নিবন্ধ

হাই-টি

রোহন রায় Nov 1, 2020 at 9:13 am নিবন্ধ

রসিয়ে কষিয়ে : সপ্তম পর্ব


খাবি কী! ঝাঁঝেই মরে যাবি!

‘হাই-টি’ ব্যাপারটার এর চেয়ে ভালো সংজ্ঞার্থ হতে পারে না। বিষয়টা এতই হাই-ফাই যে, তার নাগাল পাওয়া মধ্যবিত্তের পক্ষে ‘ওয়ান্স ইন আ ব্লু মুন’ ঘটনা। তাও খুব কপাল করলে তবেই। কর্পোরেট অফিসের পার্টি বা বিরাট বড়লোক আত্মীয়ের বিয়েশাদিতে কখনও সখনও এ সুযোগ চলে আসে। আমারও সেভাবেই এসেছিল। 

ব্যক্তিগতভাবে চর্মচক্ষে মাত্র দুবার দেখার (এবং চাখার) সৌভাগ্য হয়েছে। প্রথমবার তো ধাক্কা সামলে উঠতেই অনেকটা সময় লেগে গেছিল। বাকিটা গেছিল কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব ভাবতে। একটু পাস্তা খেয়ে তারপর ঠেকুয়ার মতো কী একটায় সবে কামড় বসিয়েছি, তারপরেই কে যেন বলল এবার মেন কোর্স খেতে ডাকছে। আমার আবার একগাল মাছি। এরপরেও মেন কোর্স! কয় কী! এটা কী ছিল তবে? এই যে প্রায় যুবভারতীর মতো বড় একটা হলঘরে কয়েকশো খাবার সাজানো, এ শুধুই ট্রেলার? আসল ফিলিম তাহলে কেমন? 

পাশে মাসতুতো দাদা দাঁড়িয়ে দইবড়া খাচ্ছিল। খুব চোয়াল চালাতে হচ্ছিল বলে মুখটা ঈষৎ বেগুনি। ধরা গলায় ওকে জিগ্যেস করলাম, “এগুলো স্টার্টার? অ্যাতো?” 

দাদা সুড়ুত করে দইয়ের ঝোল টেনে বলল, “হাই-টি!”  

“হাইতি?” আমি একটু অবাকই হলাম। বাঙালি ‘গ্লোবালতা’-বিলাসী জানি, কিন্তু তা বলে এতদূর পৌঁছে গেছে তার রসনা, ভাবতেই পারছিলাম না আমি, “হাইতির স্টাইলে খাওয়া? হাইতিতে লোকে এত খায়?”  

“ধুর পাঁঠা! হাইতি না! খুব বড়ো বুর্জোয়াদের পার্টিতে স্টার্টারকে ‘হাই-টি’ বলে। কারণ তাতে চা-ও থাকে।” 

“চা আছে নাকি?”

“আছে তো। ওইখানে দ্যাখ। আট-দশ রকমের চা-ই শুধু। কফিও আছে।” 

দেখলাম সত্যিই তাই। ‘টা’-এর চোটে চা মিস করে গেছি। মশালা চা, হোয়াইট চা, লেমন চা, অরেঞ্জ চা, কার্ডামম চা, আরও কত কী। 

যেন রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠলাম। খাদ্যরসিক বলে নিজের পরিচয় দিই, অথচ এমন একটা ‘টার্ম’ স্রেফ শুনিইনি! এ কি মানা যায়! সেদিন বাড়ি ফিরেই ইন্টারনেট আতিপাঁতি করে খুঁজে পড়াশুনো করলাম। নেটে জম্পেশ একটা বইয়ের পিডিএফও পেয়ে গেলাম। জিল ইভান্স আর জো গাম্বাকোর্তার লেখা ‘High Tea’। আজকের লেখায় যা লিখব, তা মূলত এই বই থেকেই সংগৃহীত তথ্য। সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন ওয়াকিবহাল মহল থেকে শোনা রোমহর্ষক কিছু কথাবার্তা।   

এখনকার প্রচলিত অর্থ যদি ধরি, তাহলে ‘হাই-টি’ হচ্ছে অভিজাতদের এক বিশেষ চা-আড্ডা। বলা যায় বৈকালিক বা সান্ধ্য চায়ের পার্টি। তবে চায়ের সঙ্গে ‘টা’-এর পরিমাণ অনেকটা বেশি হলে তবেই তাকে ‘হাই-টি’ বলা যাবে। বলে রাখা ভালো, বরাবর এই শব্দবন্ধের এই অর্থ ছিল না। এ আদতে পুরোনো ব্রিটিশ ট্রাডিশন। এমনিতে চায়ের নেমন্তন্ন জিনিসটা আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি সংস্কৃতিতে কোনও কালে ছিল না বললেই চলে। আমরা কবজি ডোবানো ব্যতিরেকে খাওয়া বা খাওয়ানোর কোনও অর্থ খুঁজে পাই না। কিন্তু ব্রিটিশ সমাজে চায়ের নেমন্তন্ন একটা সামাজিক শিষ্টাচারের অঙ্গ। ব্রিটিশরা এমনিতেই চা-পাগল। ও দেশে ডিনার বা লাঞ্চের চেয়ে চায়ের নেমন্তন্ন অনেক বেশি প্রচলিত। এই চায়ের নেমন্তন্নকে অনেকে জমকালো করে তুলতে চান ‘হাই-টি’-র আয়োজন করে। নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসে ‘হাই-টি’ এখন সারা বিশ্বের ধনী-মহলের মতো আমাদের উচ্চবিত্ত সমাজেও সাদর অভ্যর্থনা পাচ্ছে। বড়লোকেরা সাধারণত খান কম, দেখান বেশি। এখনকার ‘হাই-টি’ সেই সংস্কৃতিরই বাহক। 

মজার কথা, আদিতে ‘হাই-টি’ বিষয়টার শ্রেণিচরিত্র কিন্তু একেবারেই অন্যরকম ছিল। উনিশ শতকে ব্রিটেনের শ্রমিকেরা সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে চা সহযোগে কিছু খাবারদাবার খেতেন। খিদে বেশি পেত বলে হালকা স্ন্যাক্স নয়, খাদ্যতালিকায় থাকত মাংস-মাছ বা ডিমের মতো ভারী খাবার। সঙ্গে পাউরুটি, জ্যাম, মাখন এবং ডেজার্ট জাতীয় কিছু। তাঁরা উঁচু টেবিলে উঁচু চেয়ারে বসে খেতেন। এই উঁচু চেয়ারগুলো অনেকটা মদ্যশালার চেয়ারের মতো হত। এই উঁচু কমদামি চেয়ার-টেবিলই ‘হাই-টি’-র আদি ও অরিজিন্যাল স্থানাধিকরণ। বেশিরভাগ লোকজন মনে করেন, উঁচু টেবিলের সূত্রেই এই নামকরণ। তখনও এ জিনিস আলাদা করে ‘প্রথা’ হয়ে ওঠেনি। শৌখিনতা বা সামাজিকতা কোনোটারই লেশমাত্র ছিল না এতে। এই দুটো জিনিস যোগ হয় আরও পরে, এবং এই দুটোই হয়ে কালক্রমে হয়ে ওঠে ‘হাই-টি’-র অন্যতম অভিজ্ঞান।  


ইতিহাস বলছে, বিকেলে চায়ের সঙ্গে ‘ইভনিং স্ন্যাকস’-এর ধারণা একটা সামাজিকতার আকার পায় ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। সৌজন্যে ডাচেস অব বেডফোর্ড আনা মারিয়া রাসেল। লাঞ্চের সঙ্গে ডিনারের সময়ের অনেকটা ব্যবধান। তাতে বিকেলের দিকটা ডাচেসের বেশ খিদে খিদে পেয়ে যেত। তাই বিকেলের চায়ের সঙ্গে তিনি ছোটো করে একটা meal-এর কথা ভাবেন। নিজে কয়েকদিন এই রুটিন অনুসরণ করে তিনি বেশ মজা পান। অতঃপর নিজের বন্ধুবান্ধবকেও মাঝে মাঝেই আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন বৈকালিক চা-আড্ডায়। ব্রিটিশ অভিজাত সমাজে অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘আফটারনুন টি’। অভিজাত এই সামাজিক প্রথা ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করে নেয় শ্রমিক শ্রেণির ‘হাই-টি’র ধারণাকে। ‘হাই-টি’-র অর্থোন্নতি বা শ্রেণি-উত্তরণ ঘটে যায়। তারপর থেকে আবহমান সময় ধরে ‘হাই-টি’ আর ‘আফটারনুন টি’ উভয় শব্দবন্ধ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে বলা যায়, ‘হাই-টি’ হল কঠিন কঠোর গদ্য থেকে পদ্যের শৌখিন লালিত্য ঝংকারে পৌঁছে যাওয়া এক মজাদার ট্রাডিশন। ব্রিটেনের হাত ধরে অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশেও এই ‘হাই-টি’ অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বা সামাজিকতার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভারতেও এখন আস্তে আস্তে বাড়ছে এর প্রচলন। 

ভুল হতে পারে, তবে এ বিষয়ে আমার সীমিত পড়াশোনা ও পর্যবেক্ষণে, যে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ খালি পেটে শুতে যায়, সেখানেই ‘হাই-টি’ সম্ভবত সবচেয়ে জমকালো চেহারা পেয়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর ‘হাই-টি’-র প্রচলিত মেনুর সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের উঁচুতলার ‘হাই-টি’ অনুষ্ঠানের মেনুর তুলনা করলে খুব স্পষ্ট করে এ কথা চোখে পড়ে। পশ্চিমে এতরকম আয়োজন সাধারণত থাকে না। তাঁরা সম্ভবত প্রয়োজন বা অপচয় ব্যাপারগুলো ভালো বোঝেন। আধুনিক ভারতীয় ‘হাই-টি’-র মূল কথা হচ্ছে অফুরন্ত এবং এলাহি আয়োজন। চা থাকে বিভিন্নরকম। 'টা'-এর মেনু অ্যাপেটাইজারের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। তাতে আমিষের রকমারি পদ তো থাকেই। সঙ্গে দইবড়া, পাওভাজি, কেক (অন্তত ৫-৬ রকম), ইডলি, দোসা, পকোড়া, ধোকলা, পিৎজা, পাস্তা, নুডলস, স্যান্ডউইচ, আলু টিক্কা, পনীর টিক্কা, চিজবল, মশলা কর্ন, শিঙাড়া, মশলা পাঁপড়, ম্যাকারুন, কাস্টার্ড, জিলিপি, গাজরের হালুয়া, কাজু বরফি, নানখাটাই (ঘি, ময়দা দিয়ে তৈরি উত্তর ভারতীয় ‘কুকি’), ঘেবর (ঘিয়ের তৈরি রাজস্থানী মিষ্টিজাতীয় খাবার), ফল (৭-৮ রকম)– এগুলো মোটামুটি থাকবেই। এ ছাড়া আঞ্চলিক খাবারদাবার থাকে প্রভূত পরিমাণে। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্য লাগে সেটা হচ্ছে বিয়ের নেমন্তন্নে এই পাহাড়প্রমাণ ব্যাপারস্যাপারের পরেও মেন কোর্স থাকে। অবশ্য এই মারণ বুবি ট্র্যাপ পেরিয়ে মেন কোর্সের উপকূলে পৌঁছতে পারে, এমন সংযমী ও দুর্দম অভিযাত্রী কমই দেখেছি। আবার কখনও সুযোগ হলে আরও বিস্তারিত লিখব এ বিষয়ে। তবে একটা কথা চোখ বুজে বলা যায়, রসনার সঙ্গে এই সামাজিক প্রথার সম্পর্ক বেশ ক্ষীণ। বিদেশে এ হল সামাজিকতার এক সুন্দর ছুতো। আর ভারতীয় উপমহাদেশে এ মূলত স্ট্যাটাসের প্রদর্শনী। চরম বৈপরীত্যের এই দেশে ‘হাই-টি’ জাতীয় এত ভয়ানক বিলাসবহুল আয়োজন খুব প্রথাসিদ্ধ হয়ে যাবে, এমন ভাবতে ভালো লাগে না ঠিক। গত কয়েক বছর ধরেই গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে একশোরও নিচে ঘোরাফেরা করছে ভারতের স্থান। এরকম এক দেশের নাগরিক হয়ে এই ইতিহাস-সমৃদ্ধ প্রথাটিকে বিলাসের বাহুল্য থেকে মুক্ত হতে দেখতে চাই। ভারতীয় ‘হাই-টি’ বরং চা এবং খাবারের দিক থেকে যথেচ্ছ এক্সপেরিমেন্টাল হয়ে উঠুক। আয়োজন কম হোক। কমুক অপচয়। অহেতুক লোকদেখানোকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে তার জায়গা দখল করুক আন্তরিক আড্ডা।




ঋণ : 
১) High Tea / Jill Jones-Evans, Joe Gambacorta / New Holland Publishers/ 2016
২) High Tea: Gracious Cannabis Tea-Time Recipes for Every Occasion / Sandra Hinchliffe / Simon and Schuster / 2017 



পোস্টার : অর্পণ দাস




#বাংলা #নিবন্ধ #রসিয়ে কষিয়ে #হাই-টি #Bengali #Rosiye Kosiye #High-tea #পাস্তা #কার্ডামম টি #মশলা চা #লেমন চা #অরেঞ্জ চা #হোয়াইট চা #জিল ইভান্স #ব্রিটিশ ট্র্যাডিশন #উনিশ শতক #পাউরুটি #জ্যাম #মাখন #ডেজার্ট #ব্রিটেন #শ্রমিক #প্রথা #ইভনিং স্ন্যাক্স #আফটারনুন টি #দইবড়া #পাওভাজি #কেক #ইডলি ধোসা #পাকোড়া #ধোকলা #পিৎজা #নুডলস #স্যান্ড উইচ #আলু টিক্কা #পনীর টিক্কা #চিজবল #মশলা কর্ন #সিঙ্গাড়া #মশলা পাঁপর #ম্যাকারনি #জিলিপি #গাজরের হালুয়া #কাজু বরফি #নানখাটাই #ঘেবর #ফল #Pasta #Cardamom Tea #Masala chai #Orange tea #White tea #Bread #Butter #Jam #Cake #Pao bhaji #Pizza #Noodles #Sandwich #Alo tikka #Panter tikka #Cheese ball #Dessert #Fruits #Ghevar #Massala Papar #Nineteenth century #British tradition #Labour #Afternoon tea #Jill Jones-Evans #Joe Gambacorta

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

33

Unique Visitors

215807