ফিচার

'আরণ্যক'-কে গ্লোব নার্সারির ক্যাটালগ বলেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়

বিবস্বান দত্ত Mar 23, 2022 at 6:13 am ফিচার

বাংলা নিয়ে যাঁরা পড়াশুনা করেন, তাঁদের সম্পর্কে একটা অনিবার্য ভুল ধারণা থাকে। যে তাঁরা সকলেই নিশ্চয়ই "লেখেন টেখেন"। সাহিত্য পড়লেই যে সাহিত্যিক হতে হবে, এই সামাজিক দায় হয়ত শুধু বাংলার ছাত্রদের ওপরেই বর্তেছে কোনও অজানা কারণে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য,বাংলার অনেক দিকপাল সাহিত্যিক-ই ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। কেউ কেউ বাংলা সাহিত্যের ছাত্র।

অনেকগুলো নাম এলোমেলো মনে আসে। অনিবার্যভাবে আসে শঙ্খ ঘোষের নাম। এবং হয়ত ততটা মনে পড়ে না শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা। 

শক্তি ঠিক যে যে কারণে বিখ্যাত এবং যে যে কারণে কুখ্যাত তার মধ্যে তাঁর 'সাহিত্যের ছাত্র' পরিচয় নেহাতই গৌণ হয়ে গেছে। তিনি কিন্তু ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। 

প্রেসিডেন্সির মেইন বিল্ডিয়ের তেতলায় নয় নম্বর ঘরে তখন বসত অনার্সের ক্লাস। পড়াশুনায় যে তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন না সে কথা তাঁর বন্ধু এবং সতীর্থরা প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন। উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্সির এক সাধারণ ছাত্রের কথা। পাঞ্জাবি পায়জামা পরা, অবিরত সিগারেট টানা এক নিতান্ত সাধারণ ছাত্র। যে কিনা কেবল বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকত প্রেসিডেন্সি কলেজের নয় নম্বর ঘর কিংবা বাইশ নম্বর ঘরের সামনে। অনেক সময়েই ক্লাসে ঢুকত না।  বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে, ঘণ্টা পড়ার আগেই,  সে "দে চম্পট"! 

তবে সমস্ত প্রদীপেরই থাকে একটা সলতে পাকানোর সময়। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে হঠাৎ করে কবিতা লিখে ফেলা শক্তির পড়াশুনা, ছন্দ নিয়ে অভ্যাস এইসমস্ত জানলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এক আপাত ভবঘুরে, দিব্যোন্মাদ কবি, কবিতার জন্য নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন এক অন্যতর নিভৃত সাধনায়। শুধু বিশাল প্রতিভা থাকলেই একজন মানুষ শক্তি চট্টোপাধ্যায় হন না। অক্ষরবৃত্তে কথোপকথন চালানোর আগে থাকে এক দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। সেই প্রস্তুতি কি শুরু হয়ে গেছিল প্রেসিডেন্সির অসম্পূর্ণ কলেজ বেলায়? প্রকৃতি শক্তির লেখালেখিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বারবার। তাঁর বিখ্যাত 'কুয়োতলা' উপন্যাস পড়লেই বোঝা যায়, প্রকৃতির সঙ্গে কেমন যোগ দীর্ঘদিন থেকেই নিজের অন্দরে অন্তরে ধারণ করতেন শক্তি। কলেজবেলায় বিভূতিভূষণ -পাঠ হয়ত সেই প্রকৃতি পড়ুয়াকে এনে দাঁড় করিয়েছিল এক আশ্চর্য পৃথিবীর সামনে। তবে কেবল মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকেননি শক্তি। তাকে বিশ্লেষণ করেছেন। এবং ভুল হোক, ঠিক হোক নিজের মত খুব দৃঢ় ভাবে প্রকাশ করেছেন ।

আরও পড়ুন : শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও একটি ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য / শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের লেখা থেকে জানা যায়, আরণ্যক উপন্যাস সম্পর্কে কলেজ বেলায় , টিউটোরিয়ালের খাতায় ঠিক কী লিখেছিলেন শক্তি! 'আরণ্যক' উপন্যাসে গাছ- গাছড়া,ফুল -লতাপাতার নামের বহর দেখে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় মনে করেছিলেন,এ যেন শিল্পী বিভূতিভূষণের অতি আসক্তির প্রমাণ। স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, উপন্যাসটা অনেক জায়গাতেই গ্লোব নার্সারির ক্যাটালগ হয়েছে। 

এই লেখা পড়ে, প্রচণ্ড রেগে গিয়ে অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী শক্তিকে বের করে দিয়েছিলেন ক্লাস থেকে। 

আরও পড়ুন : ‘শক্তি’পাঠ ও নীরবতা / শুভঙ্কর ঘোষ রায়চৌধুরী

অনেকদিন পর,শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীর গেস্ট হাউজের উনিশ নম্বর ঘরে যখন মারা যান শক্তি, তখন নাকি বৃদ্ধ ভূদেব চৌধুরী অনেকক্ষন এসে চুপ করে বসেছিলেন, তাঁর এক কালের সেই দুরন্ত ছাত্রটির পাশে। প্রচণ্ড ধমক খেয়ে সেদিনের ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া সেই অলৌকিক সদ্য-যুবক , আজ এত দিন পর বেরিয়ে গেল এই পৃথিবীর ক্লাসরুম ছেড়ে। মাঝের রাস্তাটুকু শুধু জয়ের আর ক্ষয়ের। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আরণ্যক'কে  "গ্লোব নার্সারির ক্যাটালগ" বলতে একজন শক্তি চট্টোপাধ্যায় লাগে। 


........................ 

কৃতজ্ঞতা: ১) শক্তি চট্টোপাধ্যায়- মানুষ ও কবি, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার,   প্রসঙ্গ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদনা: গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়।


#শক্তি চট্টোপাধ্যায় #আরণ্যক #বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় #ভূদেব চৌধুরী #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #silly পয়েন্ট #ফিচার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

39

Unique Visitors

215814