ভ্রমণ

যে গ্রামে সবাই চিত্রকর

দীপ্তেন্দু কুমার কুণ্ডু Aug 4, 2020 at 4:33 am ভ্রমণ

ধর্ম মানে ওঁরা জানে শিল্প। ওঁদের কাছে ধর্ম মানে, কী করে একটা নিষ্প্রাণ কাগজের টুকরো রঙিন বাঙময় পটচিত্র হয় ওঠে কিংবা কী করে একটা একলা কাঁসার থালা তুলির ছোঁয়ায় জীবন ফিরে পায় আবার।

কথা বললে জানা যাবে, কারো আদি ধর্ম হিন্দু, কারো মুসলমান, কারো বা ক্রিস্টান। কিন্তু সেটা গুরুত্ব পায় না। ওরা সবাই চিত্রকর , ওদের আলাদা কোনো ধর্ম নেই। ওদের সবার পদবী 'চিত্রকর'। সাম্যবাদের আশ্চর্য এক সহজপাঠ তৈরি করে রেখেছে মূলস্রোত থেকে বহু দূরবর্তী এই জনপদ। এক- একটা পরিবারের একদম পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বয়স্ক মানুষ সবাই আঁকতে পারেন। সবার হাতেই রঙিন হয়ে ওঠে পটচিত্র। তুলি আর রঙের সঙ্গে যেন জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। গ্রামের নাম নয়াগ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা মহকুমার অন্তর্গত। কলকাতা থেকে সড়ক পথে ১৩০ কিলোমিটার। ভারতীয় রেলের দক্ষিণ- পূর্ব শাখার খড়্গপুর লাইনে বালিচক স্টেশনে নেমে ট্রেকারে বা বাসে বড়জোর আধ ঘণ্টা লাগবে পৌঁছাতে।


নয়াগ্রামে প্রায় ২৫৫ জন পট শিল্পী পরিবারের বাস। এঁরা পট আঁকার জন্য ব্যবহারও করেন সব প্রাকৃতিক রং। যেমন সেগুন পাতার রস থেকে তৈরি হয় সুন্দর বাদামি রং। আবার অপরাজিতা ফুল থেকে নীল রং, বা কাঁচা হলুদ বেটে তৈরি হয়ে যায় হলুদ রং। কিছু নাম না জানা ছোট ছোট লাল ফল থেকে তৈরি হয় লাল। আসলে পুরোনো দিনে শিল্পীরা বিবিধ পৌরাণিক ঘটনার বিবরণ কাগজের ওপর এঁকে, গান বেঁধে আসরে পরিবেশন করতো, সেই থেকেই এই পট শিল্পের সূচনা। এখন মাটির সরা, কাপড়, বাসনের ওপরেও পট আঁকা হয়। যুগের দাবি মেনে টি শার্টের ওপরেও আঁকা শুরু হয়েছে। বিষয়বস্তুও আর পৌরাণিক কাহিনির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সোশাল মিডিয়া থেকে পাবজি (PUBG)- সবই ঢুকে পড়ছে বিষয়ের তালিকায়।

প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষের দিকে গ্রামে কয়েকদিনের জন্য পটের মেলা হয়। বার্ষিক সেই মেলার নাম ‘পট - মায়া’। মেলার দিনগুলো গ্রামের প্রতিটি বাড়ি সেজে ওঠে পটের পসরা নিয়ে। দূরদূরান্ত থেকে অনেকে আসেন। কেনাবেচা হয় অনেক। গ্রামের অনেক শিল্পীই নিজের পটের পারদর্শিতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছেন। বাহাদুর চিত্রকরের মতো কেউ কেউ পৃথিবীর অনেক দেশে নিজের পটের প্রদর্শনী করার সুযোগ পেয়েছেন। এই গ্রামে কোন শিশুর একটু জ্ঞান হলেই নিয়মিত দেওয়া হয় আঁকার ক্লাস। সারা গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির দেওয়ালে কত রঙ্গিন আঁকা।অনেক সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ঘরের বাইরের দেওয়াল ফুটিয়ে তোলে অনায়াসে। তেমনিই ওদের ঘর সাজানোর জন্য বিশাল কিছু কিনতে যেতে হয় না, নিজের হাত, তুলি, রংই যথেষ্ট। নয়াগ্রামের ঝুলিতে আছে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমাও।


এরকম দ্রুত- পরিবর্তনশীল সময়ে আমাদের সুপ্রাচীন এক ঐতিহ্যকে আগলে পড়ে আছে পিংলার নয়াগ্রাম। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের খুব কাছেই আছে এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষের পরিচয় শুধুই তাদের কাজ, তাদের সৃষ্টি। একজন শিশুকে একটা পৃথিবী চেনানো হয় রং তুলি আর নতুন ভাবনার মধ্যে দিয়ে। শিল্পই ওঁদের ধারণ করে আছে, তাই ওটাই ওঁদের ধর্ম।। ওঁদের গ্রামে মন্দির আছে, মসজিদ আছে -পুজো আছে, নামাজ আছে তবু তারা চিত্রকর। যাকেই জিজ্ঞেস করবেন, সবার একটাই উত্তর - “আমরা সবাই চিত্রকর।” ধর্ম আছে ব্যক্তিগত জীবনাচরণের জায়গায়, ধর্মকে আফিম হয়ে উঠতে দেয়নি নয়াগ্রাম। যে পৃথিবীতে ধর্মের নামে অনায়াসে ধড় থেকে নেমে আসে একটা আস্ত মাথা, খুবলে নেওয়া হয় চোখ, কবর থেকে ভিন্নধর্মের লাশ তুলে এনে গণধর্ষণের পরিকল্পনা করা হয়, সেখানে নয়াগ্রাম অন্যতর এক জীবনের সুর শোনায়।





[সমস্ত ছবির কপিরাইট লেখকের।]

#ভ্রমণ #নয়াগ্রাম #পিংলা #চিত্রকর

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

76

Unique Visitors

182091