ফিচার

সরকারের বিরুদ্ধে ২৮৮ দিন : মাথা নোয়াননি হেলেন বোলেক

রোহন রায় April 17, 2021 at 7:24 am ফিচার

২৮৮ দিন মুখে খাবার তোলেননি হেলেন বোলেক। ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল হেলেন বোলেক যখন শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছেন, তাঁর বয়স তখন মাত্র ২৮। সেদিন তাঁকে ঘিরে অগণিত অনুরাগী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা প্রিয় গায়িকাকে নৈতিক সমর্থন জানাতে এসেছিলেন তাঁরা। বোলেকের শবদেহ নিয়ে তাঁরা মিছিল করেন। পুলিশ মিছিল আটকে দেয়। গ্রেফতার হন বহু মানুষ।

ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আমরণ অনশনই ছিল হেলেনের অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে নতি স্বীকার করেননি। আপোসও করেননি। অনশনরত অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে বিশ্বজুড়ে করোনার উপদ্রবে এই প্রতিবাদী তরুণীর আত্মদান ততটা প্রচার পায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের মুখে এমন জুতো পড়ার নিদর্শন বোধহয় আর নেই।




হেলেন ছিলেন তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের বিখ্যাত কুর্দি লোকসংগীতের দল ‘গ্রুপ ইয়োরাম’-এর গায়ক। ১৯৯১ সালের ৫ জুন দিয়ারবাকি শহরের একটি কুর্দি পরিবারে তাঁর জন্ম। দিয়ারবাকি তুরস্কের সবচেয়ে বড় কুর্দি-অধ্যুষিত শহর। গ্রুপ ইয়োরাম অবশ্য তৈরি হয়েছিল হেলেন জন্মের আগে - ১৯৮৫ সালে। মূলতঃ বামপন্থী মতাদর্শ বিশ্বাসী এই দলটির সংস্কৃতিচর্চার মূল উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদের বিরোধিতা এবং সরকারের বিভিন্ন অন্যায় নীতির তীব্র সমালোচনা। কুর্দি জনজাতির ঐতিহাসিক ভাবাবেগকে অনেকাংশে ধারণ করেছে এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী গানের দলটি। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে কুর্দি জনজাতির ওপর তুর্কি সরকার যে প্রচণ্ড দমন-নিপীড়ন এবং ধারাবাহিক গণহত্যা চালিয়ে এসেছে, এই লেখার জন্য বরাদ্দ স্বল্প পরিসরে তার আর্থ-রাজনৈতিক কারণে আমরা প্রবেশ করব না। সংক্ষেপে এটুকু বলে নেওয়া যেতে পারে যে, সরকারের স্বেচ্ছাচারের সমালোচক এবং কুর্দি-মনোভাবাপন্ন হবার কারণে শুরু থেকে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট শাসকের রোষানলে ছিলেন দলের সদস্যরা। এঁদের বিপুল জনপ্রিয়তা তুর্কি সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছিল। শুধু তুর্কিতে নয়, গ্রুপ ইয়োরাম পৃথিবীর বহু দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মোট ২৩ টি গানের অ্যালবাম বের করেছে। ইউরোপ, আমেরিকার বহু দেশে ইয়োরাম অনুষ্ঠান করেছে। শুধু গান নয়, অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ‘তাভির’নামে একটি প্রতিষ্ঠানবিরোধী পত্রিকা প্রকাশ করেছেন বহু বছর। ২০১২ সালে তাঁরা ‘F-Tipi’ নামে একটি ফিল্ম তৈরি করেছিলেন যেটি প্রবল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তুর্কি সরকারের কুখ্যাত ‘f type’ জেলখানার অভ্যন্তরের অত্যাচার ও কার্যকলাপকে তীব্র আক্রমণ করা হয়েছিল এই ফিল্মে। ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে দলের বহু সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এক নিষিদ্ধ মার্কসবাদী সংগঠনের সঙ্গে ইয়োরামের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভিযোগ এনে তাঁদের অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় তাদের সবকটি গানও। ২০১৬ সালে ইস্তানবুলে একটি অনুষ্ঠানের আসর থেকে দলের আরও সাতজন সদস্যসহ হেলেনকে বন্দী করে তুর্কি সরকার। বন্দী অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৭ মে থেকে ইয়োরামের তিন সদস্য বাহার কার্ট, বারিস ইয়ুকসেল আর আলি আরাকি অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেন। তাঁদের দাবি ছিল, গানের দলের বিরুদ্ধে রুজু করা মামলাগুলি প্রত্যাহার করতে হবে, দলের সদস্যদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে এবং তাঁদের অনুষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। জুন মাসে দলের আরও এক সদস্য ইব্রাহিম গোচেকের সঙ্গে অনশনে যোগ দেন হেলেন। নভেম্বর মাসে হেলেন আর ইব্রাহিম মুক্তি পান। তবে দুজনেই অনশন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১১ মার্চ, ২০২০ তারিখে ইব্রাহিম গোচেক আর হেলেনকে পুলিশ জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু তাঁরা কোনওরকম চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন, অনশনের পথ থেকে সরতেও রাজি হন না। তার দিনকয়েক পর ৩ এপ্রিল হেলেন মারা যান। আর ইব্রাহিম গোচেক? বোলেকের মৃত্যুর পর আরও এক মাস তিনি অনশন চালিয়ে যান। টানা ৩২৩ দিন অনশন চালানোর পর ৫ মে প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় তিনি অনশন প্রত্যাহার করেন। মারা যান ঠিক তার দু দিন পর, ৭ মে তারিখে। এই দুই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ট মুখ পুড়েছে তুরস্কের। কোভিড সংক্রমণ এসে বাকি সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে না দিলে নিঃসন্দেহে বিশ্ব জুড়ে এর বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠত।   


আরও পড়ুন 

রাষ্ট্রের শিল্পী নাকি শিল্পের রাষ্ট্র?





হেলেন বোলেক বা ইব্রাহিম গোচেককে রগড়াতে পারেনি তুর্কি সরকার। মুক্তচিন্তার প্রতি সরকারের দমনমূলক মনোভাবকে এভাবে লাইমলাইটে নিয়ে এসে তাঁরাই বরং রগড়ে দিয়েছিলেন সরকারকে। আশা রাখি, দিলীপ ঘোষ নামক হাম্বাগটিকেও এরকমই বিচ্ছিরিভাবে রগড়ে দেবেন কোনও বাঙালি শিল্পী। বা শিল্পীরা। জনগণের রগড়ানি খাওয়া ফ্যাসিস্টদের ন্যায্য এবং ইতিহাসসম্মত অধিকার। এবং অন্তিম নিয়তি। 

[ লেখার মধ্যে ব্যবহৃত মাদার পোস্টারের কার্টুনটি ডেভিড লো-র আঁকা ]
[ পোস্টারে ব্যবহৃত ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : anti-imperialistfront.org  এবং  Instagram ]

[ পোস্টার : অর্পণ দাস ]

#বাংলা #নিবন্ধ #ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #হেলেন বোলেক #রোহন রায় #তুরস্ক #ইস্তানবুল #গ্রুপ ইয়োরাম #কুর্দি জনজাতি #তাভির #F Tipi #F Type Prison #বাহার কার্ট #বারিস ইয়ুকসেল #আলি আরাকি #ইব্রাহিম গোচেক

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

7

Unique Visitors

219110