হাতের মুঠোয় ইরফানের হারানো সিনেমা
ফিল্ম – দুবাই রিটার্ন পরিচালক – আদিত্য ভট্টাচার্য গল্পকার – বিনয় চৌধুরী মাধ্যম – ইউটিউব
‘দুবাই রিটার্ন’ বানানো হয়েছিল ২০০৫ সালে; এমন একটা সময়ে, যখন ইরফান খানের উড়ান সদ্য ডানা মেলেছে। দুবছর আগে বেরিয়েছে ‘মকবুল’, পরের বছরে বেরোবে ‘নেমসেক’; সবাই চিনবে নাসির-ওম-নানা ঘরানার প্রকৃত উত্তরসূরিকে। রসিক ইরফান তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। আদিত্য ভট্টাচার্য-ই সম্ভবত প্রথম পরিচালক যিনি গল্পের মুখ্য চরিত্রে ইরফানের কমিক অভিনয়ের মণিমুক্তো সেঁচে এনেছেন। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁরা কেউই সেই প্রশংসার ভাগ পাননি। ‘দুবাই রিটার্ন’ আন্তর্জাতিক মহলে সম্মান কুড়োলেও, দেশের বাজারে তার একটা হলও জোটেনি। সম্প্রতি বান্দ্রা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনের জন্য ইন্টারনেটে মুক্তি পেল সিনেমাটি।
গল্পের হিরো আফতাব আংরেজ নব্বই দশকের বোম্বে-র এক ছোটোখাটো গ্যাং-এর সদস্য। গুরু খিলজি ভাই আর শাগরেদ নন্দু-র সঙ্গে মিলে সে নামকরা গ্যাংস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ভাগ্যের ফেরে সে সুযোগ এসেও যায় একদিন। ১৯৯২ সালের এক সন্ধ্যায় প্রভাবশালী বিত্তবান গঙ্গাধর রাওতে-কে মারার দায়িত্ব সে পালন করে নিজস্ব স্টাইলে, তারপর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পাড়ি দেয় দুবাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে জোটে পেট্রোল পাম্প স্টেশনের চাকরি। ছোটো জীবনের গণ্ডিতে হাঁফিয়ে ওঠে আফতাব, সে চায় গ্যাংস্টারের রোয়াবে বাঁচতে। তাই পাক্কা দশ বছর পরে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে। এসে দেখে বোম্বে হয়ে গেছে মুম্বাই, আর রাওতে খুনের দায় পড়েছে আরেক গ্যাংস্টারের ঘাড়ে! সে শহরে আফতাবকে না কেউ চেনে, না কেউ তার কৃতিত্বের কথা বিশ্বাস করে। হারানো সম্মান ফেরত পেতে মরিয়া আফতাব আবার একজোট করে তার সঙ্গীদের, খুঁজে বের করে সেই রাতের এক প্রত্যক্ষদর্শীকে। একের পর এক ঘটনার জালে জড়িয়ে যেতে থাকে তারা, আর একটু একটু করে জট খোলে রাওতে খুনের আসল রহস্যের।
গোটা সিনেমা জুড়ে বোম্বে থেকে মুম্বাই হয়ে ওঠার বদলকে দুর্দান্তভাবে কাজে লাগিয়েছেন আদিত্য। নব্বইয়ের বোম্বে ছিল মাফিয়ারাজ আর খুনজখমের স্বর্গরাজ্য। প্রতিটি উঠতি অপরাধীর হিরো ছিল আবু সালেম, দাউদ ইব্রাহিম। আফতাব আংরেজ সেইসব মানুষের ক্ষুদ্রতার এক হাস্যকর দাস্তান। দুবাইয়ে গিয়েও সে দাউদ হয়ে ফিরতে পারেনি, উল্টে একটিমাত্র খ্যাতির ট্রফিও এখন হাতছাড়া। তার সাধের আন্ডারওয়ার্ল্ড জীবন, প্রিয় ম্যাঙ্গোলার মতোই, হারিয়ে যেতে বসেছে। পুরনো আড্ডার ঠেক, পার্সি ক্যাফের জায়গা নিচ্ছে শপিং মল। এই আবহ গায়ে মেখে চিত্রনাট্য এগিয়ে চলে রহস্য আর রসবোধের জোড়-ঝালা-আলাপ ধরে। খিলজি ভাইয়ের ভূমিকায় আরেক প্রয়াত অভিনেতা রাজ্জাক খান অনবদ্য কাজ করে গেছেন। এই ছবিতে তাঁর অনুচ্চকিত অভিনয় দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন যে অধিকাংশ মানুষ রাজ্জাক-কে চেনেন মূলত নিনজা চাচা, টক্কর পেহলওয়ান-এর মতো মোটা দাগের কমিক চরিত্রের জন্য। বিজয় মৌর্য্য, দিব্যা দত্তা, রিতু শিবপুরী – প্রত্যেকেই নিজের নিজের চরিত্রে যথাযথ। আলাদা করে বলতে হয় আক্কি নারুলা-র পোশাক পরিকল্পনার কথা। মিলেনিয়াম মুম্বাইতে দুবাই-ফেরত আফতাবের পোশাক নির্বাচনে তিনি যে ভাবনার ছাপ রেখেছেন, তা কুর্নিশযোগ্য। একটু এদিক-ওদিক হলে যেসব পোশাক আফতাবকে ভাঁড় বানিয়ে দিতে পারত, সেগুলোই তাকে সিনেমা জুড়ে শুধু খাপছাড়া করে রেখে গেল।
আরও পড়ুন : ওয়েব সিরিজ রিভিউ : তাজ মহল ১৯৮৯ / সায়নদীপ গুপ্ত
এবং ইরফান। পছন্দের চরিত্র পেলে তিনি কোনোদিন অভিনয়মাত্র করেন না, এখানেও নিজেই আফতাব হয়ে উঠেছেন। তার ব্যর্থতার গ্লানি, খ্যাতির কাঙালপনা, সবকিছুকে এক অদ্ভুত সারল্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। সেই সারল্যের জোরেই আফতাবের ছেলেমানুষি দম্ভ তাকে কার্টুন বানায়, ক্যারিকেচার করে দেয় না। তার অসহায়তা আমাদের হাসির খোরাক জোগায়, কিন্তু একবারের জন্যও তাকে দুচ্ছাই করতে দেয় না। কমেডি অভিনয়ের ‘nuance’ নিয়ে অনায়াস ছিনিমিনি খেলেন ইরফান। বস্তুত, অভিনয়ের এমন কোনো মাইলফলক নেই যা ইরফান তাঁর জীবদ্দশায় একবার অন্তত ছুঁয়ে যাননি। তবু জীবনের শেষ প্রান্তে ক্যানসারের সঙ্গে লড়তে লড়তে যখন ‘করিব করিব সিঙ্গল’-এ কাজ করছেন, তখন নিজেই বলেছেন যে তাঁর সবচাইতে আনন্দ লাগে কমেডি অভিনয়ে, অথচ সবাই শুধু তাঁকে সিরিয়াস চরিত্রেই ভাবে! কমিক, সিরিও-কমিক এবং ব্ল্যাক-কমিক চরিত্রে ইরফানের দক্ষতা কোন মাত্রায় তা ‘কারওয়াঁ’, ‘ব্ল্যাকমেইল’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ প্রভৃতি সিনেমার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আর এই তালিকায় যে নামটি সবার আগে আসতে পারত, তা হল ‘দুবাই রিটার্ন’। গোটা সিনেমা জুড়ে ইরফান একেবারে নিচু তারে বেঁধে রাখেন নিজেকে, চিত্রনাট্য আর সংলাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করেন সিরিও-কমিক অভিনয়ের এক ক্লাসিক্যাল নিদর্শন। আজকের ROFL-LOL সমৃদ্ধ দুনিয়ায় তাঁর অভিনীত আফতাব আংরেজ আমাদের মগজ-মন পরিতৃপ্ত করে কখন যে একগাল হাসিয়ে ছাড়ে, আমরা টেরও পাই না।
আরও পড়ুন : সত্যজিৎ, স্পর্শ, কাতরতা / শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
এই সিনেমার চলনে ছায়া ফেলেছে আশির দশকের আরেক কাল্ট, ‘জানে ভি দো ইয়ারো’, তবে দুইয়ের মধ্যে তুলনা অনর্থক। ‘দুবাই রিটার্ন’-এর কমেডিতে অন্ধকারের ভাগ অনেকটাই কম। আবহে কিশোরকুমার, আর ডি বর্মণের গানের ব্যবহার গল্পের স্বাদ বাড়ায়, কিন্তু সম্পাদনার দুর্বলতা কাঁকরের মতো মুখে লাগে। এনকাউন্টার স্পেশ্যালিস্টের ব্যক্তিগত জীবনের দৃশ্য গল্পে কোনও আলাদা মাত্রা আনে না, আবার ঠিক কোন ঘটনার পর থেকে খিলজি ভাই স্বমহিমায় ফেরত এলেন তাও স্পষ্ট হয় না। তবে কাদামাটি সঙ্গে নিয়েই এটি অতীত খুঁড়ে পাওয়া গুপ্তধনের কলস। বান্দ্রা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ইউটিউব চ্যানেলে আগামী ৩রা অগস্ট অবধি বিনামূল্যে এর জৌলুস চাক্ষুষ করা যাবে।
ইরফানকে ফিরে পাওয়ার এমন সুযোগ হারাবেন না!
....................................
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #ফিল্ম রিভিউ #review #Irrfan Khan #Dubai Return #সায়নদীপ গুপ্ত