ডার্লিংস : 'ভালোবাসা'-র পাশেই যেসব অসুখ শুয়ে থাকে
![](https://firebasestorage.googleapis.com/v0/b/sillypoint-3.appspot.com/o/images%2Fthumbs%2FTOjSe1662804750722darlings_1366x1366.jpeg?alt=media)
................
ছবি : ডার্লিংস
চিত্রনাট্য : পারভেজ শেখ, জসমিত কে. রিনস
পরিচালক : জসমিত কে. রিনস
অভিনয় : আলিয়া ভট্ট, বিজয় বর্মা, শেফালি শাহ, রোশন ম্যাথু প্রমুখ
সংগীত : বিশাল ভরদ্বাজ, প্রশান্ত পিল্লাই
প্রযোজনা : রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট
পরিবেশক : নেটফ্লিক্স
...........
"হেই ডার্লিংস,
ইউ ম্যাড ইউ
আই লাভস ইউ..."।
তাপসী পন্নুর 'থাপ্পড়'-এর পর ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স (IPV) নিয়ে আরও একটি ছবি। বলিউড যে এই নিয়ে ভাবছে, রেড চিলিজ-এর মতো প্রযোজনা সংস্থা এরকম প্রজেক্টের জন্য এগিয়ে আসছে - ভেবেই ভালো লাগে।
'ডার্লিংস' ব্ল্যাক কমেডি। লঘু চালে বিষয়টা নিয়ে খেলেছে, কিন্তু বিষয়টাকে লঘু করেনি মোটেই। পরিচালক জসমিত রিনসের প্রথম কাজ। প্রথম কাজই গ্যালারির বাইরে। বিষাক্ত দাম্পত্য নিয়ে অসম্ভব সুচিন্তিত একটি বয়ান নির্মাণ করেছেন তিনি। ফিল্ম হিসেবে 'ডার্লিংস' যে সর্বাঙ্গসুন্দর এমন বলা যায় না, কিন্তু বয়ান হিসেবে নিখুঁত। আইপিভি-র বিষবৃত্তটিকে চিত্রনাট্যকার ভীষণ যত্ন নিয়ে, সকলের বোঝার মতো করে বুনেছেন। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসের ভাষা ধার করে বলা চলে 'কুন্দে যেন নিরমাণ'। এই কারণেই এ ছবির ম্যানিফেস্টো হয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। পরিচালক সে ফাঁদ এড়িয়ে গেছেন ছোট ছোট কমিক মুহূর্ত আর সাবপ্লট তৈরি করে। ভায়োলেন্সের জবাব পাল্টা ভায়োলেন্সই হতে হবে কিনা এ তর্ক তোলা যেতেই পারে। কিন্তু ডার্লিংস খুব সরাসরি একটা পক্ষ নিয়েছে। এই দ্ব্যর্থহীনতাই দর্শক হিসেবে আমার ভালোলেগেছে। এ ছবি তাত্ত্বিক কচকচি নিয়ে এসে ঘেঁটে দেয়নি দর্শককে। কিন্তু তত্ত্ব মিলিয়ে দেখতে চাইলে কোনো ফুটোফাটা পাওয়া যাবে না। কাহিনি আগাগোড়া সহজ-সরল, অথচ জ্যা-মুক্ত হয়েই তীব্র গতিতে একেবারে চাঁদমারির মাঝখানে গিয়ে বিঁধে সশব্দে পায়রা উড়িয়ে দেয়। আইপিভি-র ধাপগুলোকে চিত্রনাট্যে পরপর সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথমে Tension Building, তারপর Violent Episode, সবশেষে Honeymoon Phase। এই তিন নম্বর ধাপে এসে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা চলে নির্যাতিতকে। এই তিন নম্বর ধাপটিই নির্যাতিতকে আটকে রাখে সম্পর্কে। সে কিছুতেই মন শক্ত করে উঠতে পারে না। থানায় হামজার নামে নালিশ করতে গিয়েও বদ্রু নালিশ প্রত্যাহার করে ফিরে আসে এই কারণেই। দ্বিধা বা দ্বিধা ভেঙে বেরোনো - সবেতেই আলিয়া অনন্য। এই প্রজন্মের ভারতীয় নায়িকাদের মধ্যে আলিয়ার মতো শক্তিশালী অভিনেত্রী আর নেই। হামজার চরিত্রে বিজয় বর্মা সেরা সময়ের কে. কে. মেননকে মনে করান বারবার, যদিও চোখের ব্যবহার বিজয় আরও বেশি করেন। হামজা আমাদের মনে করায়, সঙ্গী-নির্যাতনের ক্ষেত্রে নির্যাতকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একেবারে ঠাণ্ডা মাথার, কৌশলী মানুষ হন। দর্শক খেয়াল করবেন, হামজার একটি আচরণও আচমকা রাগের মাথায় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে করা নয়। নিত্যনতুন ছুতো খুঁজে নিয়ে নিত্যনতুন উপায়ে প্রতিদিন সে ধ্বস্ত করে বদ্রুকে। পরের দিন সকালেই আবার 'সরি' বলে, উপহার এনে দেয় বউকে। নির্যাতকরা তা-ই করেন। মনোবিদ্যার পরিভাষায় একে বলে 'Push and Pull Tactics'। আসলে এই মনোবৃত্তির মানুষজন নিজেদের হীনমন্যতা বা আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ঢাকতে ছড়ি ঘোরাতে চান গৃহপরিসরের আপাত-নিরাপদ আবহে - সঙ্গীর নিঃশর্ত বশ্যতা চান। ম্যানিপুলেশন বা গ্যাসলাইটিং-এর প্রয়োগ হামজার মধ্যে দিয়ে যেভাবে দেখানো হয়, মাঝে মাঝে মনে হয় স্টোরিটেলিং-এর অছিলায় আসলে মানবীবিদ্যার ক্লাসই করিয়ে নিচ্ছেন পরিচালক। দারুণ সব ছোটো ছোটো প্রতীকী রেফারেন্স দিতে দিতে কাহিনি এগোয়। বদ্রুর মায়ের ভূমিকায় শেফালি শাহের অভিনয় দুর্দান্ত। বিশেষত, তাঁর চোখ ভোলা যায় না। সুখের কথা, ইন্ডাস্ট্রি গত কয়েক বছরে তাঁর চোখের ম্যাজিককে চিহ্নিত করেছে, পরপর অনেক ফিল্ম বা ওয়েব সিরিজে ব্যবহারও করছে পুরোদমে। মুগ্ধ করে এ ছবির সংগীত। গুলজার সাহেবের কলম আর বিশাল ভরদ্বাজের সুরে ছবির টাইটেল ট্র্যাকটি বিষাক্ত সম্পর্কের টানাপোড়েনকে অকল্পনীয় সততায় জড়িয়ে রেখেছে নিজের শরীরে।
সবচেয়ে জরুরি যে তিনটে কথা 'ডার্লিংস' আমাদের মনে করায় সেগুলো একটু আলাদা করে বলে নিই। অনেকেই জানেন। তবু। এই কথাগুলো বারবার মনে করা, মনে করানো জরুরি।
১) IPV গৃহহিংসার সবচেয়ে জটিল, সবচেয়ে দুরতিক্রম্য দিক। আইপিভি একটি বিষবৃত্ত। এই ধরনের সম্পর্কে আদর আর অত্যাচার চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসবে। নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার থাকে না বলেই মেয়েরা চট করে এই ধরনের সম্পর্ক থেকে বেরোতে পারে না। আরও একবার, আরও একবার সুযোগ দিতে চায়। ফলে লাভের মধ্যে কালশিটের দাগই বাড়তে থাকে।
২) নির্যাতক সঙ্গীটি কোনোদিনই আমূল বদলে যায় না। সাবধানী হতে পারে বড়জোর। কিংবা আরও সুকৌশলী হতে পারে, স্ট্র্যাটেজি বদল করতে পারে। কিন্তু বিছে বিছেই থাকবে। কারণ সঙ্গীর প্রতি তার সম্মান নেই। আছে শুধু যে-কোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণ করার, আধিপত্য কায়েম রাখার চেষ্টা।
৩) মদ দুর্ব্যবহারের অ্যালিবাই হতে পারে না। যার ভিতরে ভায়োলেন্স নেই, মদ তার ভিতর থেকে ভায়োলেন্স বের করে আনতে পারে না। মদ ভায়োলেন্সের জননী নয়। ভিডিওয় হামজার স্বীকারোক্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ - "আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সমস্যা মদেই। কিন্তু আমাদের সন্তানকে যেদিন আমি মেরে ফেললাম সেদিন তো আমি মদ খাইনি। তার মানে সমস্যা মদে নয়, সমস্যা আমার মধ্যেই।" মজার ব্যাপার হচ্ছে, সমস্যা নিজের মধ্যে জেনেও হামজারা বদলাবে না। তার প্রমাণও রয়েছে হামজার শেষ কথাবার্তায়। মদের দোহাই দিয়ে গৃহহিংসাকে লঘু করার একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আমাদের সমাজে প্রচলিত। আসল সমস্যাকে আড়াল করা এই প্রবণতাটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিন। আসল সমস্যাকে চিহ্নিত করুন। হাই প্রেশারে সর্দিকাশির ওষুধ খেয়ে লাভ নেই। যেখানে রোগ, ঠিক সেখানেই চিকিৎসা হোক।
'ডার্লিংস' শুধুমাত্র বক্তব্যের জোরেই সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলির একটি। এ ছবি লোকজনকে ধরে ধরে দেখানো উচিত। কারণ আমাদের উপমহাদেশে প্রতি তিনটে ঘরে একটা করে হামজার দেখা মিলবে। আপনার সঙ্গীটি কি নির্যাতক? আপনি কি আইপিভি-র চাক্কাজ্যামে আটকে আছেন? 'ডার্লিংস' তাহলে আপনার জন্য 'ছাত্রবন্ধু'-র কাজ করবে। উল্টে দেখুন, পাল্টে যেতে পারেন কিনা।
...............