ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

দ্য টিউরিন হর্স : অতিমারির পাঠ

রোহণ দত্ত July 23, 2020 at 8:52 pm ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

পরিচালক : বেলা তার
কাহিনী : লাজলো ক্রাজনাহরকাই
সঙ্গীত : মিহালি ভিগ
চিত্রগ্রহণ : ফ্রেড কেলেমেন

এ এক অদ্ভুত পৃথিবী। চিরঝঞ্ঝার দেশ। ঝোড়ো হাওয়ার নিস্বান, ঝিঝির অবিশ্রান্ত কূজনের মত কানে বেজে চলেছে সমস্ত দিন। রাস্তার ধারের গাছগুলোর ডাল রিক্ত। ধূসর কুয়াশার এক বিচিত্র মৌতাত আচ্ছন্ন করে রেখেছে পথপ্রান্তর। শ্লথ গতিতে একটি জীর্ণ ঘোড়া একজন বৃদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দিগন্তবিস্তারী ধূসর আবরণ শরীরে জড়িয়ে পৃথিবী যেন সমস্ত কিছুর অপেক্ষা ত্যাগ করেছে। এ যেন এমন এক পৃথিবী যেখানে সাযুজ্যের সব যতিচিহ্নগুলি কেউ ধরে ধরে মুছে দিয়েছে। পর্দায় চলছে বেলা তারের শেষ ছবি ‘দ্য টিউরিন হর্স’।

একটা ছোট্ট ঘর। সঙ্গে একটা আস্তাবল। বাসিন্দা দুই জন - অহ্লসডরফার (ইয়ানস দ্যরজি) এবং তার মেয়ে (এরিখা বখ্)। তাদের যাপন বাঁধা রয়েছে কিছু মাপা অভ্যাস দিয়ে। অহ্লসডরফারের শরীরের ডানদিকটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। প্রতিদিন বাবার পোশাক বদলাতে সাহায্য করে তার মেয়ে। বাড়ি থেকে একটু দূরে থাকা পাতকুয়ো থেকে জল নিয়ে আসাও তার দায়িত্ব। তারা দিনে দুবার খায়, দুবারই আহারে থাকে একটি করে আলুসিদ্ধ। শব্দের মিতব্যয়িতা তাদের অভ্যাস। বাঁচার তাগিদের পরিবর্তে বাঁচার অভ্যাসের তাড়নায় তারা দিনযাপন করে। প্রত্যেক দিন, বাবা এবং মেয়ে নিয়ম করে জানলার ধারে বসে, মূক দর্শকের ন্যায় বাইরে তাকিয়ে থাকে। আবার মেয়েটি নিয়মিত নুন খায় না, অহ্লসডরফার খাবার খেতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে। রোজকার আপাত বাস্তবের অগোচরে যে অন্য বাস্তব লুকিয়ে থাকে তারই গন্ধ পাওয়া যায় এই ছবিতে।

ছয় দিন ধরে থরে-বিথরে সাজানো এক ক্রমিক অবিন্যাসের গল্প ‘টিউরিন হর্স’। সোয়েটারের উলের একপ্রান্ত ধরে এক ঝটকায় টেনে খুলে ফেলার মত করে পরিচালক সমস্ত জগত-সংসারের বুনন খুলে ফেলেন। যে নিত্‌শের শেষ জীবনের ঘটনাক্রম দিয়ে সিনেমা শুরু হয়, সেই নিত্‌শের দর্শনের অনুষঙ্গ ধরেই ছবিতে ছায়া মেলে খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা। জেনেসিসের গল্প অনুযায়ী ঈশ্বর ছয় দিন ধরে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন, আর বেলা সেই গল্পকে উল্টে দিয়ে আরেক খেলায় মাতলেন। এ যেন এক না-সৃষ্টির গল্প। একটা আঁকা ছবির দাগগুলো মুছে দিতে দিতে, সেই প্রাক্তন সাদা পাতার দিকে যাত্রা।

বাবা-মেয়ের জীবনে সংকটের সংকেত পাওয়া যায় দ্বিতীয় দিন থেকেই। একটু একটু করে তাদের অভ্যস্ত যাপনে বাধা পড়তে থাকে। সেইদিন অহ্লসডরফারের ঘোড়াটি অচল হয়ে পড়ে; শহরে আর কাজে যাওয়া হয় না। তৃতীয় দিন ঘোড়াটি খাওয়া বন্ধ করে দেয়। চতুর্থ দিনে শেষ হয়ে যায় কুয়োর জল। পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফিরে আসতেই হয় বাবা-মেয়েকে। তারা আলু পুড়িয়ে খেতে আরম্ভ করে। পঞ্চম দিনে আঁধার নেমে আসে, কিছুতেই আগুন জ্বলতে চায় না। কাঁচা আলু খাওয়ার চেষ্টা করে অহ্লসডরফার, তাঁর মূক তনয়া থালার দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পর্দা জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। সিনেমা শেষ হয়।

বাবা-মেয়ের যাপনের সঙ্গে বহির্বিশ্বের অভিঘাত আমরা সর্বসাকুল্যে দু’বার দেখি। প্রথমবার, এক প্রতিবেশী (মিহায করমস) আসেন তাদের কাছে পালিঙ্কার খোঁজে। কথা দিয়ে, শব্দ দিয়ে তীব্র এক বিপর্যয়ের ছবি আঁকেন এই প্রতিবেশী। তার কথা থেকে আমরা জানতে পারি এক বিধ্বংসী হাওয়ায় পাশের শহরটা উড়ে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ যাই স্পর্শ করেছে তাতেই পচন ধরেছে। “...because everything has been debased that they've acquired, and, since they've acquired everything in a sneaky, underhanded fight, they've debased everything. Because whatever they touch, and they touch everything, they've debased”. এই আপাত প্রলাপের নেপথ্যে আছে ইতিহাসের ব্যথা আর আগামীর হতাশা। ভগ্নাবশেষের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে মানব সভ্যতা। যূথবদ্ধভাবে আমরা যাই ছুঁয়ে দেখেছি, তাতেই পচন ধরেছে। ঈশ্বর মারা গিয়েছেন। আমরা তাঁকে মেরে ফেলেছি। ধর্মের ঈশ্বর, বিজ্ঞানের ঈশ্বর, যুক্তির ঈশ্বর, প্রযুক্তির ঈশ্বর – সবার শবদেহ আগলে আমরা বসে আছি। নেক্রোম্যানিয়াক বিবমিষার ঘোরে চাবি দেওয়া পুতুলের মত বেঁচে আছে বাবা আর মেয়ে। অহ্লসডরফার প্রলাপ বলে প্রত্যাখান করেছেন সেই প্রতিবেশীর কথা। দ্বিতীয়বার বহির্বিশ্বের যে আভাস আসে তা তৃতীয় দিনে। কিছু রোমানি সম্প্রদায়য়ের মানুষের প্রতি অহ্লসডরফারের ব্যবহারে ধরা পরে দ্ব্যর্থহীন সাম্প্রদায়িকতা।

চতুর্থ দিনে, জল শেষ হয়ে যাওয়া এবং স্পষ্ট হয়ে ওঠা আণবিক যুদ্ধের আভাসে ভাবতে ইচ্ছে করে, এই জগত সংসারের অন্তঃসার অন্বেষণে পরিবেশের ভূমিকা কোথায়? প্রত্যেক দিন একটু একটু করে বদল ঘটছে আর তার সঙ্গে প্রাণপণে খাপ খাইয়ে নিতে চাইছে বাবা-মেয়ে। অনেকটা সেই ফুটন্ত জলের ব্যাঙটার মত। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙটিও নিজের দেহের তাপমাত্রা বাড়াতে-কমাতে থাকে। ব্যাঙটির পরিণতি বিশ্বসমাজের যে কয়েকটি কৌমবিস্মৃতি আছে, তার মধ্যে অন্যতম।


জীবনের মর্মার্থ, মনুষ্যজন্মের অর্থ এবং অভিপ্রায় চেতনায় ধরবার চেষ্টা সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই হয়ে এসেছে। ইতিহাসের প্রত্যেকটি অধ্যায়, দর্শনের বিভিন্ন শাখা, নিজের মত করে ব্যখ্যা করেছে এই প্রহেলিকা। তবে তাদের সবার মধ্যে একটি মিল আছে; যতই পরস্পরবিরোধিতা থাকুক না কেন, সবকটিই ভীষণভাবে মানবকেন্দ্রিক। ধর্ম মানুষকে ঈশ্বরের সৃষ্টি বলেছে। জীবনের যাবতীয় মর্মার্থের দায় একমাত্র ঈশ্বরের। ঈশ্বরই জীবনের চূড়ান্ত অর্থ এবং উদ্দেশ্য। এবার কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে এই ধর্মের ঈশ্বর (ধরা যাক খ্রিস্টধর্ম) মানুষকে তাঁর নিজের আদলে তৈরি করেছেন। অর্থাৎ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে যে ঈশ্বরের কল্পনা করেছে অথবা জন্ম দিয়েছে তার রূপ অবিকল মানুষের নিজের মতই। আমাদের ঈশ্বররা আমাদের মতই দেখতে, এ কথা বলার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম আত্মম্ভরিতা রয়েছে। ঈশ্বরের জগতেও মুখ্য চরিত্রে সেই মানুষ। ধর্মের অন্ধকার দূর করে যে মানবতাবাদী রেনেসাঁ এল তাতে আমরা দেখলাম ডেভিডের সুঠাম মাংসপেশি। যুক্তির নবজাগরণে উদযাপিত হল সেই মানুষ। প্লেটোনিক সারসত্তাবাদ থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণাকারী একবিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদী, মার্ক্সবাদী দর্শনও ভীষণ ভাবে মানবকেন্দ্রিক। মানববীক্ষার এই অস্মিতা অর্থের অন্বেষণে কতটা অনর্থ ঘটিয়েছে, তার হিসেব কোন মহাফেজখানায় পাওয়া যাবে না। অতিমারির দিনে, টিউরিন হর্সের মত ছবি, অস্তিত্বের অর্থসংকটের মত আধিবিদ্যক সমস্যার (metaphysical problems) সঙ্গে অস্তিত্বের সংকটের মত কায়িক সমস্যা (physical problems) মিশিয়ে, নতুন করে দেখা খুবই জরুরি।

#ফিল্ম রিভিউ #দ্য টিঊরিন হর্স #রোহন দত্ত #বেলা তার #অতিমারি

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

55

Unique Visitors

181970