'ক্রিটিকাল আন্টি স্টাডিজ' : উপমহাদেশের সমালোচনাপ্রিয় কাকিমা-জেঠিমাদের নিয়ে গবেষণা
- Say Those Three Magical Words!- লোকে কী বলবে!
......
সিসিটিভি তো কাল-কা যোগী। আমাদের গোটা ছোটবেলাটা আলো করে ছিলেন পাড়ার কাকিমা-জেঠিমারা। সিসিটিভি আলট্রা ম্যাক্স প্রো। কার বাইকের পিছনে কে বসছে, কার স্কার্টের মাপ কত ইঞ্চি, পুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে কে কার গায়ে ফুল ছুঁড়েছে - সব এঁদের নখদর্পণে। ছেলেতে-মেয়েতে চোখাচোখি হলেই টরেটক্কায় খবর চলে যেত এঁদের কাছে। আমাদের পাড়ার চ্যাম্পিয়ন 'পিটিআই' ছিলেন পুষ্পজেঠিমা (নাম পরিবর্তিত। ভদ্রমহিলা সোশাল মিডিয়ায় খুবই অ্যাক্টিভ)। এখন বয়সের ভারে খানিক ন্যুব্জ এবং স্বেচ্ছাবসরে। কিন্তু নিজের সোনালি সময়ে পুষ্পজেঠিমা জেন ওয়াইয়ের কাছে ছিলেন মোগ্যাম্বো আর তমরাজ কিলবিশের ককটেল। পরীক্ষার্থীদের আগেই তাদের মাধ্যমিকের রেজাল্ট জেনে যেতেন। চোখে ছিল ইনফ্রারেড স্ক্যানার। ব্যাগের বুক-পেট দেখে বুঝে যেতেন ভিতরের বোতলটা বিপি নাকি ওল্ড মঙ্ক। শুধু দেখে-বুঝে ক্ষান্ত দিলে তো আপত্তির কিছু ছিল না। বউমা শাখা-পলা-সিঁদুর কিছুই পরে না বলে বচাদার মা এমনিতেই খচে থাকতেন। পুষ্পজেঠিমা পাড়ার প্যান্ডেলে নিরীহ মুখে টুক করে একটা মোক্ষম ওয়ান-লাইনার ছুঁড়ে তুষের আগুন খুঁচিয়ে দিলেন। ব্যাস। বচাদার সংসারটা পাকাপাকিভাবে প্যান-ফ্রায়েড হয়ে গেল। আর কুশল সেবার বেলঘরিয়া স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে হাই কোয়ালিটির 'বাবা' কিনতে গিয়ে কী করে পুষ্পজেঠিমার র্যাডারে ধরা পড়ে গেল, সে রহস্যের তো আজও সমাধান হয়নি। বাড়ি ফিরে নিজের বাবার হাতে সে কী উদোম ক্যালানি! কুশল সেই ট্রমা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এত বছর পেরিয়ে এসে আজও, নিজে বাবা হয়ে যাবার পরও, অফিস থেকে ফেরার পথে সিগারেট ধরালে পুকুরপাড়ের রাস্তা দিয়ে ঘুরে এক্সট্রা পাঁচ মিনিট হেঁটে বাড়ি ফেরে। জাস্ট পুষ্পজেঠিমার বাড়ির রাস্তা অ্যাভয়েড করবে বলে।
তো সেই পুষ্পকাকিমাদের নিয়েই কিনা লেখা হচ্ছে সিরিয়াস গবেষণাপত্র। স্ক্রল ডট ইন-এর প্রতিবেদনটা দেখে ব্যোমকে গেছিলাম। টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ভারতীয় বংশোদ্ভুত করিম খুবচন্দানি এই নিয়ে আস্ত একটা অ্যাকাডেমিক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে ফেলেছেন, যেখানে গবেষক বা সমাজবিজ্ঞানী ছাড়াও আহ্বান জানানো হয়েছে লেখক, শিল্পী সহ সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ক্ষেত্রের মানুষকেই। মাঝে মাঝেই অনলাইন বা অফলাইনে জমায়েত আয়োজন করবেন তাঁরা। কোথা থেকে এল এমন পুঁদিচ্ছেরি ভাবনা? কী বলছেন করিম? তাঁর কথায়, উপমহাদেশের এই সমালোচনাপ্রিয় কাকিমা-জেঠিমারা সর্বব্যাপ্ত হলেও বড়োই 'Under theorized'। করিমের কৈফিয়তের একটুখানি অংশ উদ্ধার করি - “...She is a liminal figure who might surveil the family’s boundaries or perhaps facilitate transgressions...These aunties acquire their moniker not just through age or kinship, but through performance: melodramatic speech, maximalist fashion, searing glances, muscular femininity, and distinct hairstyles. Performance is central to portraying the aunty, but also a valuable method and analytic to keep up with her mercurial energies. ” 'আন্টি'-দের উদগ্র পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সদাজাগ্রত চোখ-কান, দু-কূল ছাপানো কৌতূহল, সবকিছুর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে গলে যাওয়া নাক, অতিনাটকীয় কথাবার্তা, ড্রেসিং সেন্স - সবকিছুকেই আর্থ-সামাজিকভাবে ব্যাখ্যা করতে চান করিম। নিছক অ্যাকাডেমিক চর্চা নয়, তিনি চান এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা ও আলোচনার একটা বহুমুখী পরিসর তৈরি করতে।
করিমের ছোটবেলা কেটেছে ঘানায়। এলাকাটা ছিল সিন্ধি-কলোনি। সিন্ধি সংস্কৃতির মধ্যেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ফলে প্রবাসী হলেও টিপিকাল ভারতীয় মানসিকতাকে কায়মনোবাক্যে জানার সুযোগ পেয়েছেন। করিম নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, প্রবাসেও ভারতীয় 'আন্টি'রা তৈরি করে রাখেন নিজেদের পরিমণ্ডল। গুরিন্দর চাড্ডার ছায়াছবি 'Bhaji on the Beach' বা 'Bend it Like Beckham' কিংবা জনপ্রিয় টিভি-সিরিজ 'Goodness Gracious Me'-এর মতো ইন্দো-ব্রিটিশ প্রজেক্টে প্রবাসী ভারতীয় 'আন্টি'-দের আচরণও ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে তাঁকে। লিঙ্গচেতনা, নারীবাদ নিয়ে করিমের লেখালিখি আন্তর্জাতিক মহলে সমাদৃত। ‘Ishtyle: Accenting Gay Indian Nightlife’ নামে একটি বই লিখেছেন। The Scholar and Feminist Online বা Transgender Studies Quarterly-র মতো প্রথম সারির পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখেন। তাঁর এই নতুন প্রজেক্টও অনেকের নজর কাড়ছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাভাবিক জনমানসিকতা কতটা পিতৃতান্ত্রিক সেটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমাদের পারিবারিক-সামাজিক কাঠামো মহিলাদের নিজস্ব জীবন গড়ে ওঠার পরিপন্থী। মেয়েদের আস্ত মানুষ ভাবতে শেখা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। 'মা' পরিচয়ের তলায় চাপা পড়ে কত মহিলাকে চুপিচুপি একা একা শেষ হয়ে গেছেন তার হিসেব নেই। পুরুষতন্ত্র এঁদের ত্যাগ শিখিয়েছে। ভাবতে বাধ্য করেছে যে সংসারের পাপোশ হওয়াই মেয়েদের ধর্ম। ফলে একটা বয়সের পর অনিবার্য শূন্যতাই নিয়তি। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে অনির্দেশ্য বিরক্তি, অসূয়া। সঙ্গে মেনোপজ-ঘটিত হরমোনাল ঘোটালা তো থাকেই। ফলে উদারতা কমে আসে। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে এমপ্যাথি কমতে কমতে মাইনাসে চলে যায়। নিজেদের আকাশচুম্বী না-পাওয়ার পাশে নতুন প্রজন্মের টুকটাক পাওয়াগুলোকে রেখে দেখলে অসচেতনেই কোথাও খোঁচা মারতে থাকে হিংসে। তার প্রকাশ স্বাভাবিকভাবেই খুব সুখকর হয় না। করিম এ-বিষয়ে ভারতীয় সিনেমা, সিরিয়াল, সোপ অপেরাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও বলেছেন। বছরের পর বছর নারী চরিত্রগুলোকে টাইপকাস্ট করে দর্শকের মনে ঠুসে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে 'আন্টি' শব্দটা নতুন প্রজন্মের কাছে খানিকটা বিরক্তি, খানিকটা নেতিবাচক ভাবনা নিয়েই আসে। কিন্তু তাঁরা ‘সোশাল প্রোডাক্ট’ বৈ তো নন। সিমোন দ্য বভেয়ার অবিস্মরণীয় আপ্তবাক্য অবলম্বনে বলা যায় - ‘আন্টি’রা তো 'আন্টি' হয়ে জন্মান না, তাঁদের 'আন্টি' করে তোলা হয়। ‘কাকিমায়ন’ বা ‘জেঠিমায়ন’-এর সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াটিকেই পড়তে চাইছেন করিম ও তাঁর সঙ্গীরা। সঙ্গে নানা দেশের শিল্পীরা রয়েছেন তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে। রয়েছেন ফটোগ্রাফার, ফ্যাশন ডিজাইনার, আইনজীবী সহ নানা পেশার মানুষ, তাঁদের নানারকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। উপমহাদেশের মধ্যবয়সী মহিলাদের নিয়ে এমন মরমী অধ্যয়ন ইতোপূর্বে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। অন্তত এত বড় মাপের কাজ তো হয়ইনি। তবে করিমরা শুধু উপমহাদেশে আটকে থাকতে চান না। এই বয়সী মহিলাদের নিয়ে সবিস্তারে কাজ করতে চাইছেন তাঁরা। নানাদিক থেকে দেখতে চাইছেন এই বয়সটাকে। ফলে ক্রমশ একটা মাল্টিকালচারাল রূপ পাচ্ছে তাঁদের চর্চা। এ-কাজ ধারাবাহিকভাবে চলবে। আগ্রহীরা চাইলে ঘুরে আসতে পারেন করিমদের ওয়েবসাইট থেকে। নিচে দেওয়া রইল ঠিকানা।
https://www.criticalauntystudies.com/
….……..
ঋণ : Priyali Prakash, scroll.in
#Critical Aunty Studies #Kareem Khubchandani