নিবন্ধ

জনগণের সরকার

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী July 15, 2020 at 2:45 pm নিবন্ধ

আপনি বাঙালি। সাধারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালি। আড্ডা ভালোবাসেন। শহর নিয়ে বেশ একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করেন রবিবার নাগাদ। আর ভালোবাসেন থিয়েটার– তাই নিয়ে গভীর আলোচনায় লিজেন্ডদের নাম তুলে আনতে। তর্কে যখন অন্য পার্টি শম্ভু-অজিতেশে আটকে গেছে, অ্যাঁ-অ্যাঁ করছে, হয়তো আপনার মুরোদ আছে বেপাড়ায় পেটো ফেলার মতো “বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার একটা অল্টারনেটিভ প্যারাডাইম” শব্দগুলো পাশাপাশি ফেলে বিস্ফোরণ ঘটানোর। চটাপট হাততালি। আপনি ফার্স্ট। এবার একটু আড়ালে ডেকে কেউ শুধোল, “ইয়ে ওই থার্ড না কী থিয়েটার বললেন ... ব্যাপারটা কেমন?” হিট অফ দ্য মোমেন্টে বোম তো ফেলে দিয়েছিলেন, কীভাবে বোম বানাতে হয় এটাও যে কেউ জানতে চাইবে ভাবেননি! এবার কি উশখুশ? ঢোঁক গেলা? “আমি একটু ওদিক থেকে চা-টা নিয়ে আসি” বলে চম্পট?

আপনি কেবল উদাহরণমাত্র। আদতে আমরা আপামর বাঙালি থিয়েটারপ্রেমী জনসাধারণ এই সীমার মাঝে অসীম হতে চাওয়ার গুপ্তরোগে আক্রান্ত। ‘অল্টারনেটিভ’ ব্যাপারটা নিয়ে দামামা পেটানো ইদানীং এতটাই ‘মেইনস্ট্রিম’ হয়ে গেছে যে বিশেষ কেউ তেমন আর ভাবেন না এই অল্টারনেটিভের আসল বিকল্পতা নিয়ে; মায় বাদল সরকারের আসল নাম ‘সুধীন্দ্র’ বললেও লোকে আজকাল হা-হা হেসে পিঠে টোকা মেরে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। একবার নাহয় আপনি না-জেনে বোমা ফেলেছেন; সে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন অজ্ঞানতায় পাপ হয় না, চাপ নেই। কিন্তু একবার যখন গলার কাছটা খুশখুশ করছেই, পরের বার কাফ সিরাপটা খেয়ে নামুন!

নিচে ‘জনগণের সরকার’- এই মর্মে দেওয়া রইল ছয় চামচ পথ্য। যথেষ্ট ডাইল্যুট করা, আর জল মেশাবেন না। পরের বার বাদল সরকার নিয়ে মুখ খোলার আগে এই কটা জিনিস গেলা চাই-ই চাই–

১। ভারতের আদি থিয়েটার বলতে আমরা বুঝি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা নাটক যে থিয়েটারে প্রযোজিত হত– গড়পড়তা ভাষায় ‘ক্ল্যাসিকাল থিয়েটার’। হ্যাঁ, সংস্কৃত ও ক্ল্যাসিকাল বলা মাত্র আমাদের চোখে গাছের ডাল থেকে পড়ে যাওয়া কালিদাসের ছবি ভাসছে। সে দিয়ে কাজ চলে যাবে। তা এই থিয়েটার চলত রমরমিয়ে। তবে আমাদের দেশে বরাবরই গণ্যমান্য আর সাধারণ– এই দুটো ভাগ প্রকট। কাজেই বড়োমানুষদের ক্ল্যাসিকাল থিয়েটারের পাশাপাশি, যাকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলি, সেই আঞ্চলিক সংস্কৃতির অন্তর্গত গুচ্ছখানেক লোকনাট্যের ধারাও বর্তমান ছিল। বারবার ইসলাম-আক্রমণে ক্ল্যাসিকাল থিয়েটার দিশা হারালেও, ভারতের আঞ্চলিক লোকনাট্যের শিকড় কিন্তু নষ্ট হল না। সনাতন নাট্যরূপ হিসেবে থেকে গেল তারা।

২। আধুনিক যুগে (ধরুন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে) যখন বড়োমানুষ-ছোটোমানুষ সবাই আবার হইহই করে নাট্যচর্চায় ব্যস্ত হলেন, তখন কিন্তু প্রাথমিক, আদি থিয়েটার হিসেবে ছিল লোকনাট্য– অর্থাৎ, আধুনিক যুগে এটি ‘ফার্স্ট থিয়েটার’। পাশাপাশি, আমাদের সাদা চামড়ার প্রভুরা তাঁদের দেশ থেকে নিয়ে এলেন সাফ-সুতরো, ঝাঁ-চকচকে মঞ্চনাটক, নিজেদের বিনোদনের খাতিরে। কে দেখবে ওসব ডার্টি নিগারদের ধুলোমাটির যাত্রাপালা?! অবশ্য যা হয়, সায়েবদের পায়ে পায়ে চলা কিছু এদেশিও জুটে গেল, যারা আপন করে নিল এই নতুন থিয়েটার– অবস্থানের দিক দিয়ে সে আমাদের ‘দ্বিতীয় থিয়েটার’।

৩। অতঃপর, যা হওয়ার, তাই হল। শহরে রাজত্ব চালায় ‘দ্বিতীয় থিয়েটার’– তার কথাবার্তায় স্টাইল ষোলো-আনা, হাবভাব ‘প্রোগ্রেসিভ’, টিকিট কেটে অন্ধকার ঘরে মানুষ বসে ঘণ্টা দুয়েক গল্প দ্যাখে, গল্প শোনে। কিন্তু সে বড়ো কাঠকাঠ, সুসজ্জিত সুয়োরানির মতো– তিন দিক বাঁধা, আলো ফেলা মঞ্চে চড়া মেক-আপ নিয়ে সে সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে গল্প বলে, ভাব দেখায় যেন গল্প শোনার কেউ নেই, দর্শকরা তো অন্ধকারে লুকিয়ে আছে! অন্যদিকে লোকসংস্কৃতির মাটিতে আলুথালু বেঁচে থাকে দুয়োরানি ‘প্রথম থিয়েটার’– তার বক্তব্য প্রাচীন, কখনও কখনও কুসংস্কারে আবৃত, শহুরে তীক্ষ্ণতার ধারকাছ সে মাড়ায় না। কিন্তু গড়নে সে খলবলে নদীর মতো– ইচ্ছে হলেই বদলে নিতে পারে অভিনয়ের ক্ষেত্র, ভাসিয়ে দিতে পারে চারদিক দিয়ে ঘিরে থাকা দর্শকদের, ভেঙে দিতে জানে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যেকার সীমানা। সে সবার; তার দর্শন পেতে টিকিট কাটতে হয় না।

৪। খোদ কলকাতায় বড়ো হয়ে ওঠা বাদল সরকার যখন পঞ্চাশের দশকে থিয়েটারে এলেন, তিনি কিন্তু কলকাতাখ্যাত মঞ্চনাটকেই এসেছিলেন। এমনকি, তাঁর লেখা বিখ্যাত যেসব নাটকের নাম বলে আপনি তর্কমঞ্চে বোমাটা ফেলতে শুরু করেছিলেন– ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সারারাত্তির’– এই সবই কিন্তু মঞ্চনাটকের জন্যই লেখা। দোষ নিচ্ছি না, আমরা এভাবেই ভেবে অভ্যস্ত। ‘রবীন্দ্রনাথের দাড়ি– রামছাগলের দাড়ি’ লজিকে আমরা হামেশাই বলে থাকি ‘‘বাদল সরকারের বিখ্যাত নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ একটি থার্ড থিয়েটার”। কাজেই, কাফ সিরাপের চতুর্থ চামচ জানিয়ে গেল– এই নাটকগুলো থার্ড থিয়েটার নয়। সরকারমশায়ের নাট্যজীবনের প্রথম ভাগ দ্বিতীয় থিয়েটারেই উদযাপিত, একগুচ্ছ দুর্দান্ত নাটক লিখে। নিজের দলও ছিল– শতাব্দী (যদিও তখনও অসফল)। তাহলে হঠাৎ এমন কী হল, যে প্রায় বিশ বছর মঞ্চে কাটিয়ে পঞ্চাশের কোঠায় ‘অন্য’ থিয়েটার করবেন বলে বেঁকে বসলেন তিনি?

৪। এইখানেই এন্টার বাদল সরকার দ্য ফিলোজফার! সব কিছুর সূত্রপাত একটা প্রশ্ন থেকে। প্রশ্নটা মানুষটি নিজেই করেছিলেন নিজেকে–

- থিয়েটার করছি কেন? কার জন্য?
- মানুষের জন্য, অবশ্যই।
-‘মানুষ’ বলতে? কারা?
- মানে দর্শক!
- মানে মঞ্চে তোমার নাটক দেখতে যারা আসে?
- তারা। আবার ঠিক তারাও নয়। তাদের বাইরেও তো কত মানুষ আছে যাদের কাছে থিয়েটারের
পৌঁছনো উচিত।
- তা মঞ্চের এই দর্শকেরা কী দোষ করল?
- দোষ না। তবে শুধুমাত্র বিনোদন ফলানোর বাইরেও থিয়েটারের একটা দায়িত্ব থাকে, মানুষের,
সময়ের, সমাজের প্রতি। কিন্তু এরা বেশিরভাগই ওই সন্ধেবেলা বিনোদনের মজা পেতেই আসে।
- তাহলে তুমি কাদের চাইছ?
- যারা চায় থিয়েটারের মতো ধারালো একটা ফর্ম তাদের কথা বলুক। মানে, সাধারণ মানুষ আর কী!
মঞ্চে গল্পকে জীবনের সঙ্গে মেলানো হয়; কিন্তু থিয়েটারে তো জীবনই গল্প হয়ে উঠতে পারে!
- জীবন তো জীবনই, সাধারণ। তার আবার গল্প হওয়ার যোগ্যতা আছে নাকি?
- আছে। আছে। ওইটাই একমাত্র গল্প। আমাদের রোজকার চাওয়া, পাওয়া, কষ্ট, গ্লানি, অনাচার,
রাজনৈতিক পালাবদল– এই সব থিয়েটার। আর এসব দেখার অধিকার শুধু ওই টিকিট কাটা মানুষদের
নয়। সব্বার।
- কী বলছ! মঞ্চনাটকের যা খরচ, তা না উঠলে তো ভরাডুবি হয়ে মরবে!
- মঞ্চে করলে তবে তো মরার প্রশ্ন! যেসব মানুষ নাটকের কাছে আসতে পারছে না দূরে আছে বলে,
বা টাকা নেই বলে, বা তাদের বাস্তবতা থেকে মঞ্চের বাস্তবতা অনেক আলাদা– এই ভেবে, আমি
থিয়েটারকে নিয়ে যাব তাদের কাছে। এটাই থিয়েটারের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। সে জনপ্রতিনিধি।
- স্বপ্ন যত গাঁজাখুরি! তা মঞ্চ ছেড়ে করবে কোথায়, শুনি?
- আপাতত একটা ছোটো ঘর ভাড়া নিয়েই করি নাহয়! চারদিকে লোক বসবে, মাঝে হবে অভিনয়!
নাটকের শেষে যে যেমন মনে করবে, টাকা দিয়ে যাবে চাদরে। কেউ না দিতে চাইলে না দেবে। কিন্তু
থিয়েটার তার দায়িত্ব থেকে সরবে না!
- ছোটো ঘরে তো টেনেটুনে একশো মানুষ বসাবে! অডিটোরিয়ামে তো ধরে অন্তত তিনশো! লাভটা কী
হল তোমার?
- হলের মতো অন্ধকারে নয়, একই আলোতে বসে দর্শক অভিনয় দেখবে, অভিনেতা কাজ করবে।
নাটক তো মানুষেরই প্রতিনিধি, তাহলে আবার আড়াল রেখে কাজ করার ভণিতা কেন? দর্শক
নাটকেরই অঙ্গ; তাকে নিয়ে, তাকে ঘিরেই নাটক হবে। সে শুধু দেখবে না, অংশও নেবে। আর
দর্শকসংখ্যার কথাই যদি বলো, ঘর তো একটা স্পেস মাত্র। আমি নাটক নিয়ে যাব পার্কে,
রাস্তার মোড়ে মোড়ে, গ্রামের মাঠে-ঘাটে, যেখানে মানুষের ভিড়, আলাপ, সেই সেইখানে।
- মানে বেসিক্যালি শহরের নাটক ছেড়ে গ্রামের নাটক করবে, তাই তো? বোঝা গেছে!
- নো স্যর! নট অ্যাট অল! দিস উইল বি অফ এ থার্ড কাইন্ড! না শহর ছাড়ব, না গ্রাম! না শহর
ধরব, না গ্রাম! এক্কেরে মাঝ বরাবর– লোকনাট্যের সহজ, ইলাস্টিক গড়ন, কিন্তু বাতিকগ্রস্ত,
ব্যাকডেটেড কনটেন্ট নয়; আর শহরের নাটকের তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত কনটেন্ট, অথচ মঞ্চের
জড়দ্গব গড়ন নয়।

৫। অতঃপর ধরাধামে আসিল বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার। ‘তৃতীয় থিয়েটার’ নিয়ে নিজের প্রথম লেখাতেই সরকার মশায় বলেছিলেন, এটি ‘Theatre of Synthesis’– অর্থাৎ, শহরের মঞ্চনাটকের বৌদ্ধিক দিকের, এবং লোকনাট্যের গঠনগত সাবলীলতার একটি সংশ্লেষ। মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলতে এই তিনটি– ফ্লেক্সিবল, অর্থাৎ অভিনয়ক্ষেত্রকে ভেঙেচুরে নিজের গড়নকে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারে এই থিয়েটার; পোর্টেবল, মানে ‘যেখান খুশি যাইতে পারি’; আর ইনএক্সপেন্সিভ, মানে নিখরচাতে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটিও চাইলে থিয়েটারের অংশ হয়ে উঠতে পারেন।

এর পর অবশ্য অনেক জল গড়িয়েছে। থার্ড থিয়েটার নানা সময়ে নিজের দিক বদলেছে, সংজ্ঞা পাল্টেছে। সে আরেক কিসসা। কিন্তু ওই সবকিছুরই গোড়ার কথা হল এইটুকু– যা না জানলেই নয়, যা আপনার তর্কে অপরিহার্য। এটুকু গিলে আগে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনপূর্বক বোমা মেরে আসুন দেখি, কোন মরদের কত জোর আপনাকে ঠেকায়! তারপর একদিন চা-মুড়ি নিয়ে বসব নাহয় আমি- আপনি, ডিটেলে থার্ড থিয়েটারের অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সটা সেরে নেব।



[ অলংকরণ : বিবস্বান দত্ত ]

#নিবন্ধ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

58

Unique Visitors

177647