'অযোধ্যার চেয়ে সত্য'
আজ বাইশে শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। পরশু অর্থাৎ উনিশে শ্রাবণ সমস্ত তর্ক বিতর্কের অবসান করে অযোধ্যায় এক প্রতর্ক জন্ম নিল, রামমন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এই দুইয়ের মধ্যে আপাত কোনও সম্পর্ক নেই। অথবা হয়ত কোনও তির্যক সম্পর্ক আছেও।
রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে শুধু কবিতা বলে মনে করতেন না। বরং তাঁর কাছে রামায়ণ আর ভারতবর্ষ এক হয়ে ছিল। "আমি কেবল এই কথাটুকু মাত্র জানাইতে চাহি যে, বাল্মীকির রামচরিত-কথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কবির কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন। তাহা হইলে রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থভাবে বুঝিতে পারিবেন।" অর্থাৎ রামকথার মধ্যে ভারতকে এবং ভারতের মধ্যে রামকথাকে তিনি প্রতিফলিত হতে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেদিন ভক্ত দীনেশচন্দ্রের রামপূজায় "ঘণ্টা নাড়িবার ভার" পেয়ে বড়ো খুশি ছিলেন। তিনি জানতেন না একদিন এই রামপূজা এক ধৰ্ম-রাজনৈতিক গ্র্যান্ডন্যারেটিভের জন্ম দেবে। বাবরি মসজিদের ভগ্নস্তূপে নির্মিত হবে, রামমন্দির।
রবীন্দ্রনাথ তো রামায়ণকে কোনও বিশেষ সময়ের ইতিহাস বলেই মনে করতেন না। তাঁর কাছে রামায়ণ এক চিরকালীন ইতিহাস। এক আবহমান সত্য। অথচ রামলালা ঐতিহাসিক না হলে তাঁর জন্মভূমিও ঐতিহাসিক হয় না। আর সেই জন্মভূমির অধিকার নিয়ে এত রাজনীতি হয় না। এত দাঙ্গা হয় না। এত রক্তপাতও হয় না।
অথচ এটাই হয়েছে। বাল্মীকির নরচন্দ্রমা নিজের জন্মভূমিতে মন্দির তৈরির আর্জি নিয়ে আদালতে গেছেন। জিতে ফিরেছেন। লঙ্কাবিজয়ের থেকেও এই কল্পিত অযোধ্যার পুনর্বিজয় ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কিন্তু আর রবীন্দ্রনাথ কথিত চিরকালীন ইতিহাস নয়। বরং এক সাময়িক ইতিহাসের স্পর্ধা। এক পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ। মৌলবাদের উল্লাস।
নারদ এসে রবীন্দ্রনাথের 'কথা ও কাহিনী' কাব্যগ্রন্থের 'ভাষা ও ছন্দ' কবিতায় বাল্মীকিকে বলেছিলেন, "কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো"। কিন্তু আজকের প্রেক্ষিতে কবির মনোভূমি আর অযোধ্যার চেয়ে অধিক সত্য নয়। রাম ছিলেন মহাকাব্যের নায়ক। তাঁর দেবত্বটুকুকে আরও মহিমান্বিত করে কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, কম্বন, রঙ্গনাথ প্রমুখ প্রাদেশিক কবিরা ভারতের প্রায় প্রত্যেক ঘরে রামকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যার আবছায়ায় পিদিমের নিভু আলোয় কত শত বছর তাঁর পায়ে নিবেদিত হয়েছে ভক্তিকাব্য। মুখে মুখে রাম ছড়িয়ে পড়েছেন। সীতাও। লঙ্কাবিজয়ের থেকেও বড়ো এই সাম্রাজ্যবিস্তার। কবির মনোভূমি জন্ম দিয়েছিল যে ধীরোদাত্ত নায়কের, সেই নায়ক কিন্তু মৌলবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বড়ো ভালোবাসার মানুষ। আপনার জন। তাঁর সমস্ত গুণ এবং দোষ নিয়েই। তাই অযোধ্যার স্থানিক গুরুত্ব কোনও দিনই তেমন ছিল না। অযোধ্যার অধিপতি বস্তুত ভারতাত্মার হৃদয়েশ্বর হয়েই ছিলেন।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই অযোধ্যার স্থানিক গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। রামের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সেই বিতর্ক গড়ায় দাঙ্গায়। রবীন্দ্রনাথ এসব দেখে জাননি। ভাগ্যিস! তাঁর মনের আয়নায় যে রামের ছবিটি আঁকা তা সত্যিই আবহমান ভারতবর্ষের ছবি। তাই তো রবীন্দ্রনাথের বনবাস কবিতায় কথক মায়ের কাছে আবদার করে,
"আমাকে মা, শিখিয়ে দিবিরাম-যাত্রার গান,"
সেই গানে আছে তপোবনের স্নিগ্ধতা। লক্ষ্মণ ভাই, ঠাকুরদাদার মত মুনি ঋষি, গুহক মিতা, দুধভাত খাওয়া হনুমানকে নিয়ে বালকের কল্পরাজ্য। সেখানে তো মহাকাব্যের রণঝংকার নেই। আছে শান্তি। সেখানে অযোধ্যার নাম গন্ধ নেই। দণ্ডকবনটিও খুব দূরে কোথাও নয়। সেখানে গাছের ছায়ায় বেঁধে নেওয়া ঘর, সামনে ছোটো নদী, হরিণ, গাছে ফুল, ফল, পদ্মপাতে খাওয়া, রাখালের বাঁশি , ময়ূর,কাঠবিড়ালি, ডালের ফাঁকে সন্ধ্যাতারা...সব মিলিয়ে এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়। প্রাণের শান্তি। মনের আরাম।
"ঋজুপাঠের সামান্য উদ্ধৃত অংশ" পড়েই যে বালক মায়ের কাছে গর্ব করেছিল- "পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি" - আসলে সেই বালকটিই রামায়ণের আঁতের কথাটিকে ঠিক চিনেছিল। সেই বালকের মনোমুকুরে প্রতিফলিত রামায়ণই কি ভাষা পেয়েছিল শিশু কাব্যগ্রন্থের ‘বনবাস’ কবিতায়! পরিণত বয়সেও তো তাঁর চোখে রামায়ণ কেবলমাত্র বীররসের কাব্য থাকবে না। খন্ড সত্য থেকে পূর্ণ সত্যে যে যাত্রা ভারতীয় দার্শনিক সংস্কৃতির মূলে, সেই পূর্ণতাকেই প্রতিফলিত করবে রামায়ণ। অন্তত রবীন্দ্রনাথের চোখে।
রবীন্দ্রনাথ ভারত বলতে কোনো খণ্ডিত সত্তা বুঝতেন না। বুঝতেন না বলেই তিনি অনুবাদ করেছিলেন কবিরের। যাঁর লেখায় রাম আর করিম বারবার এক হয়ে গেছেন।
IF GOD BE within the mosque, then to whom does this world belong?If Ram be within the image which you find upon your pilgrimage, then who is there to know what happens without?Hari is in the East: Allah is in the West. Look within your heart, for there you will find both Karim and Ram;All the men and women of the world are His living forms.Kabir is the child of Allah and of Ram: He is my Guru, He is my Pir.
আসলে রবীন্দ্রনাথই পারেন এই অনুবাদ করতে। কারণ রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষে রামায়ণকে এবং রামায়ণে ভারতবর্ষকে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেন।
'আকাশ প্রদীপ' -এর 'যাত্রাপথ' কবিতায় বটতলায় ছাপা কৃত্তিবাসী রামায়ণের মলাট উপমিত হয় দিদিমায়ের বলিরেখাময় ললাটের সঙ্গে।
"কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা,দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা।আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগি তাহার মলাটদিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট।"
এ নিছক উপমা নয়। এই রামায়ণের প্রতি আপামর ভারতবাসীর অভিব্যক্তি। দিনানুদিনের নিয়ত অনিবার্যতায়, পূর্ব-পুরুষ আর পূর্ব-নারীদের মতোই রামায়ণ আমাদের মনে লগ্ন হয়ে আছে। সেখানে কোনও মৌলবাদ নেই। হিংসা নেই। ধর্ম সেখানে ধারণই করে। কোনও পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ তৈরি করে না।
রামকেন্দ্রিক যে উগ্র জাতীয়তাবাদ আজ এক রাজনৈতিক প্রতর্ক নির্মাণ করছে, রবীন্দ্রনাথ সেই প্রতর্কের পক্ষে খুব সুবিধাজনক পাঠ নন।
অনেকদিন আগেই তো তিনি বলেছিলেন," If India can offer to the world her solution, it will be a contribution to humanity. There is only one history - the history of man. All national histories are merely chapters in the larger one. "
রামকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী (কল্প)ইতিহাসের বিপরীতে এই মনুষ্যত্বের ইতিহাসসন্ধানকে হয়ত আমরা স্থাপন করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "জাতীয়তাকে আমরা পরম পদার্থ বলে পূজা করি নে এইটেই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তা- ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি, ভূমাত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ- এইটিই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তার মন্ত্র।" সুতরাং যা খন্ড করে, তা তো রবীন্দ্রনাথের অন্বিষ্ট নয়। সমস্ত বৈপরীত্যের ওপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। এবং এই সামঞ্জস্যের ধারণা তিনি পেয়েছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির আত্মার কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ সেই আত্মার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই রবীন্দ্রনাথের রাম কোনও বিভাজনের নায়ক নন। বরং এক সুবৃহৎ ঐক্যের চিহ্নায়ক।
অথচ রামায়ণ তো আজ এক ধর্ম-রাজনৈতিক আখ্যান। পরশু অযোধ্যার পুণ্যভূমিতে রামমন্দির কেন্দ্রিক বিতর্কের অবসান হয়েছে। "মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে"–এর দাবিতে সেই কুখ্যাত রথযাত্রার পরেই দেশ জুড়ে কার্যত শুরু হয়ে গেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রামের নামে চলছিল অসহিষ্ণুতা, হত্যা। ভারতীয় ভক্তিধারায় প্লাবিত রামনাম শোণিতস্পর্শে কলঙ্কিত হচ্ছিল। এখন সেসব অতীত। অযোধ্যা রামলালার। রামলালার এই তথাকথিত পুনর্বাসনের প্রকল্পে যেসমস্ত প্রাণ চলে গিয়েছিল, তাদের কথা আমরা ভুলে গেছি। আজ দেশ জুড়ে, "এক হি নাড়া এক হি রাম- জয় শ্রী রাম , জয় শ্রী রাম"। আজ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন।
[কভার ঋণ : economictimes.com]
#রামমন্দির #রবীন্দ্রনাথ #বাবরি মসজিদ