বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

কোশ গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপিকা অর্চনা শর্মা

স্বপন ভট্টাচার্য April 6, 2021 at 6:54 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আজকের দিনে বাংলায় দিদি সম্বোধনটির অনুষঙ্গে বিপরীতধর্মী ভাব-বিভাব যতই থেকে থাকুক না কেন, বাংলার বিজ্ঞানের জগতে দু এক দশক আগে দিদি সম্বোধনে যিনি অবিসংবাদীভাবে সম্বোধিত হতেন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা অর্চনা শর্মা, অধ্যাপক অরুণ কুমার শর্মার স্ত্রী-এই পরিচিতিটুকুর বাইরেও যিনি নিজের উদ্ভিদ কোশবিদ্যার বিশ্বব্যাপী প্রসারিত জগতে নিজের বড়সড় পরিচিতি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। কোলকাতার প্রবলভাবে পুরুষপ্রধান বিজ্ঞানজগতকে নাড়িয়ে দিয়ে দুই সায়েন্স কলেজে দুই নারী- রাজাবাজারে অধ্যাপিকা অসীমা চ্যাটার্জি এবং বালিগঞ্জে অধ্যাপিকা শর্মা যে সমীহ,শ্রদ্ধা ও সম্মান সেদিন আদায় করে নিতে পেরেছিলেন তা তাঁদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে দূরের মানুষ তো করেই নি বরং বিষয় নির্বিশেষে অ্যাকাডেমিক জগত তাঁদের বিভায় আলোকিত হতে পেরেছিল।

পুনে প্রবাসী এক বাঙালি পরিবারে ১৯৩২ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক স্তরের পড়াশুনা রাজস্থানের বিকানীরে সম্পন্ন করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫১ তে  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এখান থেকেই ১৯৫৫’তে ডক্টোরাল গবেষণা শেষ করে ১৯৬০ সালে ডি এস সি ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি হলেন দ্বিতীয় মহিলা ডক্টর অফ সায়েন্স। ইতিমধ্যে এই বিভাগেরই নবীন ও প্রতিভাবান অধ্যাপক অরুণ কুমার শর্মার সঙ্গে তাঁর কোশ ও ক্রোমোজোম গবেষণা সকলের নজরে আসতে শুরু করেছে।তাঁরা যে পরস্পরকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেবেন তা  স্বাভাবিক ছিল এবং আমৃত্যু এই বন্ধন নানাভাবে আমাদের বিজ্ঞান জগতকে ঋণী করেছে। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের সেল এন্ড ক্রোমোজোম রিসার্চ বিভাগ ভারতের সবচেয়ে শুরুর দিককার সেন্টার অফ অ্যাডভানস স্টাডিজ হিসাবে স্বীকৃত হবার পরে তিনি ১৯৭২ সালে প্রফেসর অফ জেনেটিক্স রূপে যোগ দেন সেখানে। বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব  সামলেছেন ১৯৮০ থেকে এবং ২০০৮ এর জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিনটি পর্যন্ত নিজের ল্যাবরেটারিতে গবেষক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অননুকরণীয় সক্রিয়তার মধ্যে কাটিয়েছেন তিনি।


শর্মা দম্পতির প্রথম দিকের গবেষণার ক্ষেত্র ছিল সাইটোলজি বা কোশবিদ্যা। যে কোন কোশের বিভাজন হয় কয়েকটি দশার মধ্য দিয়ে, এ আমরা সকলেই জানি।প্রতিটি দশার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় বিভাজনকালে কোশগুলির মধ্যেকার ক্রোমোজোমের ধরন-ধারণ বুঝে নিতে গেলে কোশগুলিকে সুনির্দিষ্ট বিভাজন দশায় আটকে রাখতে হয় এবং তারপর তাদের বিশেষ উপায়ে রঞ্জিত করে লেন্সের তলায় ফেললে ফুটে ওঠে তাদের নানা আকারের ক্রোমোজোম, নানা দশার কোশে যা যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই বন্দী হয়ে আছে। এজন্য তাঁদের বিদেশের গবেষণাগারে যেতে হয় নি।  ফিক্সিং ও স্টেইনিং এর একাধিক পদ্ধতি কোলকাতার এই ল্যাবরেটারিটি থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে নেচার, সেল ও সমমানের জার্নালে। বাটারওয়ার্থ থেকে প্রকাশিত তাঁদের বই ‘ক্রোমোজোম টেকনিক্স’ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বের ক্রোমোজোম গবেষনাগারগুলিতে। একবীজপত্রী উদ্ভিদের সাইটোলজি বিশেষ সমস্যার জায়গা কারন তাদের অঙ্গজ জনন হয় বেশি এবং ফুল খুবই ছোট। তাদের কোশের ক্রোমোজোমের আচরণ দেখে তাঁরা সিদ্ধান্তে আসেন ইনকনসিস্টেন্সি বা ব্যতিক্রমী ক্রোমোজোমীয় ধর্ম জীবজগতে নতুন স্পিসিস আনয়নের কারন হয়ে উঠতে পারে। সপুস্পক উদ্ভিদের সাইটোট্যাক্সোনমি বা কোশভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যায় এইসব তথ্য দিনে দিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে অধ্যাপিকা শর্মা তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত করেন মানুষের জেনেটিক্সে এবং ক্যান্সার গবেষণায়। পুর্ব ভারতের জনগোষ্ঠীর ক্রোমোজমীয় এবং জীনগত বিভিন্নতার সঙ্গে বংশগত ও অর্জিত রোগগুলির সম্পর্ক অনুশীলন করেছিলেন তিনি।  মানুষের ফাইব্রোব্লাস্টকে মডেল করে বিভিন্ন মিউটাজেন, কীটনাশক, ধাতব আয়ন এবং টক্সিনের অভিঘাত কত মারাত্মক তা দেখাতে পেরছিলেন তিনি। পরিবেশগত উপাদানগুলি যে মানুষের জেনেটিক বহুরূপতা বা পলিমরফিজম-এর জন্য কতটা দায়ী তা হাতেনাতে দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি। ডায়েট, ড্রাগ এবং বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ পদার্থ যে তা সংশোধিত করতে সক্ষম তাও দেখাতে পেরেছিলেন তিনি।

 অধ্যাপিকা শর্মার এই কাজগুলির স্বীকৃতি অবশ্য বিলম্বিত হয় নি। আজীবন তিনি ছিলেন এলসেভিয়র প্রকাশিত ‘দ্য নিউক্লিয়াস’ জার্নালের সম্পাদক। তিনশোর উপর গবেষণাপত্র তাঁর এবং আটখানি একক বা যৌথভাবে লিখিত পুস্তক। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১৯৮৬-৮৭ অধিবেশনে তিনি ছিলেন সভাপতি। ভাটনগর ( ১৯৭৬) পুরষ্কার পেয়েছেন।  পেয়েছেন জে সি বোস অ্যাওয়ার্ড, বীরবল সাহনি মেডেল, ফিকি(FICCI) প্রদত্ত পুরস্কার সহ অজস্র পুরস্কার। ১৯৮৪ তে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন শ্রীমতী শর্মা।

আরও পড়ুন : গোটা একটা নক্ষত্র সম্প্রদায় আবিষ্কার করেও নোবেল-উপেক্ষিতা জোসেলিন বার্নেল / অর্পণ পাল

ছোটখাটো মানুষ অর্চনা শর্মা, সকলের অর্চনাদি, ছিলেন অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। নিজের কোন সন্তানাদি ছিল না কিন্তু ছাত্রদের দেখিয়ে বলতেন-এই যে এতগুলো আমার ছেলেমেয়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও দিদির মধ্যে মাতৃস্নেহের বহমান ফল্গুধারাটি অধরা ছিল না কোনোদিন। বিজ্ঞান গবেষকের আড়ালে একজন অসম্ভব রসবোধসম্পন্ন সংস্কৃতিমনা শিক্ষককে লালন করে গেছিলেন তিনি আজীবন এবং সেই কারনে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর অগণিত ছাত্র ছাত্রীর কাছে তিনি এক অমলিন দিদি হয়ে থেকে যেতে পেরেছেন আজ পর্যন্ত।  

........................... 

[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

#বিজ্ঞান #প্রযুক্তি #বিজ্ঞানbyনারী #series #অর্চনা শর্মা #অরুণ কুমার শর্মা #উদ্ভিদবিদ্যা #Archana Sharma #কোশবিদ্যা # স্বপন ভট্টাচার্য #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

42

Unique Visitors

215820