এক মানুষের উপস্থিতি। অশনির কালো মেঘের মতো কথকের প্রাত্যহিক জীবনে ছায়া ফেলে সেই মানুষ, উন্মাদনার অতল খাদের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় ক্রমশ। শেষে মানসিক যন্ত্রণা আর সহ্য করতে না পেরে অন্য মানুষটাকে খুন করে কথক, এবং আদতে নিজের ওপরই মারণ আঘাত হানে! আবার ‘লিজিয়া’ গল্পে আমরা পাই এক রহস্যময়ী সুন্দরী লিজিয়া-কে, যে কথককে বিয়ে করার পর অজানা অসুখে মারা যায়। শোকসন্তপ্ত কথক দ্বিতীয়বারের জন্য বিয়ে করে, কিন্তু রোয়েনা নামের তার দ্বিতীয় স্ত্রীও বিয়ের পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রোয়েনা। মৃতা স্ত্রীকে বারবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে কথক, এবং একসময় উঠে দাঁড়ায় মৃতা রোয়েনা। কিন্তু কথক অবাক বিস্ময়ে দেখে, বদলে গিয়েছে রোয়েনা, লিজিয়া-র রূপ ধারণ করেছে সে!
পো চরম মৃত্যুবিলাসী ছিলেন, ‘ফর অ্যানি’ কবিতায় কবির অদ্ভুত উচ্চারণ— ‘The fever called living is conquered at last’ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। লেখকের এই মৃত্যুচেতনা তাঁর দিনযাপনকেই কেবল আচ্ছন্ন করে রাখেনি, হরর সাহিত্যেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। ‘দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ’ গল্পের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম কাহিনি এক অনবদ্য ডার্ক ফ্যান্টাসি, ‘ইমেজারি’-র ব্যবহার। ‘রেড ডেথ’-এর মূলত এক রূপক, যার মাধ্যমে অজেয়, অমোঘ মৃত্যুরই জয়গান গেয়েছেন পো। নিজেকে প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে সুরক্ষিত মনে করে অভিজাত প্রস্পেরো, আনন্দ-উল্লাস, সপার্ষদ মোচ্ছব, বেলাগাম ভোগবিলাসকে আঁকড়ে থেকে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয় না। ছদ্মবেশে প্রাসাদে প্রবেশ করে মৃত্যু, একে একে সাত পক্ষ পার হয়ে শিকারের জীবন কেড়ে নেয়। বাদ যায় না অভ্যাগত অতিথিরাও। ‘ডেথ কামস ফর অল’ আপ্তবাক্যকে সুপ্রতিষ্ঠা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই গল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ ছাড়া ‘বেরেনিস’, 'দ্য ফ্যাক্টস ইন দ্য কেস অফ মঁসিয়ে ভ্যাল্ডেমার’ ইত্যাদি গল্পেও পো-এর তির্যক মৃত্যুচেতনার পরিচয় আমরা পাই।
‘দ্য টেলটেল হার্ট’ এবং ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’— এই বিখ্যাত দুই কাহিনি নিয়ে দু-চার কথা না বললে পো সংক্রান্ত যে-কোনো আলোচনাই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ‘আনরিলায়েবল ন্যারেটর’-এর ট্রোপ-কে এত সুন্দরভাবে ছোটগল্পে ব্যবহার ওই সময়ে আর কোনও লেখক করে উঠতে পারেননি। অতিপ্রাকৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ভয়ের দোলাচল পাঠককে বিভ্রান্ত করে শেষ অবধি, কোনটা সত্যি এবং কোনটা কথকের বিকৃত মনের কল্পনা তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। প্রথম গল্পে খুন হওয়া বৃদ্ধের হৃৎপিণ্ডের নিরন্তর লাবডুব শব্দ খুনিকে পাগল করে দেয়, শেষমেশ সবকিছু স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় সে। দ্বিতীয় কাহিনিতে কথকের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে তার পাপের শাস্তি দিতে একটা কালো বিড়াল মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসেছে। হাড় হিম করা ভয় কাকে বলে, এই গল্পদুটো পড়লে বোঝা যায়। এইজন্যই বারবার ভয়রসিকদের আড্ডার বিষয়বস্তু হয় এই দুই কাহিনি, নানান সংকলনে স্থান পায়, অগুনতিবার অনূদিত হয় এবং বিদগ্ধজনের প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ পায়।
‘দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম’ পো-এর বাকি সব গল্পের চেয়ে আলাদা। ট্রিটমেন্টের দিক দিয়ে আধুনিক এই কাহিনির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল বডি হরর। স্প্যানিশ ইনকুইজিশনে মৃত্যুর সাজাপ্রাপ্ত এক বন্দির ওপর হওয়া একের পর এক নারকীয় অত্যাচার-এর বিবরণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের ভয়ের নাগরদোলায় চড়িয়ে রাখে, একইসঙ্গে অফুরন্ত সাসপেন্স-এরও জোগান দেয়। শব্দ গন্ধ স্পর্শের আধিক্য এই কাহিনিকে অদ্ভুত এক বাস্তবতা দেয়। গল্পে একের পর এক মৃত্যুফাঁদের সম্মুখীন হয়ে শিউরে ওঠে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধদের কারাগারে আটক নামহীন বন্দি। গল্পের পাতা উলটোতে উলটোতে একইভাবে শিউরে ওঠে পাঠকও, অ্যাড্রিনালিনের উষ্ণ স্রোতে গা ভাসাতে বাধ্য হয়।
কল্পবিজ্ঞান এবং ডিটেকশন জঁরের প্রতিষ্ঠাতা, দক্ষ কবি, যোগ্য প্রাবন্ধিক, এবং সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র এডগার অ্যালেন পো সম্বন্ধে যত আলোচনাই করা হোক না কেন, আরও অনেক কথা বলার অবকাশ রয়েই যায়। আমেরিকান হরর সাহিত্যের বেতাজ সম্রাট তিনি, এবং আমরা সৌভাগ্যবান, তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমরা পেয়েছি। আজ, ১৯শে জানুয়ারি, পো-র ২১২তম জন্মদিন। এই শুভদিনে ভয়ের গল্পকে সৌন্দর্য-সৌকর্যের শিখরে উন্নীত করা অগ্রদূতকে সম্মান জানিয়ে প্রখ্যাত গবেষক এস টি যোশীর কথায় আমরা বলতেই পারি — ‘The work of Edgar Allan Poe revolutionised and transformed supernatural (and psychological) horror fiction in so profound and multifaceted a way that it could plausibly be maintained that the genre…only began with him.’