ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

গিটার বনাম তানপুরা: কেতাবি গান আর বেহিসেবি প্রেমের গল্প

সুচরিতা বসু Aug 26, 2020 at 7:15 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সিরিজ : বন্দিশ ব্যান্ডিট‌স
পরিচালনা : আনন্দ তিওয়ারি
গল্প : অমৃৎপাল সিং বৃন্দা, লারা এহসান
সঙ্গীত : শঙ্কর-এহসান-লয়
চিত্রগ্রহণ : শ্রীরাম গণপতি
পরিবেশনা : অ্যামাজন প্রাইম

রাজকীয় গ্ল্যামারে মোড়া রাজস্থান, শাস্ত্রীয় ধুন আর অটো টিউনের টক্কর, মিলেনিয়াল প্রেমকাহিনি, গোঁড়া গুরুজির চোখ রাঙানি – স্টিরিওটাইপ করার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছু আছে বন্দিশ ব্যান্ডিট্‌সের প্রথম সিজনে। তা সত্ত্বেও যে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে এই সিরিজ দেখে ফেলা যায়, তার প্রধান কারণ এর অসামান্য বুনোট। সাধারণত এইজাতীয় আলোচনায় ক্যামেরা, পরিচালনা, গান, গল্প ইত্যাদি যতটা প্রাধান্য পায়, সৃজন বা creative execution নিয়ে সেইভাবে কথা হয় না। অথচ একটা সফল সিরিজের পিছনে অন্যতম খুঁটি তার ঠিকঠাক সৃজন; স্থান, গান, গল্প কীভাবে পরপর খাপ খাওয়ানো হবে, কীভাবে চরিত্রগুলো আরও বিশ্বাসযোগ্য করা হবে – এই সবকিছু বন্দিশ ব্যান্ডিট্‌সে অসম্ভব মনোযোগ নিয়ে করা হয়েছে। তাই সুতোর কাজ মোটাদাগের হলেও বুনোট হয়েছে পোক্ত, পিছল জার্নিতে পা হড়কে গেলেও গল্প কখনও আছাড় খায়নি। 

সাদাসিধে সরলরেখায় চলা গল্প শুরু হয় যোধপুরের বিখ্যাত গায়ক পণ্ডিত রাধেমোহন রাঠোরকে ঘিরে। কঠোর অনুশাসনে বেড়ে ওঠে তাঁর নাতি রাধে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করাই তার একমাত্র মোক্ষ। বহির্জগতের বিনোদন থেকে প্রায়-বিচ্ছিন্ন রাধের সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায় পপ মিউজিকের সুপারস্টার তমন্নার। তার আত্মবিশ্বাসী স্টেজ পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয় রাধে, আর রাধের সুরের জাদুতে তমন্না খুঁজে পেতে চায় তার ক্রিয়েটিভ ব্লক থেকে মুক্তির উপায়। ক্ষণিকের অসতর্কতায় গুরুর কাছে নাড়া-বাঁধার সুযোগ রাধে হাতছাড়া করে ফেলে। সঙ্গীতকে বিনোদনের জগতে টেনে আনার ব্যাপারে শাস্ত্রীয় ঘরানাগুলির সর্বজনবিদিত আপত্তির আবহে বাবার দেনা শোধ করতে, বন্ধক রাখা ছাদটুকু বাঁচানোর জন্য, রাধে মুখোশের আড়ালে পপ-ক্লাসিক্যাল ফিউশনে নিজের মনপ্রাণ ঢেলে দেয়। গানের সাথে সাথে রাধে-তমন্নার জুটি হৃদয়ের সুর মেলাতে থাকে, একে অপরের সান্নিধ্যে তাদের পরিচিত মিউজিক নতুন ভাষ্য খুঁজে নেয়। এর মধ্যে পণ্ডিতজিকে টক্কর দিতে হাজির হয় তাঁর পরিবারবিচ্ছিন্ন বড়ছেলে। তাঁদের অহং-এর রেষারেষিতে জড়িয়ে যায় রাধের ভবিষ্যৎ, ভাঙ্গাচোরা পরিবার লড়াইয়ের ময়দানে এসে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ফিউশন সুপারহিট হওয়াতে মিলেনিয়াল মিউজিকের সৃজনশীলতার সঙ্গে নিষ্ঠাবান শাস্ত্রীয় শিক্ষার দূরত্ব বাড়তে থাকে। প্রেম না পরিবার, কার ফাটল জোড়া লাগাবে রাধে? নিজের স্বপ্ন, গুরুজির আশা, তমন্নার আকাঙ্ক্ষা – সে কি কারও প্রতি সুবিচার করে উঠতে পারে? 

নজরে থাকুকঃ

কলকাতার গরিবি দর্শন


কিছুটা ‘অভিমান’, খানিকটা ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ - চেনা ছকের এই গল্পে স্টিরিওটাইপ প্রচুর। তমন্নার চরিত্রায়নের প্রথমভাগ থেকে শুরু করে তার সঙ্গে রাধের প্রেমের সূত্রপাত – পুরোটাই খানিক একপেশে ও অতিনাটুকে। ঘরানা রক্ষার জন্য প্রাণপাত করা থেকে ব্যক্তিগত ঈর্ষার স্বার্থে প্রতিভার টুঁটি চেপে ধরা – সবটুকু জুড়ে ক্লিশের ছড়াছড়ি। কিন্তু এই সিরিজের মূল আবেদন ধরে রেখেছে এর সৃজনের সততা ও বিশালতা। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রত্নভাণ্ডার সেঁচে এক একটি মণিমুক্তো এই গল্পের গায়ে বসিয়েছেন সুরকার ত্রয়ী শঙ্কর-এহসান-লয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী একই গান বিভিন্ন মেজাজে গাওয়ানো বা একই রেওয়াজের বিভিন্ন ধাপে স্বরের ক্রমোন্নতি বোঝানো, সবকিছুতেই তাঁদের দক্ষতা কুর্নিশযোগ্য বললেও কম বলা হয়। অক্ষত পারিখের তত্ত্বাবধানে, প্রতিটি মিউজিক্যাল পারফরম্যান্সে খুঁটিনাটির দিকে সতর্ক নজর রাখা হয়েছে। ফলত গানের দৃশ্যে গায়ক চরিত্রগুলির শরীরী ভাষা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এক একসময় মনে হতে বাধ্য যেন এঁরা প্রত্যেকেই বহুদিন ধরে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। ঠুমরিতে গমক ও মীড়ের কারুকাজ, তারানায় লয়কারির আন্দাজ, falsetto-এর সঠিক ও বেঠিক ব্যবহার – সবকিছুকে নিক্তিতে মেপে নির্ভুলভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। প্রথাগত তালিমের কঠিন পরিশ্রমের সঙ্গে গান-ভালোবেসে-গানের সংঘর্ষ হয়েছে বারবার – তবু কোথাও কাউকে ছোট দেখানোর জমি তৈরি হয়নি। 

তবে চরিত্র সাজাতে নির্মাতারা নিঃসন্দেহে আরেকটু যত্নবান হতে পারতেন। পণ্ডিতজির ভূমিকায় নাসিরুদ্দিন শাহ যেমন অসামান্য, তাঁর ছোটছেলের ভূমিকায় রাজেশ তৈলং ততটাই সাধারণ। রাধের মায়ের চরিত্রে শীবা চাড্ডার যতটুকু করার ছিল, সবটুকু তিনি নিখুঁতভাবে করে গেছেন। দিগ্বিজয়ের চরিত্রে অতুল কুলকর্নিও যথাযথ। সীমিত পরিসরে নজর কাড়েন কবীরের চরিত্রে রাহুল কুমার। তুলনায় অর্ঘ্যের চরিত্রে কুনাল রয় কাপুরের মতো অভিনেতা শুধুই ভাঁড়ামির ফাঁদে পড়ে নষ্ট হয়েছেন। চরিত্রগুলির পোশাক নির্বাচনে বয়স ও রুচিবোধের তারতম্যের ছাপ স্পষ্ট, রাধের পোশাকে প্রিন্ট এবং উজ্জ্বল রঙের যে প্রাধান্য রাখা হয়েছে তা নজরকাড়া। তুলনায় তমন্নার পরিচ্ছদ চরিত্রের প্রয়োজনেই অনেক সাহসী, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে খাপছাড়া। এই চরিত্রে নবাগতা শ্রেয়া কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট এবং দিশাহীন; তার তপ্ত সৌন্দর্য্য দিয়েও তমন্না চরিত্রের খুচরো খামতিগুলো ঢাকা যায়নি। সেই দায়ভার তিনি ছাড়া গল্পকারের উপরেও বর্তায়। তবে শুরু থেকে শেষ অবধি মুগ্ধ করে রাখেন রাধের ভূমিকায় নবাগত ঋত্বিক ভৌমিক। তাঁর যাবতীয় অভিব্যক্তি যেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাধ্য ছাত্রের কার্বনকপি। গানের মেজাজ থেকে সুরের রেওয়াজ, সবকিছুই তিনি এত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন যে সিরিজের লঘু পরিসরেও তাঁর উপর আস্থা রাখতে ইচ্ছে করে। অভিনয় ক্ষমতার পাশাপাশি একটি সলজ্জ হাসি লালন করেন তিনি, ভক্তদের ইন্সটাগ্রামে জায়গা করে নিতে ওটুকু যথেষ্ট। হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীতকে মিলেনিয়াল প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এমন উপভোগ্য প্রচেষ্টা বহুলাংশে সার্থক। 


#ওয়েব সিরিজ রিভিউ #বন্দিশ ব্যান্ডিটস #সুচরিতা বসু #আমাজন প্রাইম #amazon prime

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

61

Unique Visitors

182707