ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিচ্ছেন কেরালার 'Walking Librarian' সুকুমারন
বইয়ের নেশার চেয়ে সাংঘাতিক আর কোনও নেশা হতে পারে না। বই পড়তে আর পড়াতে ভালোবেসে একটা মানুষ যে কতকিছু করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারেন কেরালার পি.সুকুমারন। প্রৌঢ়ত্বের সীমা পেরনো সুকুমারন প্রতিদিন কমবেশি বারো কিলোমিটার হাঁটেন, সঙ্গী দুটো বইবোঝাই ব্যাগ আর বাড়ি থেকে আনা দুপুরের খাবার। উদ্দেশ্য, মানুষের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া।
কেরালার আলাপুঝা অঞ্চলের কারুভাট্টার অধিবাসী পি. সুকুমারন এখন নিজের নামের চেয়ে বেশি পরিচিত 'walking librarian' নামে। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে কুমারপুরম পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ করেন। এই লাইব্রেরিটি একসময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিলো, কিন্তু পরবর্তীকালে এর সদস্য সংখ্যা কমতে থাকে। সুকুমারন লক্ষ্য করেছিলেন, লাইব্রেরির সদস্য কমলেও আসলে মানুষের বই পড়ার ইচ্ছে কিন্তু কমছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো কারণে মানুষ লাইব্রেরিতে আসতে পারছেন না। তখন সুকুমারন সিদ্ধান্ত নেন, লাইব্রেরিতে আসতে না পারাকে তিনি বই পড়ার প্রতিবন্ধকতা হতে দেবেন না; পাঠক লাইব্রেরিতে না আসতে পারলে বই-ই পৌঁছে যাবে পাঠকের কাছে। আর তিনি হবেন এই প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারী, অর্থাৎ তিনি নিজেই সবার কাছে বই পৌঁছে দেবেন এবং যথাসময়ে ফেরত নিয়ে আসবেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি বই পড়তে এবং পড়াতে যেমন ভালোবাসেন, তেমনই ভালোবাসেন হাঁটতে। তাই প্রত্যহ এতটা রাস্তা হেঁটে বই, সাময়িকপত্র সরবরাহ করা তাঁর কাছে বিন্দুমাত্রও অপ্রীতিকর নয়, বরং বেশ ভালোলাগারই কাজ।
সুকুমারন আলাপ্পুঝা কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর কুমারপুরম পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ শুরু করেন। তারপর চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি পায়ে হেঁটে বই সরবরাহ করে চলেছেন। সুকুমারনের ব্যক্তিগত জীবনও খুব একটা শান্তিপূর্ণ নয়, তাঁর পরিবারে আছেন তাঁর স্ত্রী আর অটিজম আক্রান্ত পুত্র। একজন গ্রন্থাগারিক হিসেবে তিনি কেরালা স্টেট লাইব্রেরি কাউন্সিল থেকে মাত্র ৩১০০ টাকা মাসিক ভাতা আর বই বিক্রির ৩০% টাকা পান, এই উপার্জনেই তিনি সংসার নির্বাহ করেন এবং ছেলের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করান।
সুকুমারনকে অনেকেই বলেছিলেন প্রতিদিন এত রাস্তা না হেঁটে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করতে। কিন্তু সুকুমারন তাতে রাজি হননি। কারণ, তিনি সাইকেল চালাতে জানেন না। অবশ্য শেখার চেষ্টাও করেননি, কারণ তিনি হাঁটতে ভালোবাসেন। প্রতিদিন এত রাস্তা তিনি ভালোবেসেই হাঁটেন, প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করেন। তাছাড়া বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে, তাদের কথা শুনতেও ভালোবাসেন সুকুমারন। রোজের হাঁটাপথে জীবনের রসদও তিনি পান বিস্তর। যাদের সুকুমারন বই দেন, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগও বজায় রাখেন, বিশেষ করে শিশুদের সঙ্গে। তিনি মানুষকে শুধু বই পড়তে দিয়েই ক্ষান্ত হন না, বইগুলো নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে আলোচনাও করেন। বিশেষত ছোটোরা বই পড়ে ঠিকঠাক বুঝতে পারছে কিনা, সে নিয়েও আলোচনা করেন তাদের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, পড়ার অভ্যাস মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে, মানুষের মূল্যবোধ, জীবনযাত্রাতেও পরিবর্তন আনতে পারে একটি ভালো বই।
সুকুমারনের এই কাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে কেরালার স্টেট লাইব্রেরি কাউন্সিল ২০১৬ সালে তাঁকে আই.ভি. দাস স্মারক পুরস্কারে ভূষিত করে। কেরালার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুকুমারন রোজ মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেন যে নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে, তেমন ভোরের দিকেই তো চেয়ে আছে গোটা আগামী।
আরও পড়ুন: কৃষি আর পর্যটনকে মেলাচ্ছেন পাণ্ডুরং তাওয়ারে : উপকৃত অসংখ্য কৃষক