বইয়ের খবর

টোকোলোশ - রনাল্ড সেগাল

মন্দিরা চৌধুরী July 21, 2020 at 9:59 am বইয়ের খবর

আমাদের ব্যবহৃত কপি -
অনুবাদক - সুবীর রায়চৌধুরী
প্রকাশক - দে’জ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ, আশ্বিন ১৪১৩, সেপ্টেম্বর ২০০৬।
প্রচ্ছদ - বিজন ভট্টাচার্য

'বর্ণবিদ্বেষ'- শব্দটার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ইতিহাস শতাধিক বর্ষব্যপী। মেলানিন, একটা আণুবীক্ষণিক রঞ্জক পদার্থ, তারই তারতম্য মানবসভ্যতাকে উপহার দিয়েছে তার ঘৃণ্যতম অভিশাপগুলির একটি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু কিছু সাহিত্য বা শিল্পকর্মও আমরা পেয়েছি এই কুৎসিত অভিশাপের প্রতিক্রিয়ায়। বর্ণবিদ্বেষের কুখ্যাত অভয়ারণ্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই শুধু আলান প্যাটোনের ক্রাই দি বিলাভেড কান্ট্রি (১৯৪৮), নাদিন গরডিমারের দি লাইং ডেজ (১৯৫৩), অকেশন ফর লাভিং (১৯৬৩), অ্যালেক্স লা গুমার ইন দ্য ফগ অব দ্য সিজন্স এন্ড (১৯৭২) ইত্যাদির মতো একের পর এক অসামান্য বর্ণবিদ্বেষ- বিরোধী উপন্যাস পেয়েছি আমরা। রনাল্ড সেগালের টোকোলোশ উপন্যাসিকাটি এই ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

দক্ষিণ আফ্রিকার এক ইহুদি পরিবারের সন্তান রনাল্ড সেগাল ছিলেন প্রখর রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন একজন বুদ্ধিজীবী ও লেখক। ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে তিনি ছিলেন সে দেশের জাতিবিদ্বেষ - বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘আফ্রিকা সাউথ’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তাঁর 'টোকোলোশ' উপন্যাসিকা প্রকাশিত হওয়ার পর সাদা চামড়ার লোকেদের প্রচন্ড রোষে পড়তে হয়েছিল তাঁকে; এমনকী গ্রেপ্তারি এড়াতে বাধ্য হয়ে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। সেগালের অপরাধ ছিল, তিনি এই গল্পে কালোদের প্রতি সাদাদের অধীনতাকামী মনোবৃত্তি, তাদের ফাঁপা পরনির্ভর জীবনযাত্রা বড্ড বেআব্রু করে দেখিয়েছিলেন।

সাদা চামড়াদের বাস শহরে, কালোদের তৈরি করা হর্ম্যে নিজেদের অভ্যাস, বিলাস তৈরি করে নিয়েছে তারা; আর কালোরা অভ্যস্ত শহরতলির পলকা কুঁড়েঘরে। শোষক-শোষিতের চিরকালীন চেনা ছকই দেখা যায় এই সমাজে। সাদাদের মহিমময় রাষ্ট্রযন্ত্রের জ্বালানি জোগায় কালোরা, কিন্তু দিনের শেষে তারা থেকে যায় শহরতলির অন্ধকার কোণে। তবে সাদারা অবচেতনে বোঝে যে- কালোরা যদি তাদের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়, তাহলে আর তাদের নিস্তার নেই, তাদের জীবন কার্যত অচল হয়ে পড়বে। শহর আর শহরতলির মাঝের কয়েক মাইলের ব্যবধান তাই যতটা অবস্থানগত পার্থক্যের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি সাদাদের আগাম নিরাপত্তার খাতিরে।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই কালো মানুষদের হতাশার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসে টোকোলোশ। টোকোলোশকে দেখতে তারাই পায় যারা তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। যেমন পিটারের মা দেখেছিলেন তাঁর গর্ভযন্ত্রণার রাতে, পিটার দেখেছিলো তার তেরো বছরের জন্মদিনে। টোকোলোশ আসলে কালো মানুষদের ভিতরের লুকিয়ে থাকা আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস, যার কথা তারা নিজেরাই ভুলতে বসেছে। যারা সেই লুকোনো আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানের হদিশ পেয়েছে তারাই টোকোলোশকে বিশ্বাস করেছে, চেষ্টা করেছে সাদাদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে যাওয়া আত্মসম্মান ফিরে পেতে। বাসভাড়া বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রের অনায্য আচরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা সাদাদের অবস্থানের ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেদের যে অপারগতা সাদাদের মনের গোপনে ছিল, কালোদের এই প্রতিবাদ তা একদম প্রকাশ্য রাস্তায় নামিয়ে এনেছে - তাদের এই প্রতিবাদও শুরু হয়েছে টোকোলোশের প্রভাবে।

এই অবাঙমনসগোচর টোকোলোশ আসলে ইউটোপিয়ান একটা ধারণা। নিপীড়িত কালো মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুসারে অসহায় আদিম মানুষ যেমন ‘ফাদার ফিগার’ খুঁজতে গিয়ে ঈশ্বরের জন্ম দিয়ে ফেলে, নিপীড়িত কালো মানুষের বিপন্নতার গর্ভে সেভাবেই জন্ম নেয় টোকোলোশ। কাজে ফেরার জন্য কালোরা যেসব শর্ত দিয়েছিল তা আসলে মনুষ্যত্বের অধিকার। নিজেদের অস্তিত্বকে তারা শর্তসাপেক্ষ করে রাখতে চায়নি। সাদারা এসব শর্ত মানতে চায়নি তাদের মান খর্ব হওয়ার আশঙ্কায়। মানুষ লড়তে পারে অন্য মানুষ বা প্রাণীর সঙ্গে, এমনকী নিজের সঙ্গেও, কিন্তু প্রকৃতির সাথে লড়াইতে মানুষের পরাভব নিশ্চিত। ঠিক এই জায়গায় মার খায় কালোরা। কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে বানভাসি অবস্থায় সসম্মানে জীবনধারণের চেয়েও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান অধিক জরুরি হয়ে ওঠে কালোদের কাছে। বাধ্যত আত্মসম্মানের বিনিময়েই তারা আবার ফেরে কাজে। কালোদের প্রতিরোধে সাদাদের স্তব্ধ রাষ্ট্রযন্ত্র নতিস্বীকারের মুখ থেকে ফিরে আসে প্রকৃতির আনুকূল্যে। সাদারা পরাভবের প্রান্ত থেকে স্বমহিমায় ফিরে আসে কালোদের খিদের ওপর নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রেখে। আর যখনই কালোরা নিজেদের আবার বিকিয়ে দেয় সাদাদের কাছে, তখনই অন্তর্হিত হয় টোকোলোশ। সে থেকে যায় শুধু পিটার আর জেলবন্দী তরুণ-তরুণীর মধ্যে, যাদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন শেষপর্যন্ত নেভেনি, আত্মসম্মান ফুরিয়ে যায়নি।

আপাত- নিরাশার সুর দিয়ে শেষ হলেও, এই যে দুটি ছেলেমেয়ের মধ্যে টোকোলোশের থেকে যাওয়া, ওটাই আসলে লেখকের স্টেটমেন্ট। যখন সুসময় আসবে, আবার কোনওদিন সেই বীজ থেকে পল্লবিত হয়ে উঠবে দ্রোহের বনস্পতি। সুবীর রায়চৌধুরীর ঝরঝরে, প্রাণবন্ত অনুবাদে সেগালের এই ক্লাসিকটি সকলের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।

#বইয়ের খবর #টোকোলোশ #রনাল্ড সেগাল #সুবীর রায়চৌধুরী #বই রিভিউ #রিভিউ #বর্ণবিদ্বেষ #দক্ষিণ আফ্রিকা #কিশোর উপন্যাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

87

Unique Visitors

182849