কৃষিবিদ্যাই তাঁর দর্শনচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু : মাসানুবো ফুকোওকার আশ্চর্য জীবনবীক্ষা
মাসানুবো ফুকোওকা- জাপানের একজন ‘অলস’ কৃষক ও দার্শনিক। ‘অলস’ চিন্তা এবং কর্মপদ্ধতির মাধ্যমেই কৃষিদুনিয়ায় বিপ্লব এনেছিলেন তিনি। জাপানের শিকোকু দ্বীপের ছোট্ট শহর ইয়ো-র অধিবাসী এক বনেদি, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান মাসানুবো ফুকোওকা। মাসানুবোর জন্ম ১৯১৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি। বাবা কামেইচি ফুকোওকা ছিলেন ইয়ো শহরের মেয়র। তাছাড়া কামেইচির বেশ ভালো পরিমাণে জমি ছিল, সেখানে তিনি কমলালেবু চাষ করতেন।
কামেইচি এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানতেন, তাঁদের সেই শিক্ষা তাঁরা কাজে লাগিয়েছিলেন সন্তানদের আত্মিক বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে। আর্থিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সন্তানদের বিলাসিতায় অভ্যস্ত করেননি। মাসানুবোর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নিজের শহরেই। পরে হাইস্কুলে পড়তে যেতেন মাতসুয়ামা শহরে। ছাত্র হিসেবে মাসানুবো ছিলেন মধ্যমেধার এবং পড়াশোনায় অমনোযোগী। তাঁর মনে ধরেছিল শুধু সাহিত্যের ক্লাস। সাহিত্যের শিক্ষক বলেছিলেন, এমন পাঁচজন বন্ধু বাছাই করো যারা তোমার মৃত্যুতে কষ্ট পাবে। একথা মাসানুবো মনে রেখেছিলেন সারাজীবন, এই দর্শন তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। হাইস্কুলের শেষে মাসানুবোর বাবা তাঁকে পাঠালেন জিফু কৃষি কলেজে। এখানেও তাঁর পড়াশোনায় মন বসল না। ১৯৩২ সালে জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া দখল করে তখন কিছুদিন মাসানুবো সামরিক প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। এরপর অবশ্য মাসানুবো জিফু কলেজ থেকে গাছের রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ডিগ্রি পাওয়ার পর শিক্ষক মাকাতো হিউরার পরামর্শে তিনি ওকায়ামা কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা শুরু করেন।
পরে মাসানুবো ইয়োকোহামা কাস্টম্সে প্ল্যাট ইন্সপেকশনের চাকরি পান। এই চাকরি করার সময়ে তিনি প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন। যেসব রোগগ্রস্ত গাছ বা ফল তাঁর কাছে আসত, অণুবীক্ষণ যন্ত্রে খুঁটিয়ে দেখতেন সেসব। চাকরির তিন বছরের মাথায় তিনি প্রবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসার জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন একটা বদ্ধ ঘরে একা কাটাতে হয়। বেশ কিছুদিন বাদে তিনি সেরে উঠলেন ঠিকই, কিন্তু দুর্বল শরীরের পাশাপাশি তখন তিনি মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত। দীর্ঘকাল নিভৃতবাসের সময়েই তাঁর মনে হয়েছিল মানুষের জীবন অর্থহীন, তাঁর মৃত্যু হলে পৃথিবীর কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না। এইসব নানা চিন্তা করতে করতে একরাতে তিনি পাহাড়ের খাদের পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে উঠে তাঁর অদ্ভুত ভাবান্তর হয়; মনে হয়, পৃথিবীকে আসলে মানুষের দেওয়ার কিছুই নেই। বিশ্বপ্রকৃতি নিজের নিয়মে চলবে, তাকে কোনও নিয়ম বা রীতিতে বেঁধে ফেলবার সাধ্য কারও নেই। এই ঘটনার পরের দিনই মাসানুবো চাকরি ছাড়েন।
চাকরি ছাড়ার পর বিভিন্ন জায়গায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফেরা শুরু করেন মাসানুবো। টোকিও, ওসাকা, কোবে, কিয়োটো বিভিন্ন শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিয়ুশু দ্বীপে একটানা কয়েকমাস থাকলেন। সব জায়গাতেই মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির কথা – জগতের সবকিছুই অর্থহীন। তখন লোকে অবশ্য তাঁকে উন্মাদ ছাড়া আর কিছুই ভেবে উঠতে পারেনি। এই যাত্রা শেষ করে তিনি ফিরে এলেন ইয়ো শহরে তাঁর নিজের বাড়িতে। সেখানে পৈতৃক পাহাড়ি জমিতে একটা কুঁড়েঘর করে থাকতে শুরু করলেন আর সবাইকে যেমন বলেছিলেন, তেমনই ‘অলস জীবনযাপন’ শুরু করলেন।
এই সময়ে মাসানুবো প্রকৃতিকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তাঁর বাড়ির আশেপাশে যেসব পরিত্যক্ত ফলের ক্ষেত ছিল, সেগুলোকে তিনি সেভাবেই ফেলে রাখলেন। এর পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল, মানুষ প্রকৃতির গতিপথ বদলাতে পারে না, তাই সে চেষ্টারও দরকার নেই। দেখা গেল, কিছুদিন বাদেই সেসব ক্ষেতে নতুন চারা গজাতে লাগল, তারও কিছুদিন বাদে গাছে এল ফল। মাসানুবোর এই জীবনযাত্রা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহরের মেয়রের ছেলে নিষ্কর্মার মতো বসে থাকবে, তা মাসানুবোর বাবা মানতে পারেননি। তাঁর উদ্যোগেই মাসানুবো কোচি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কীটপতঙ্গ এবং রোগনিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চাকরি পান। এখানে মাসানুবো পাঁচ বছর কাজ করেছিলেন।
নতুন চাকরিতে মাসানুবোর কাজ ছিল নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়ান যায় সেই বিষয়ে গবেষণা করা। এই গবেষণার পাশাপাশি তিনি আরেকটা কাজও করেছিলেন – একইসঙ্গে দুটো আলাদা জমিতে দুই রকম চাষের পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা চালালেন। একটিতে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে আগাছা দমন করে, সার প্রয়োগ করে, কীটনাশক ছিটিয়ে ফসল ফলালেন; অপর জমিতে কিছুই করলেন না, শুধু বীজ ছিটিয়ে দিলেন আর সেখানে নিজে থেকে ফসল ফললো। ফলাফল হিসেব করে দেখা গেল, বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফসল তুলনায় কিছু বেশি হলেও উৎপাদন খরচ এবং শ্রমের হিসেব ধরে দেখা যাচ্ছে দুই জমির উৎপাদন একই দাঁড়াচ্ছে। এর থেকে মাসানুবো সিদ্ধান্তে এলেন যে কিছু না করাটাই সর্বোত্তম কৃষি পদ্ধতি। মাটি, প্রকৃতির উপর জোর খাটালে বরং মাটির উর্বরতা কমে যেতে পারে। যুদ্ধশেষে পরাজিত জাপান সবদিক থেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মাসানুবোর পারিবারিক জমির অনেকটাই হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশিষ্ট জমিতে মাসানুবো তাঁর নিজের আদর্শানুসারে চাষ করতে থাকেন।
মাসানুবো শিখেছিলেন, যে জমিতে একবার বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ হয়েছে সেই জমি আর প্রাকৃতিক নেই। তিনি বুঝলেন, তাঁর এই ‘অলস কৃষিকাজ’-এর উপযোগিতা মানুষকে বোঝাতে হবে। এই কৃষিপদ্ধতির মোদ্দা কথা হল, লাঙল নয়, সার নয়, সেচ নয়, কীটনাশক নয়, আগাছা কাটা নয় – কিছুই করতে হবে না, যা হওয়ার এমনিই হবে, তাই এই পদ্ধতির নাম ‘Do Nothing Agriculture’। কৃষির এসব দর্শন আর পদ্ধতি নিয়ে মাসানুবো ১৯৭৫ সালে একটি বই লেখেন, “One Straw Revolution”। এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে মানুষের নজরে আসতে থাকে, বিশেষত জাপানে এর ব্যাপক প্রভাব ছিল।
এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লোক আসতে শুরু করে মাসানুবোর কাছে এই পদ্ধতিতে চাষ শেখার জন্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারেও তিনি আমন্ত্রিত হন তাঁর দর্শনের কথা শোনানোর জন্য। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, এমনকি আমাদের কলকাতা – বিশ্বের তাবড় জায়গায় পৌঁছে গেছেন মাসানুবো, হাতে একখণ্ড খড় নিয়ে। মশালের মতো উঁচিয়ে রাখতেন সেই খড়, সেই খড়ের শক্তিই বোঝাতেন মানুষকে। পরবর্তীতে মাসানুবো মরুভূমিতে ফসল ফলানো নিয়েও কিছু কিছু কাজ করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে মাসানুবো মানবসেবায় তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত হন। আজীবন মাসানুবো অক্লান্তভাবে তাঁর এই জীবনদর্শন পৌঁছে দিতে চেয়েছেন মানুষের কাছে।
#Masanubo fukooka #Japanese #Farmer #Agriculturalist #Organic Farming #Natural Farming #পরিবেশ-বান্ধব কৃষি #কৃষিবিদ #Agricultural scientist #কৃষি বিজ্ঞানী #Ramon Magsaysay Award #Sustainable Development #মন্দিরা চৌধুরী #সিলি পয়েন্ট