ফিল্ম রিভিউ : 'কাঁঠাল - আ জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি'
সিনেমা : কাঁঠাল – অ্যা জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রিভাষা : হিন্দিপরিচালক : যশোবর্ধন মিশ্রঅভিনয় : সান্যা মলহোত্র, অনন্ত যোশী, বিজয় রাজ, রাজপাল যাদব, রঘুবীর যাদব, নেহা শ্রফ, গুরুপাল সিং প্রমুখ।মাধ্যম : নেটফ্লিক্স
‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর কমলাকান্ত-রূপী বঙ্কিমচন্দ্র বহুকাল পূর্বে তাঁর ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “আমাদের দেশের এক্ষণকার বড়মানুষদিগের মনুষ্যজাতিমধ্যে কাঁটাল বলিয়া বোধ হয়। কতকগুলি খাসা খাজা কাঁটাল, কতকগুলি বড় আটা, কতকগুলি কেবল ভুতুড়িসার, গরুর খাদ্য। কতকগুলি ইঁচোড়ে পাকে, কতকগুলি কেবল ইঁচোড়েই থাকে, কখন পাকে না।... যদি পাকিল ত বড় শৃগালের দৌরাত্ম্য।... আবার এদিকে কাঁটাল ঘরে রাখাও ভাল না – পচিয়া দুর্গন্ধ হইয়া উঠে।” গ্রীষ্মকালীন ফল হিসেবে আমের বিশেষ কদর থাকলেও কাঁঠাল কোনওকালেই খুব আদৃত নয়। অকর্মণ্য, সারহীন, মোসাহেব পরিবেষ্টিত ধনীব্যক্তিদের রূপকায়িত করতে বঙ্কিম তাই মাছি পরিবৃত কাঁঠাল ফলকেই তাঁর স্যাটায়ারের উপকরণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ২০২৩-এর ১৯ মে মুক্তিপ্রাপ্ত নেটফ্লিক্সের ‘কাঁঠাল – অ্যা জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’ সিনেমাটি আবার যেন বঙ্কিমের কথাগুলোকেই কিছুটা মনে করিয়ে দিল। ‘কাঁঠাল’ নামকরণেই পরিচালক দর্শককে প্রথম চমকটি দিয়েছেন। এক ঘণ্টা পঞ্চান্ন মিনিটের এই সিনেমার প্রেক্ষাপট মোবা নামের একটি ছোট শহরের এমএলএ মুন্নালাল প্যটেলের (বিজয় রাজ অভিনীত) বাগান থেকে বিশেষ প্রজাতির দুটি কাঁঠাল চুরিকে কেন্দ্র করে। হাইপ্রোফাইল এই কেসের (!) তদন্তভার দেওয়া হয় স্থানীয় থানার মহিলা ইন্সপেক্টর মহিমা বাসর (সান্যা মলহোত্র)-কে। সিনেমার শুরুতেই স্ক্রিনে যাঁর আবির্ভাব কুখ্যাত দুষ্কৃতি বীর সিং ওরফে বীরুকে (একলব্য তোমর অভিনীত) ছদ্মবেশে বেশ ধূর্ততার সঙ্গে ধরার মধ্য দিয়ে। যদিও ঘটনার পুরো কৃতিত্ব যায় পুরুষ এসপি সাহেবের (গুরুপাল সিং অভিনীত) কাছে, যিনি কিনা ধৃত আসামীর ধর্ষণ, খুনের ঠিক সংখ্যার হিসেব দিতেই হিমসিম খেয়ে যান! শুরুতেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও অ্যাকশনের অ্যাঙ্গেল পুরো বিষয়টিকে কমিক্যাল তুলেছে। কাঁঠাল পাকার আগেই তাকে উদ্ধার করার প্রকল্পে শুরু হয় অভিযান। সন্দেহ ঘনীভূত হয় মুন্নালাল প্যটেলের বাড়ির সদ্য বরখাস্ত মালির উপর। ঘটনাচক্রে জানা যায়, এই মালির মেয়ে অমিয়া (অপূর্বা চতুর্বেদী) ইতিমধ্যে নিখোঁজ। অথচ পনেরো কেজির দুটি কাঁঠাল খোঁজার তদন্তে ব্যতিব্যস্ত পুলিশ-প্রশাসন সে সম্পর্কে উদাসীন। উল্টে প্রশাসনের উপর চাপ কমাতে প্রেস কনফারেন্স করে মেয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ায় পুলিশের সাহায্য চাইতে আসা মালির উপরেই পুরো ঘটনার দায় দেওয়ার চেষ্টা করে। গরীব অসহায় মানুষের উপর সমাজ-রাজনীতির বিশেষ করে উচ্চশ্রেণির আধিপত্যকামী মানসিকতারই প্রতিফলন দেখিয়েছেন পরিচালক। কিন্তু প্রোটাগোনিস্ট চরিত্র সমাজের নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা ইন্সপেক্টর বাসর (যিনি আবার তাঁর উচ্চবর্ণের সহকর্মী কনস্টেবল সৌরভ দ্বিবেদীর সঙ্গে প্রণয় সম্বন্ধে জড়িত) এহেন অসাম্যকে মেনে নিতে পারেন না। ফলে প্রশাসনের চোখে ঠুলি পরিয়ে কাঁঠাল খোঁজার অছিলায় শুরু হয় নিরুদ্দেশ অমিয়া-অন্বেষণের অভিযান। দেখা যায়, অতীতে এরকম বহু মেয়ে নিখোঁজই থেকে গেছে, প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কোনও তরফ থেকেই তাকে নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য হয়নি। নেহাতই সাবস্ক্রাইবার পাওয়ার আশায় স্থানীয় নিউজ রিপোর্টার অনুজ সাংভি (রাজপাল যাদব) এই পুরো ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করে এবং আরও বেশি প্রচার পাওয়ার উচ্ছ্বাসে সানন্দে গ্রেপ্তার হয়। অবশেষে মিষ্টির ব্যবসার আড়ালে চলা নারী-পাচারকারী গুলাব শেঠ (রঘুবীর যাদব) ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের (যাঁরা আবার লকডাউনের ফলে নানা সমস্যায় ভুক্তভোগী ও এসব কাজের অংশীদার) হাত থেকে অমিয়া উদ্ধার হয়। মধুর সমাপ্তি ঘটে। কনস্টেবল প্রমোশন পান। উপদ্রব কিছুটা বাড়াতে রসিকতা বজায় রাখতেই তাঁর প্রেমিকা ইন্সপেক্টর বাসর হয়ে যান ডিএসপি। অন্যদিকে, সেই রহস্যময় কাঁঠালের রহস্য উন্মোচিত হয়। দেখা যায়, এমএলএ-এর বাড়ির ছাদে তা নিশ্চিন্তে ভক্ষণ করতে থাকে বাঁদরের দল!
বস্তুত, পুরো সিনেমা জুড়ে কাঁঠাল উদ্ধারকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্যকার ভারতে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, জাতিভেদ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, ক্ষমতাবানের মনোপলি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক মনোভঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। পুরোপুরি ব্ল্যাক কমেডি বলা না গেলেও নিঃসন্দেহে এটি একটি স্যাটায়ারধর্মী কমেডি সিনেমা। কুন্তী প্রতিহার চরিত্রটি যেমন একদিকে ভারতীয় কর্মরত মহিলাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতার কথা বলে, তেমনই কন্সটেবল মিশ্র কিংবা এসপি সাহেবের চরিত্রগুলি সমাজমানসে নিহিত পুরুষতন্ত্রকেই তুলে ধরে। ছেঁড়া জিন্স পরা মেয়ে অপহরণযোগ্য কিংবা পুলিশ ভয়ংকর একটি জীব ভারতের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহরগুলিতে এই মানসিকতা আজও বাস্তব এক চিত্র। সান্যা মলহোত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সিরিয়াস এবং কমিক দুটো সমান্তরাল শেডকে তাঁর চরিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজপাল যাদব অনবদ্য। বিশেষত আজকের দিনের সাংবাদিকতার প্রতি প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ আছে তাঁর চরিত্রে। যেখানে শুধুমাত্র সস্তার উপকরণ সহযোগে ভাইরাল হওয়ার উপকরণ খোঁজা হয়, সাবস্ক্রাইবার পাওয়াই যার মূল লক্ষ্য। সাংবাদিকের কণ্ঠরোধের মতো অত্যন্ত বাস্তবদিকটিও তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, পোশাকশিল্পী অভিলাষা শর্মার কথা। অনুজ সাংভির সহকারীর চরিত্রটিতে তিনি যেভাবে ‘GOOCHE’, ‘NAiK’ ‘abidas’-লেখা টি-শার্টগুলি ব্যবহার করেছেন তা কমিক আবহের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবতাকেও উন্মোচন করে দেয়। অঙ্গসজ্জা যথেষ্ট লাউড। যদিও তাকে কমিক্যাল পরিস্থিতিকে বজায় রাখার জন্য বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। এরকম বহু উল্লেখ সিনেমায় প্রযুক্ত স্যাটায়ারকে বাস্তবোচিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ছবিতে ব্যবহৃত তিনটি গানের মধ্যে ‘রাধে রাধে’ ছবির মেজাজের পরিপূরক বলা যায়। তবে এত বেশি বিষয়কে একসঙ্গে প্রকাশ করতে গিয়ে সিনেমার সামগ্রিক সামঞ্জস্য কোথাও বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে। সুচারুরূপে দৃশ্যায়ন তো হয়ইনি, বরং শেষাংশের অ্যাকশন দৃশ্যের মতো বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। তবে জোরের জায়গা হল এর সংলাপ। কিছু ক্ষেত্রে তা বেশ সংহত।
‘Making fun is serious a business’ - চ্যাপলিনের এই কথাটিকে মাথায় রেখেই জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী চিত্রনাট্যকার অশোক মিশ্রকে কুর্নিশ জানাতে হয়। কারণ, তিনি একাধারে চিত্রনাট্য ও গীতি রচনার মধ্য দিয়ে সেই কঠিন কাজকে বাস্তবায়িত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সিনেমার পরিচালক হিসেবে তাঁর পুত্র যশোবর্ধন মিশ্রের এই প্রথম কাজটি, ‘কাঁঠাল – অ্যা জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’ যথেষ্ট প্রশংসার্হ।
.................................
#Kathal - A Jackfruit Mystery #film review #Yashowardhan Mishra #Netflix #Sanya Malhotra #silly পয়েন্ট