“ভালোবাসা! তুমি এখন কেমন আছো!” : শতবর্ষে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তিনি নিজে দাবি করেছেন যে তিনি উত্তেজনা ছড়ান না। “কেননা এ মৃতবৎসা দেশে আগুনের ফুলকিগুলি শ্মশানের বাহবা বাড়ায়…”। তবে এই একটা কথা কলেজবয়েসে আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি। কলেজবয়েসে স্লোগান ধার করা হত নবারুণ, সুমন আর বীরেন্দ্রবাবুর থেকে। স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেওয়ালে দেওয়ালেই তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। অনেক পরে বুঝেছিলাম, স্লোগান হয়ে যাওয়াটা কবি-শিল্পীদের কাছে শেষপর্যন্ত একটা ফাঁদ। মানুষ একবার যাঁদের ‘স্লোগান’ করে ফেলে, সেইসব কবিরা আর সেই ফাঁদ কেটে বেরোতে পারেন না কোনওদিন। এমনিতেই একমেটে দু-একটা তকমা এঁটে দিতে পারলে বড় নিশ্চিন্ত হয় মানুষ। এমনকি অ্যাকাডেমিক দুনিয়াও তাই। বীরেন্দ্র নিঃসন্দেহে বামপন্থী কবি। বামপন্থী রাজনীতি তাঁর কবিতার মূলধাতু। কিন্তু চার ছিপি প্রতিবাদের সঙ্গে তিন ছিপি বামপন্থা মিশিয়ে দু’ ফোঁটা অ্যান্টি এসট্যাবলিশমেন্ট ঢেলে দিলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়ে একটা রদ্দি লেকচার বা পেপার হয় বড়জোর, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়না। অনেক পরে মনে হয়েছে, আসলে সেই কারণেই বীরেন্দ্র লিখেছিলেন, “উত্তেজনা ছড়াই না।” [মাতলামো/ রাস্তায় যে হেঁটে যায়] কবির কাজ উত্তেজনা ছড়ানো নয়। নিছক উত্তেজনা ছড়ানো কর্মীরও কাজ নয়। সংগঠকেরও না। মাতিয়ে তোলা আর পাকিয়ে তোলার মধ্যে ততটাই ঘনিষ্ঠতা যতটা মোহনবাগানের সঙ্গে দিয়েগো মারাদোনার। বীরেন্দ্রবাবু বিষয়টা বুঝতেন। নাহলে কেউ লিখতে পারে না,
“তোমার কাজআগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয় - আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।”অস্থির হয়ো না; শুধু, প্রস্তুত হও!” [সাগ্নিক/ পৃথিবী ঘুরছে] সকলে জানে তিনি কবিতার চেয়ে জীবনকে এগিয়ে রাখতেন ঘোষিতভাবে। তাঁর ঘরানাটাই তাই।
তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বশে অজস্র কবিতা লিখেছেন। নজরুল- পরবর্তী মূলধারার বাংলা কবিতায় এমন আর কাউকে মনে পড়ে না যিনি এভাবে ঘটনার পর ঘটনার আঘাতে সাড়া দিয়ে কবিতা লিখে গেছেন। খাদ্য আন্দোলন, মূল্যবৃদ্ধি,মাইনে বন্ধ, অনাহারে মৃত্যু, ধর্মঘট, লক আউট, ময়দানে প্রবীর দত্তের খুন থেকে আফ্রিকার কফি-শ্রমিক বা চেরি-শ্রমিক, ভিয়েতনামের আহত প্রজন্ম - সব উঠে আসে তাঁর কবিতায়। সবই তাঁর স্বভূমি। সবই তাঁর মাটি। আগুনের মতো ক্রোধ নিয়ে বীরেন্দ্রর লিওনার্দো সরাসরি জানিয়ে দেন, “আমি মাইকেল এঞ্জেলো নই/ সব অপমানের ভিতরেও যিনি বিশুদ্ধ শিল্প রচনা করেন…”। [লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি/ আমার যজ্ঞের ঘোড়া]
তবে যুগকে ছুঁয়েও যুগোত্তীর্ণ হতে পেরেছেন বলেই না শতবর্ষ পরে আবার ফিরে তাকাতে হচ্ছে তাঁর কবিতার দিকে। বিশুদ্ধতায় বিশ্বাস তো করতেনই না, কবিতার বিন্দুমাত্র প্রসাধনেও বীরেন্দ্রবাবু বিশ্বাস করতেন না। তাই ‘আনন্দবাজারি’ হয়ে যাওয়া নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার সেই শিশুটির খোঁজ করেছেন আর সেটি প্রায় কাঁচা অবস্থায় বেরিয়ে আসা বলে মনে হয় - “নীরেন, তুমি বলতে পারো/ কোথায় গেল সে?/ নাকি, তুমি বলবে না আর;/ তোমার যে আজ মাইনে বেড়েছে!” [নীরেন, তোমার ন্যাংটো রাজা/ মানুষখেকো বাঘেরা বড় লাফায়]
বীরেন্দ্রবাবুর কবিতা সম্পর্কে প্রায়শই মনে হয়েছে যে তাঁর অনেক কবিতাই আসলে কবিতার কাঁচামাল। উপযুক্ত মণ্ডনকলার তীব্র হাহাকার সেখানে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি ওই নগ্নতাই তাঁর সবচেয়ে জোরের জায়গা। ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ শব্দপরম্পরা নিজেই একটা গোটা কবিতা। বস্তুত আর কিছুই নেই এই কবিতাটিতে। আসলে আর কিছু থাকার দরকারই নেই। ভাতের গন্ধ বিষয়টা যেমন কোনও এডিট ছাড়াই যথাযথ, বীরেন্দ্রর কবিতাও অনেকটা সেরকম। শঙ্খবাবু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রের ভূমিকায় ‘নিরাভরণ’ বলেছেন তাঁর কবিতাকে - “নিরাভরণ ঘোষণার ভাষায় বা পথচলতি দৈনন্দিন রূঢ়তায় ছড়িয়ে দেন তিনি কবিতা, আর কবিতাবিচারের এক নতুন মান তখন আমাদের তৈরি করে নিতে হয় তাঁরই কবিতার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ সামনে রেখে।” এক পর্দা বাড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করে কখনও কখনও। তাঁর কবিতা নগ্ন। প্রাকৃত। আর সেখানেই তার আসল সুন্দরতা।
তবে এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনা হয়নি বা হয়না এমন বিষয়গুলোর দিকে তাকানো দরকার। মাটি এখন আগুনের মতো। কারণ আমরা ফসল ফলাতে জানি না। আমাদের রক্তপাতের বোধও চুরি হয়ে যাচ্ছে। সিস্টেম তার সমস্ত অ্যাপারেটাস নিয়ে খণ্ড-দর্শনের জীবনবোধ ইঞ্জেকট করে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে। কারো জন্মশতবর্ষে চর্বিত-চর্বণ না আওড়ে তাই সবচেয়ে দরকার উল্টেপাল্টে নানা দিক থেকে মানুষটাকে বুঝে নেওয়া। কবিকে সম্পূর্ণত বুঝে নেওয়া বাকি থেকে গেছে। সেরকম ইচ্ছেও চোখে পড়ে না বিশেষ।
এই ‘টু লাইনার’ সময় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিদের জন্য সবচেয়ে ভয়ের। প্রগতিশীল রাজনীতি- বিলাসীরা টুকরো টুকরো করে নিয়ে গেছেন তাঁকে। টাঙিয়ে দিয়েছেন দেওয়ালে ফেস্টুনে। অজস্র চিৎকারের মাঝখানে কবি হাঁটছেন ঠিকই। কিন্তু তার বাইরেও তো হাঁটু মুড়ে বসে আছেন কোথাও। চুপিচুপি, একা একা। চিৎকারটা নিঃসন্দেহে তিনি। আর ওই অপূর্ব একা হয়ে যাওয়াটা? ওটাও তো তিনিই। দুজন আসলে একই মানুষ। একজনই কবি। ‘ভারতবর্ষ’, ‘লাল টুকটুক নিশান ছিল’, 'জন্মভূমি আজ', ‘মুখে যদি রক্ত ওঠে’ কিংবা 'মহাদেবের দুয়ার' কবিতাগুচ্ছের ১৩ সংখ্যক কবিতা দিয়ে তাঁকে মনে রাখা হলে আপত্তি নেই। কিন্তু ‘যোদ্ধার হৃদয় বলে কিছু নেই’ বা ‘প্রভাস’? পড়ে দেখব না আমরা?
বুঝে নিতে চাইব না 'মানুষ' কবিতার সেই আশ্চর্য উচ্চারণের অন্তর্দেশ? - "তবু সে এখনো মুখ দেখে চমকায়/ এখনো সে মাটি পেলে প্রতিমা বানায়।" কিংবা ‘পাতাঝরা গাছেদের গান’ কবিতার শেষ লাইন - “এখন বড় কঠিন সময়। ভালোবাসা! তুমি এখন কেমন আছো!”
ভেবে দেখতে চাইব না, কেন কালীকৃষ্ণ গুহ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যচর্চাকে ‘আশ্চর্য বিমূর্ততা’ খুঁজে পেয়েছিলেন, যা “টিপিকাল রাজনৈতিক কবিতায় থাকে না…”?
কেন তবে জন্মশতবর্ষের এই বাজারি?
#ফিচার #বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় #জন্মশতবর্ষ #স্মরণ #আহ্নিক বসু